ঘটনার সূত্রপাত আমফান ঝড়ের কয়েকদিন পরেই। ২০২০ সালের জুন মাসের এক উত্তপ্ত দুপুরে।
মাস্কের আড়ালে হাই তুলতে তুলতে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, ‘পেটের মধ্যে অগ্নাশয় বলে একটা গ্রন্থি থাকে, তার থেকে ইনসুলিন হরমোন তৈরী হয়। সেই হরমোন আমাদের রক্তের গ্লুকোজ….’
সনকা মাসি মাঝ পথে বলে উঠল, ‘এসব হাবিজাবি শুনে আমি কী করবো? লিভারে গণ্ডগোল হয়েছে, সুগার হয়েছে। লিভার ঠিক করার ওষুধ দ্যান, যাতে সুগারটা সেরে যায়।’
বুঝলাম এই লিভার সর্বস্ব মহিলাকে ডায়াবেটিসের প্যাথোফিজিওলজি বোঝানো আমার কম্ম নয়। নেহাৎ ঘোলা যাওয়ার সময় সনকা মাসির দোকানে মোষের দুধের স্পেশাল চা খাই, তাই এতক্ষণ চেষ্টা করছিলাম।
মাসি আবার বলল, ‘কিন্তু এতো লোক থাকতে আমার বাইশ বছরের মেয়েটার সুগারটা হলো কী করে?’
কী করে হলো সে কি ছাই আমি জানি। ডাক্তার হয়ে প্রথম প্রথম যে গর্ব বোধ ছিল সেসব অনেকদিনই চুপসে গেছে। এখন দিনগত পাপক্ষয় করি। বড়সড় ঝামেলা ছাড়া দিন কাটলেই খুশি।
আগের দিনের ঘটনা। একজন বয়স্ক মানুষ এসেছিলেন হেঁটে হেঁটে। মাথাটা সামান্য ঘুরছে। প্রেশার স্বাভাবিক, ইসিজি স্বাভাবিক, সুগারও স্বাভাবিক। মাথা ঘোরার ওষুধপত্র দিয়ে ছেড়ে দিলাম। রাত বারোটায় রোগীর ছেলে সহ তিনজন এসে উপস্থিত। ‘বাবা সম্ভবত মারা গেছেন। আজ দুপুরেই দেখিয়ে গেছেন, কী ওষুধ দিলেন?’ তাঁর গলায় অভিযোগের সুর স্পষ্ট।
সারাদিন রোগী দেখে শরীরটা ঘুমের জন্য হাঁকুপাঁকু করছিল, এসব কথা শুনে এক মুহূর্তে ঘুম উবে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় বাড়ি আপনাদের?’
‘মুড়াগাছা হাসপাতালের কাছাকাছি। চলুন একবার। গাড়ি নিয়েই এসেছি।’
সর্বনাশ, মুড়াগাছা তো অনেক দূর। সেই কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। আশেপাশের পাড়ায় হলে একটা ভরসা ছিল। চেনা জানা মানুষ পাওয়া যাবে। তাছাড়া এনাদের যা মনোভাব দেখছি, বাড়ি নিয়ে গিয়ে জামাই আদর করবেন বলে মনে হচ্ছে না।
যিনি মারা গেছেন তাঁকে আজকেই দেখেছি। না গিয়েও উপায় নেই। তবে ওনাদের গাড়িতে নয়,নিজের স্কুটারে যাব৷ বিশ্বস্ত বাহনটা সঙ্গে থাকলে ভরসা পাব। তেমন ঝামেলায় পড়লে পালাতেও সুবিধা হবে।
বললাম, ‘দাঁড়ান, তৈরী হয়ে আসি। আপনারা গাড়ি নিয়ে চলুন। আমি পেছনে পেছনে স্কুটারে যাচ্ছি।’
জামা পরছি, রূপালী পেছনে এসে দাঁড়াল। মুখটা ভার ভার। বলল, ‘না গেলেই কি নয়?’
হাসলাম, ‘এই তো যাব, ডেথ সার্টিফিকেটটা দিয়েই চলে আসবো। কোনো সমস্যা নেই। তুমি শুয়ে পড়ো।’
বললাম বটে, কিন্তু বেশ জানি আমি না ফেরা পর্যন্ত রূপালী চুপচাপ বসে থাকবে। ডাক্তারের বউ হওয়ার জ্বালা কম নয়। বিশেষ করে আমাদের মতো খুপরিজীবি ডাক্তারের।
বাড়ি ফিরেছি রাত দেড়টা নাগাদ। রোগীর বাড়ির লোকজন খারাপ ব্যবহার করেননি। তবে বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনিতো আজকেই দেখেছেন। এমন যে হতে পারে বুঝতে পারেননি?’
বাকি রাত ঘুম হলো না। বারবার সেই রোগীকে দেখার সময়টুকু মনে আসছে। মনের ভেতর খচ খচ করছে। এরকম হঠাৎ মৃত্যুর কিছু লক্ষ্মণ কি ছিল? আমার সিক্সথ সেন্স কি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে?
ঘুম না হওয়ায় এখন ঘনঘন হাই উঠছে। ভাগ্যিস মাস্ক পরে আছি। হাই তোলা ডাক্তার ভালো দেখায় না। তার উপর সনকা মাসি ঘ্যান ঘ্যান করছে, তার মেয়ে কমলার হঠাৎ ধরা পরা সুগার আমাকে সারিয়ে দিতে হবে। কারণ সামনেই কমলার বিয়ে। অমন পাত্র হাতছাড়া করা মুশকিল।
বললাম, ‘বিয়ে দেওয়ার এতো তাড়া কীসের। ওইতো রোগা প্যাংলা মেয়ে। আর কটা দিন যাক। হাড়ে একটু মাংস লাগুক।’
মাসি বলল, ‘মাংস লাগবে কোত্থেকে। ওর বাপ বহুদিন আগেই অন্যের সাথে পালিয়েছে। যাওবা দুটো খেটে খাচ্ছিলাম, লকডাউনে সব শিকেয় উঠেছে। এখন দোকান খুলি বটে কিন্তু বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। ভেবেছিলাম মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলেই আমার কাজ শেষ। কিন্তু এমন সমস্যা হবে বুঝিনি। ওর সুগার আছে জানলে পাত্রপক্ষ বেঁকে বসবে।’
বললাম, ‘বেঁকে বসুক আর যাই হোক, রোগ গোপন করে বিয়ে দিও না।’
‘কিন্তু সুগার আছে জানলে কেউ ওকে বিয়ে করবে? এমনিতেই তো রূপ নেই, টাকা পয়সার জোরও নেই। তার উপর বাপও অন্য মেয়ের সাথে পালিয়েছে।’
কমলা চুপচাপ সব শুনছে। আমার ভারি খারাপ লাগল। বললাম, ‘ওষুধ লিখে দিলাম। পনেরো দিন পরে আরেকবার খালি পেটে সুগার করে আসবে। কম বয়সের সুগার অনেক সময় ওষুধে কমতে চায়না, ইনসুলিন লাগে। সেই ধরণের ডায়াবেটিসকে বলে ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবে…’ মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম। খাওয়া দাওয়া নিয়ে দুচার কথা বললাম।
সনকা মাসি আর কমলা চলে গেল। তবে পনেরো দিন বাদে আর এলোনা। ঘোলায় যাতায়াতের পথে দুয়েকবার খেয়াল করে দেখলাম, মাসির দোকান বন্ধ।
ঘটনাটা ভুলেই গেছিলাম। হঠাৎ একদিন মাসির দোকান খোলা দেখে স্কুটার থামালাম। বললাম, একটা স্পেশাল চা দাও। তারপর মাসি, কমলার কী খবর?’
সনকা মাসি বলল, ‘ওতো শ্বশুরবাড়িতে আছে। ভাতছালায় বিয়ে হয়েছে। হাবরায় নেমে যাওয়া যায়। একেবারে অজ পাড়াগাঁ। ওখানে ওর শ্বশুরের বেশ জমি জমা আছে।’
‘ওষুধ পত্র খাচ্ছে? আর রক্ত পরীক্ষা করেছে?’
মাসি ভাবলেশহীন মুখে বলল, ‘এখন খাচ্ছে না। পরে সমস্যা হলে বরের সাথে ডাক্তার দেখাবে। তখন সুগার ধরা পড়লে পড়বে। ওরা তো আর জানবে না, বিয়ের আগের থেকেই সুগার ছিল।’
এতদিন সনকা মাসির চা বেশ ভালোই লাগত। আজ কেমন বিস্বাদ লাগছিল। ঠিক করলাম এই মহিলার দোকানে আর চা খেতে আসব না।
মাসি বলছে, ‘কমলা ফোন করে, বেয়াই বেয়ানও ফোন করে। গিয়ে কটা দিন কাটিয়ে আসতে বলে। কিন্তু ট্রেনটা না চললে যাওয়া খুব মুশকিল। মেয়েটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। ও ছাড়া আমার তো কেউ নেই।’
তারপর মহালয়া হয়ে গেল। এবারের পুজো মহালয়ার এক মাস পরে। করোনা কেসও লাফ দিয়ে বাড়তে শুরু করল।
পুজোর ঠিক আগেই বাড়িতে বাবা ও রূপালীর করোনা হল। গোটা পুজো বাড়িতেই আইসোলেশনে কাটালাম এবং সম্ভবত আমার দুই কন্যার সাথে শ্রেষ্ঠ পুজো কাটালাম। এই প্রথম গোটা পুজোয় একদিনও ডিউটি নেই। রোগী দেখার ঝক্কি নেই। বাড়ির ঠিক সামনেই পুজো হয়। বারান্দায় বসেই ঠাকুর দেখা যায়। অতএব পুজোও মিস হলো না।
কালী পুজোর দিন রোগী দেখছি, সনকা মাসি এসে হাজির, ‘ডাক্তারবাবু, একটা সমস্যা হয়েছে? কমলার বাচ্চা এসেছে।’
বললাম, ‘সব্বনাশ, ওখানে শিগগিরি ডাক্তার দেখাও। সুগার পরীক্ষা করো।’
‘ওর শ্বশুরবাড়ি ভাতছালা একেবারে পাড়া গাঁ। আমি কাল গেছিলাম। ওর শাশুড়িকে বলেছিলাম, একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিন। রক্ত পরীক্ষা করে নিন। উনি বললেন, ও বাড়িতে বাচ্চা এমনি এমনিই হয়। খুব সমস্যা না হলে ডাক্তার দেখানো হয় না।’
রেগে মেগে বললাম, ‘তাহলে তুমি মেয়েকে এখানে নিয়ে আস। ডাক্তার দেখাও। গর্ভবতী অবস্থায় ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে গর্ভস্থ শিশু আর মায়ের দুজনেরই মৃত্যু হতে পারে।’
সনকা মাসি একেবারে কেঁদে ফেলল, ‘মেয়েটার চেহারা একেবারে ভেঙে গেছে। ডাক্তারবাবু, আপনি ওষুধ লিখে দেন না। আমি মেয়েকে লুকিয়ে দিয়ে আসব। ও ছাড়া আমার কেউ নেই। আমি নিয়ে আসার কথা বলেছিলাম, কিন্তু বেয়ান বললেন, ও বাড়িতে নাকি বাচ্চা হওয়ার সময় মেয়েকে বাপের বাড়ি পাঠানোয় নিষেধ আছে।’
আমি বেশ রেগেই বললাম, ‘ওই ভাবে কখনও চিকিৎসা করা যায় নাকি? তাছাড়া গর্ভাবস্থায় অধিকাংশ সুগারের ওষুধই খাওয়া যায় না। ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। সপ্তাহে সপ্তাহে সুগার মাপতে হয়। অন্তত কমলা ওর বরকে সব খুলে বলুক। নাহলে বড়সড় বিপদ ঘটতে পারে।’
সনকা মাসি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। আমার খারাপই লাগল। স্বামী পরিত্যক্তা হয়েও সে অনেক কষ্ট করে মেয়েটাকে মানুষ করছেন। ওই মেয়েই ওর সব। মেয়েকে ভালো জায়গায় পাত্রস্থ করার লোভে একটি ভুল করে ফেলেছে। এখন সেই ভুলের ফাঁদ থেকে কি করে মেয়েকে উদ্ধার করবেন বুঝতে পারছে না। সম্ভব হলে ওকে নিশ্চয়ই সাহায্য করতাম। কিন্তু মাসি যেভাবে সাহায্য চাইছে তা আমার সাধ্যের বাইরে।
দিন চলে যাচ্ছে। বাতাসে বেশ শীত শীত ভাব। আমি আর মাসির দোকানে চা খেতে যাইনা। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে কুন্ডুবাড়ির সামনেও দারুণ চা করে। সেখানেই চা খাই। তবে কৌতূহল হয়, কমলার কী হলো, কেমন আছে? ওর কি চিকিৎসা শুরু হয়েছে?
পরপর কয়েকদিন মাসির দোকান বন্ধ দেখে একদিন স্কুটার থামালাম। পাশের এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, সনকা মাসি দোকান খুলছে না কেন?’
দোকানী বললেন, ‘সে বড় দুঃখের কথা ডাক্তারবাবু, মাসির মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ। গত সাতদিন ধরে আর জি করে ভর্তি। জ্ঞানই নাকি ফিরছে না। মাসি এখন আর জি করেই পরে রয়েছে। বড় ভালবাসে মেয়েটাকে। ওর কিছু হয়ে গেলে মাসি পাগল হয়ে যাবে।’
মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। কী কুক্ষণেই ডাক্তারি পড়েছিলাম। একে তো সারাদিন ধরে অসুস্থ মানুষ দেখে যাও, তাঁদের হাজার গণ্ডা অভিযোগ শোনো। তারপরও এসব খারাপ খারাপ খবর। অন্য কোনো পেশায় থাকলে অনেক শান্তিতে দিন কাটাতে পারতাম। সনকা মাসির সাথে আলাপই হতো না।
দিন দশেক বাদে শীত তখন বেশ জাঁকিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে, সনকা মাসি এসে হাজির। হাতের একটা রঙ ওঠা প্লাস্টিকে একগাদা কাগজ পত্র। এ’কদিনে মাসির চেহারা অনেকটা ভেঙে গেছে। চোখের তলায় কালি। কিন্তু সেই চোখে একটা খুশির আভা। আশ্বস্ত হলাম, যাক, খবর তাহলে খারাপ নয়।
মাসি জানাল, গতকালই কমলাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়েছে। ওর পেটের সন্তানটা নষ্ট হয়ে গেছে। তবে কমলা এখন মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছে। অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। এমনকি আর জি করের বড় ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, বেশি আশা না করতে। বড়ো ঠাকুরের অসীম কৃপায় কমলা এযাত্রা নতুন জীবন পেয়েছে।
আমি হাসপাতালের ছুটির কাগজটা দেখলাম- “ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস”। সনকা মাসির ভাগ্য বেশ ভালোই বলতে হবে যে মেয়েকে ফিরে পেয়েছে।
সনকা মাসি বলে চলেছে, ‘ডাক্তারবাবু, হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছে স্থানীয় কোনো মেডিসিনের ডাক্তার দেখাতে। কমলা আর ওর বর আমার বাসাতেই আছে। কালকে ওদের নিয়ে আপনার কাছে আসব। ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি ওর আগে থেকেই সুগার ছিল। ভেবেছে হঠাৎ করেই ওর সুগার হয়ে অতটা খারাপ হয়ে গেছে। আপনি দয়া করে ওর স্বামীর সামনে বলবেন না, ওর বিয়ের আগেই সুগার ধরা পড়েছিল। এবার ওর চিকিৎসাও হবে, স্বামীর ঘর করাও হবে।’
সনকা মাসির মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। সে একটা বিশাল ঝুঁকি নিয়েছিল। প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছিল। তবে শেষমেশ যুদ্ধটা জিতেছে। আমি রাগ করব না খুশি হবো বুঝতে পারছিলাম না।
ছবি © শ্রীময় ভট্টাচার্য