দুর্যোগ বা Disaster মানে কি???
একটা গাড়ি দুর্ঘটনাকে কি দুর্যোগ বা বিপর্যয় বলা যেতে পারে?? কিম্বা কোনও রেলগাড়ির অ্যাকসিডেন্টকে বা কোনও বিমান দুর্ঘটনা কে কি দুর্যোগ বা বিপর্যয় বলা যাবে?? দুর্যোগের সংজ্ঞা কি?? কখন কাকে দুর্যোগের আওতায় ফেলা যায়! ভুমিকম্প হওয়ার পর কেউ মারা গেলো না সেটা কি দুর্যোগ?? কতো জন মারা গেলে বলতে পারবো?? ১০০ নাকি ১০০০ নাকি আরও বেশি??
কোন যুদ্ধ বা সন্ত্রাসবাদী হামলা বা ধর্মীয় দাঙ্গা এগুলোকেও কি দুর্যোগ বলা যায়? অথবা চেরনোবিলের মতো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে দুর্ঘটনা??? অন্যদিকে একটা মহামারি যেমন কোভিড-১৯ বা সাম্প্রতিক কালের আম্ফান বা আজকের ইয়াস, শেয়ার মার্কেটরে হঠাৎ পতনের জন্যে বিপুল আর্থিক ক্ষতি কিম্বা পাহাড়ে ধস দুটোই কী বিপর্যয়! অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে কোনও একটা পরিচিতি বা ডাইমেনশান কে দিয়ে বিপর্যয় এর সংজ্ঞা দেওয়া খুব মুশকিল! কিন্ত দুর্যোগের সংজ্ঞা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাহলে আমরা সঠিকভাবে বলতে পারব কোন জায়গায় সাহায্য দরকার, কি ধরনের সাহায্য দরকার, কত তাড়াতাড়ি এবং কি পরিমাণ সাহায্য দরকার! যাতে আমরা পার্শ্ববর্তী ক্ষতিগ্রস্ত নয় এমন জায়গা থেকে সাহায্য দ্রুত সাহায্য ও ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে পারি!
Disaster শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন দুটি শব্দ থেকে- Dis (Against) এবং Astrum (The stars) যার অর্থ দাঁড়ায়-the stars are against us. ১৯৭৮ সালে Lazarus & Cohen একে প্রথম সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেন। ১৯৯২ সালে WHO বলে- দুর্যোগ হল কোন এক
কমিউনিটি বা সামাজিক জায়গায় শারীরিক বা অর্থনৈতিক বা পরিবেশের আকস্মিকভাবে তীব্র ভাঙ্গন, যা ওইখানের মানুষ ও তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী সামলানো সম্ভব নয়!
পরবর্তীতে ভারতের The Disaster Management Act 2005 অনুযায়ী- ‘যে কোন ধরনের আকস্মিক দুর্ঘটনা, বিপত্তি, ধ্বংস অথবা অনর্থ যা কোন জায়গায় প্রাকৃতিক কারণে বা মানুষের দ্বারা কিম্বা কোনো হঠকারিতা বা ভুলের জন্যে যা কিনা মানুষের মৃত্যু বা মানবিক সম্পদ নষ্ট ও পরিবেশের ক্ষতির জন্যে দায়ী এবং যার তীব্রতা এতোটাই বেশি যে একে প্রভাবিত জায়গার মানুষের সম্মিলিত ভাবে আটকানোর ক্ষমতা নেই।’ তাই বোঝা যায় যে দুর্যোগ বা বিপর্যয় এর কোন একটা দিক নেই!অনেককটা বৈশিষ্ট্য আছে তা দিয়ে একে
বোঝার চেষ্টা করা হয়-
(১) আকস্মিক
(২)অনিশ্চিত- যার আবির্ভাব ও ক্ষতিকর প্রভাব আগে থেকে বোঝা যায় না
(৩)মানুষের নিয়ন্ত্রনের বাইরে
(৪) ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।
(৫)মানুষের মৃত্যু-দুঃখ-যন্ত্রণার তীব্রতা অনেক বেশি
(৬) দুর্যোগকে সামলানোর ক্ষমতা সেই এলাকার মানুষের নিজস্ব সামর্থ্যের বাইরে।
মোটামুটি ভাবে এই বৈশিষ্ট্যগুলি থাকলে Disaster বলে ঘোষণা করা হয়, যা ভারতে ফেডারেল স্ট্রাকচারে মেনে চলার কথা! একবার বিপর্যয় ঘোষণা করলে সেই এলাকায় সাহায্য দরকার হয়- বিপুল পরিমাণে যার দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার। দুর্যোগ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরিসংখ্যান বলছে গড়ে একদিন করে যেকোনো রকম দুর্যোগ বা Disaster এ পৃথিবীর কোনও না কোনও প্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আসলে যে জটিল সিস্টেমের মধ্যে পরিবেশের সাথে মানব সভ্যতার
টালমাটাল অবস্থা এসে হাজির হয়েছে তাতে দুর্যোগ অনিবার্য। একথা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই! গ্লোবাল ওয়ারমিং এবং জনঘনত্বের এই ক্রমাগত বৃদ্ধি আরও বেশি করে ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে- ২০০৫ সালে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ১৬২ মিলিয়ন, ২০১০ সালে তা হয় প্রায় ৩৩০ মিলিয়ন।ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৪০% এলাকা ভুমিকম্প প্রবণ, ৬০% জায়গা বন্যা প্লাবিত হয়, ৮ % জায়গা সাইক্লোনে আক্রান্ত হয় ৬৮ % খরা তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়!
যে কোনো বিপর্যয়ে মানসিক স্বাস্থ্য এর প্রধান নিয়ম কি?
শেষ ৫০ বছর ধরে ‘Disaster psychiatry,’’ বলে একটা টার্ম উঠে আসছে- মানে দুর্যোগের সময় মানসিক স্বাস্থ্যের তত্ত্বাবধান যেখানে একজন মনোবিদ বা মনোবিজ্ঞানীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাকে দুর্যোগের সময় কাজে লাগানো হয়।
Paradigm Shifts- প্রথমদিকে দুর্যোগ সামলানো হত শুধুমাত্র রিলিফ(Relief) দিয়ে কিন্তু ধীরে ধীরে দুর্যোগ পরবর্তী প্রোগ্রাম থেকে অনেকবেশি পরিমাণে Preventive Medicine এর নীতি নেওয়া হয়! Prevention is better than cure. এখন যার মূল নীতি।দুই নাম্বার হল আগে যেভাবে রোগ বা Disease এর দিকে বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া হত তার বদলে এখন অনেক বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্য বা হেলথ আজেন্ডা হয়ে উঠেছে। যাকে এখন 6R দিয়ে বর্ণনা করা হয়!
(১)Readiness (প্রস্তুতি পর্ব), (২) Response (তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া), (৩) Relief (পরিত্রাণের কাজ চালানো), (৪) Rehabilitation (অনেকদিন ধরে মেডিকেল চিকিৎসা পাওয়ার পর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ), (৫) Recovery (বিপর্যয়ের পূর্বের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া) এবং (৬) Resilience (কতো দ্রুত একজন আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে তার ক্ষমতা- এটি অনেক কটা বিষয়ের উপর নির্ভর করে)।
দুর্যোগ মূলত দু’ধরনের এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ- ঝড় সাইক্লোন ভুমিকম্প, এইরকম। আর একধরনের হল মানুষের দ্বারা- বিস্ফোরণ, দাবানল, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা। কখনো দুটো কারণ একইসঙ্গে মিশেও থাকতে পারে।
কি কি ধাপের মধ্যে দিয়ে দুর্যোগের এর মধ্যে একজনের মানসিক অবস্থা অতিবাহিত হয়??
(১) Heroic phase- দুর্যোগের পরপরই কিছু লোক ত্রাণ নিয়ে ছোটাছুটি করে,থাকবার জায়গার ব্যবস্থা করে দেয়, তার আশেপাশের লোকজনকে যে কোন উপায়ে বাঁচানোর চেষ্টা করে! তাই একে বীরত্বপূর্ণ বা Heroic phase বলা হয়! মোটামুটি ভাবে এটি প্রথম ১-২ সপ্তাহ থাকে!
(২) Honeymoon phase- তার পরের সময়টা সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন NGO মিডিয়া চলে আসে। বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী, জামাকাপড় দিয়ে তাদের রিলিফ সেন্টার গুলোতে রাখা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রী ও সরকারি বড় অফিসার রা তাদের সাথে এসে কথা বলে তাদের পাশে দাঁড়ায়। জাতীয়স্তরের মিডিয়াতে তাদের কথা ছাপা হয়।সমস্ত সুযোগ সুবিধা তাঁরা পান।
(৩)Disillusionment phase- এরপর ধীরে ধীরে সমস্ত পরিচর্যা গুলো আবছা হতে থাকে। মিডিয়া চ্যানেল গুলো যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়! সরকারি বা বেসরকারি অফিসাররা কম আসতে শুরু করেন। তাই দুর্যোগের নিষ্ঠুর কঠোর রূপ তাদের সামনে আসতে শুরু করে। একটা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পুনর্বাসনের যে স্বপ্ন ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা দেখতে শুরু করেছিলটা ভেঙ্গে পরে (Disillusionment) শুরু হয়ে যায় নিজেদের মধ্যে মারামারি টাকা চুরি দুর্নীতি।সাধারণত তা চলে প্রায় ২মাস থেকে ৩ বছর অবধি।এই সময় অনেকেরই প্রিয় জনকে হারানোর বা প্রিয় জিনিস হারানোর জন্যে বা আর্থিক ক্ষতির জন্য Grief বা শোকে আক্রান্ত হন, বিষাদাছন্ন থাকেন! এক বছর পর পুরনো স্মৃতির দগদগে ক্ষত আবার হুরমুড়িয়ে ফিরে আসে যেন!যাকে Anniversary Reaction বলে। অনেকই আত্মহত্যার এর চেষ্টা করতে পারেন এ সময়! এই সময়পর্বটা জুড়েই মনোবিদ বা মানসিক রোগের ডাক্তারদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবং
(৪)Restoration phase- এর পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া আসেপাশের জায়গার সাথে যোগাযোগ তৈরি হয়ে যাওয়া,
পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়ে গিয়ে পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্যে প্রস্তুতি নেওয়া!
দুর্যোগের মধ্যে একজন মানুষের কি কি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে??
খুব স্বাভাবিকভাবে Grief বা মৃত্যুশোক বিভিন্ন স্টেজ এ দেখা যায়!এখানে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এক অস্বাভাবিক পরিস্থতিতে থাকেন। একজনের যে মানসিক অনুভুতি তৈরি হয়-
(১) প্রিয়জনকে হারানোর পরেও বেঁচে থাকার অপরাধবোধ (Survivor Gulit)
(২) সব কিছু পুনরায় হারিয়ে ফেলার ভয়
(৩) দুশ্চিন্তা, মন খারাপ থাকা, হতাশা চলে আসে
(৪) মাঝে মাঝে রেগে যাওয়া, ক্লান্ত হয়ে পড়া
দুর্যোগের মধ্যে একজন মানুষের কি কি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে??
১৯৫০ সালে Tyhurst প্রথম “disaster syndrome” বলে শব্দটি নিয়ে আসেন। যেখানে দুর্যোগের পরে বেশ খানিকটা সময় ধরে
মানসিক অনুভূতির ওঠানামা, রাগ, হতভম্ব হয়ে থাকা চলে।
(১) অস্বাভাবিক শোক বা বিষাদ!
(২) আত্মহত্যার কথা ভাবা এবং বার বার নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে থাকে
(৩) বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়া- ডিপ্রেশান, Post Traumatic Stress Disorder(PTSD), Panic Disorder তৈরি হতে পারে
(৪) নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি আসক্তি সাধারণ মানুষের তুলনায় দুর্যোগে আক্রান্ত যে কোন মানুষের মানসিক সমস্যা হবার সম্ভাবনা ২-৩ গুণ বেশি। তাই এর Prevalance অনেক টা ৮.৬% থেকে ৫৭.৩%।
মানসিক রোগের দিক থেকে দুর্যোগকে দুভাবে ভাগ করা যায় –
এক, Acute phase প্রথম ৩ মাস। এখানে বেশিরভাগ সমস্যা নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়! শুধুমাত্র পাশে থাকার লোক চাই!
দুই, Long term তিনমাসের পরের সময়। এখানে অনেক মানসিক রোগের আবির্ভাব হয়- যেমন ঘুমের সমস্যা(Insomania), পুরনো মানসিক সমস্যা আবার ফিরে আসা (Relapse বা Recurrence), স্ট্রেস সম্পর্কিত অসুখ, দুশ্চিন্তা, Post Traumatic Stress Disorder, Panic Disorder (PTSD) ট্রমা পরবর্তী স্ট্রেস জনিত অসুখ যেখানে পুরনো স্মৃতি বার বার ফিরে আসে,ভয় দেখায় ফ্ল্যাশব্যাক তৈরি হয় চোখের সামনে। সাধারনত ৩০-৪০% সরাসরি লোক যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের PTSD হতে পারে, ১০-২০ % হতে পারে যারা রিলিফ কাজকর্মের সাথে যুক্ত আছেন।এছাড়া Adjustment Disorder (স্ট্রেসে মানিয়ে না নিতে পারার সমস্যা) Somatoform Disorder (শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা, সিম্পটম নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হয়ে পড়া, কোনও কিছু ব্যাখা করা যায় না এমন শারীরিক সিম্পটোম)।
বাচ্চাদের কি সমস্যা হতে পারে??
নির্দিষ্ট কোন সিম্পটোম নয়- মাথা ঘোরা, বমি বমি পাওয়া, অসংলগ্ন ব্যবহার, খিদে কমে যাওয়া, বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে ওঠা, পড়াশোনা ও শেখার অভ্যেস আগের চেয়ে কমে যাওয়া, স্কুলে যেতে না চাওয়া, খিটখিটে হয়ে যাওয়া, রাগ প্রকাশ করা, মিথ্যে কথা বলা,এগুলো পরবর্তীতে Conduct(সহানুভুতিহীন হয়ে যাওয়া ও সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পরা) এবং Oppositional Defiant Disorder (সমস্ত কথায় অবাধ্য ওঠা) রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে!
কাদের ক্ষেত্রে দুর্যোগের সময় রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি??
Disaster Factor- কতোটা তীব্রতা আছে, কতোটা সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে, কতোজন মারা গেছেন কতক্ষন ধরে দুর্যোগ ছিল এর উপর ভিত্তি করে করা হয়!
Human Factor- পরিবারের মেয়েরা, বাচ্চারা, বয়স্ক ব্যক্তিরা, যারা আগে থেকেই কোন একটা রোগে ভুগছিলেন।
Social Factor- অনেক বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া, যারা আগে থেকেই দুর্বল, সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা।
দুর্যোগ মোকাবিলার প্রধান লক্ষ্য কি??
এক, ক্ষতির পরিমাণ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা!
দুই, খুব দ্রুত এবং দক্ষ রিলিফ টিম তৈরি করা।
তিন, খুব সহজ ও সরল উপায়ে আগের অবস্থায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা!
এখানে Disaster Management কে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি-
(১) Disaster Mitigation- এর ধারনা খুব জরুরি- যাকে বলা হয় পুরোপুরি ভাবে দুর্যোগের
রিস্ক ফ্যাক্টর গুলোকে কমিয়ে আনা! অর্থাৎ এর মধ্যে Risk assessment (কতোটা ক্ষতি এবং কাদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি), Prevention(পরবর্তী আটকানো), Preparedness(প্রস্তুতি নেওয়া)এগুলো পড়ে।
(২) Disaster Response- এর মধ্যে Relief (ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া), Reconstruction আর Rehabilitation। যা মূলত দুর্যোগ পরবর্তী ঘটনা!
মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কি কি করা যেতে পারে??
একজন সচেতন মানুষ হিসেবে বা মনোবিদ এর দিক থেকে দুর্যোগের সময় কী দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ! মূলত (১)প্রস্তুতি পর্ব ও পরিকল্পনা (Preventive ও Planning) (২) রোগ নিরাময়ের জন্যে (Curative) (৩) Stress Management।
(১) প্রাক দুর্যোগের সময় (Pre Disaster Period: Preparedness)- এই প্রস্তুতি পর্বের সময়টা জুড়ে নিজেদের তৈরি করা হয়।
Public Education Activities- বিভিন্ন জিবনশৈলী সেখানো, বিপর্যয়ের সময় বিভিন্ন দক্ষতামূলক কাজ, বিপর্যয় নিয়ে বোঝাপড়া।
Disaster Response Network- বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি বা NGO মিলে একটা নেটওয়ার্ক সিস্টেম বানানো।
Psychoeducation- লোকজনকে দুর্যোগের চরিত্র, প্রকার তীব্রতা নিয়ে বোঝানো।
সর্বোপরি তথ্য (Information), শিক্ষা(Education) and সংযোগ (Communication) যাকে (IEC) বলে তাকে শক্তিশালী করে তোলা! বোঝানো। কোথায় হসপিটাল, বড়ো ঘর, স্টেডিয়াম আছে তা সম্বন্ধে লোকজন কে বলা!
Community Level Training- গ্রুপের মধ্যেই কিভাবে কাউন্সেলিং করতে হবে, মানসিক চাপ কিভাবে সামলাতে হবে, কখন কাকে হসপিটালে পাঠাবো তা নিয়ে আলোচনা করা।
(২) দুর্যোগের সময়(Heroic আর Honeymoon Phase) দুর্যোগ বা দুর্যোগের একটু পরেই একদম Relief Team এর অংশ হিসেবে কাজ করতে হবে! খুব তাড়াতাড়ি লোকজনের সাথে কথা বলে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বুঝে নিতে হবে! কারা কারা নিজেদের প্রিয়জন হারানোর শোকে আছেন, কারা আশাতে আছেন কারা ভয়ে আছেন প্রত্যেকের সাথে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতে হবে। মাস মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে। সামগ্রিক একটা সুস্থ Rehabilitation এর ব্যবস্থার জন্যে প্রশাসনিক জায়গায় যোগাযোগ রাখতে হবে।যারা স্ট্রেস এ আছেন তাদের আলাদা করে Coping Skills শেখাতে হবে।
(৩) দুর্যোগের কিছু সময় পরে (Disillusionment Phase) আগেই লিখেছি এই সময় সবচেয়ে অসুবিধা হয় ক্ষতিগ্রস্ত জায়গার মানুষের মধ্যে। যদি কোন District Mental Health Programme (DMHP) চালু না থাকে তাহলে অবিলম্বে চালু করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকা, আশা কর্মীরা, অঙ্গনওয়ারী কর্মী সবাই মিলে কোন কোন পদ্ধতিতে সাহায্য করতে পারি?? দুর্যোগের পর যাঁরা বেঁচে থাকেন তাঁদের ইমোশানের অনুভূতির ওঠা-নামা খুব বেশি হয়! তাঁদেরকে অনেক সময়তেই হঠকারী সিধান্ত নিতে দেখা যায়! খুব তাড়াতাড়ি যে জিনিস গুলো আমাদের দেখে নেওয়া উচিত তা হল-
(১) নিজের বা অন্যের জীবন ক্ষতি করার কিছু ইচ্ছে আছে কিনা
(২) সময়, আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে বোঝাপড়া ঠিক আছে কিনা
(৩) একদম মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন কিনা
(৪) পরিবারের কেউ মারা গেছেন কিনা
(৫) কোন শারীরিক ক্ষতি হয়েছে কিনা
(৬)পরিবারের কেউ নিখোঁজ কিনা
(৭)আগ থেকে কোনও মানসিক অসুখ ছিল কিনা!
Psychological First Aid- ১৯৮৬ সাল নাগাদ Raphael এই Psychological First Aid এর কথা প্রথম নিয়ে আসে। এর প্রথম উদ্দেশ্য হল একদম তাৎক্ষণিক যে সমস্যা গুলো রয়েছে তা শুনে রোগীকে আরাম দেওয়া।এটি তৈরি হয়েছিল দুর্যোগের সময় সবচেয়ে ভালোভাবে মানুষজনকে যেন পরিত্রাণ দেওয়া যায়!
২০১১ সালে WHO এই Psychological First Aid এর ব্যাপারে কিছু নির্দেশিকা জারি করে-
(১) সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে বাস্তবিক যোগাযোগে আসতে হবে।
(২) আর যাতে কোন আর্থিক বা শারীরিক ক্ষতি না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে!
(৩) পরিবারের লোকজনদের সাহায্য করা এবং একসাথে রাখা!
(৪) পূর্বের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা
(৫) অনুভুতিগুলোকে মান্যতা দেওয়া বা বৈধতা দেওয়া!
(৬) পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে এই আত্মবিশ্বাস টা বজায় রাখা!
(৭) ত্রাণ সামগ্রী এবং কাঁচামালের ধারাবাহিক সরবরাহ রাখা!
(৮) কাদের সাহায্য লাগবে তাদের খুঁজে বের করা এবং রিলিফ সেন্টার থেকে উচ্চ পর্যায়ের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা!
Debriefing- দুর্যোগের প্রায় ২-৩ দিনএর মধ্যে একসাথে অনেক জন বসে আলোচনা করে নেওয়া হয়। নিজেদের কাজগুলো পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া হয়! স্বেচ্ছাকর্মীদের ক্রমাগত উৎসাহ দেওয়া হয় এবং আলাদা ভাবে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের(Stress Debriefing) উপর জোর দেওয়া হয়! আরও গুরুত্বপূর্ণ হল লোকাল কমিটি গুলোকে আরও বেশি মজবুত এবং সক্রিয় করে তোলা। আসলে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় সাহায্য পাঠানো হয় বা লোকজন যায় অন্য এলাকা থেকে তাই অনেক সময়েই কালাচারের সাথে একটা অসঙ্গতি তৈরি হতে পারে তাই যত বেশি সম্ভব লোকাল বা স্থানীয় প্রতিনিধিদের সক্রিয় হয়ে ওঠায় উৎসাহ দিতে হবে।কারন তারাই
আশেপাশের জায়গা অনেক ভালো চিনবেন।
এছাড়াও Cognitive Behavioral Intervention (CBT), Community Intervention,Group Therapy এদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে! কেউ যদি PTSD (Post Traumatic Stress Disorder) তে ভোগেন তাহলে Bisson and Andrew (2007) এঁরা দেখিয়েছেন EMDR(Eye Movement Desensitization Processing ), TFCBT(Trauma Focused Cognitive Behavioural Therapy) এগুলো খুবই কার্যকরী!
ওষুধের দিক দিয়ে খুব একটা প্রয়োজনীয় কিছু নেই! সাধারণত দুর্যোগের ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করার জন্যে ওষুধ এর ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হয় না! তবে খুব বেশি প্যনিক অ্যাটাক, দুশ্চিন্তা হলে কিছু ওষুধ অল্প কয়েদিন ১-২ সপ্তাহের জন্যে খাওয়া যেতে পারে। । কিছু Benzodiazepines(Clonazepam) বিটাব্লকার (Propranolol) কিম্বা অনেকেসময় PTSD এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ওষুধের এর ব্যবহার আছে। যদি কারও আগে থেকেই মানসিক সমস্যা থেকে থাকে, কিম্বা যাঁরা নিয়মিত নেশা করেন তাঁদের ক্ষেত্রে ড্রাগ না নেওয়ার জন্যে Withdrawal সমস্যা হতে পারে। তখন ওষুধ চালু করতে হবে নিয়ম মতো। কিন্তু ওষুধ এর দরকার হলে অবশ্যই
ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে তবেই খাবেন।কিন্তু আগে থেকে(Prophylatic) ওষুধ খেয়ে নেওয়ার কোনও দরকার নেই।
ভবিষ্যতের সমস্যা ও কিছু সাম্প্রতিক প্রশ্ন!
বিজ্ঞানের উন্নতির হাত ধরে সমাজ-পরিবেশে ও মানুষের ক্ষমতা নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে।যেভাবে
সাম্প্রতিক কালে কোভিড-১৯ এর প্রকোপ এক মহামারির আকার ধারণ করেছে- গোটা বিশ্বজুড়েই অসংখ্য মৃত্যু, সামাজিক চরম বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা- তাতে প্রশ্ন উঠে আসছে আমরা কি সত্যিই এই ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম।আজকে একদিকে যেভাবে মহল কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশান-আলাদা হয়ে থাকা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা (Social Distancing) স্কুল ও কলেজ বন্ধ করা- সম্পূর্ণ লকডাউইন করতে আমরা বাধ্য হয়েছি অন্যদিকে এইসব এর জন্যে সামাজিক বন্ধন সংযোগ মানুষের সমষ্টির বোধ নষ্ট হতে শুরু করেছে-সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অবনতিও অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তেমনি মানুষের দ্বারা তৈরি দুর্যোগেরও রূপভেদ পাল্টাচ্ছে রোজ রোজ।সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন বিপর্যয়েই এদের নাম উঠে আসছে বারবার- রাসায়নিক (Chemical) জীবতত্বসংক্রান্ত (Biological) তেজস্ক্রিয়(Radiological) এবং পারমাণবিক (Nuclear agents) যাকে একসাথে (CBRN) বলে।রাজনৈতিক সুবিধার্থে যুদ্ধ এখনও এক দুর্যোগ বয়ে নিয়ে আনে- যেখানে মানবিকতা আর নৈতিকতা রোজ খুন হয় তাকে সঠিক প্রশ্ন করার দরকার আছে।
দুর্যোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য ও তার তত্ত্বাবধানের দিকটি আজ অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠছে। তাই দুর্যোগের সময় বিশেষ করে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে মনোবিদ বা মনোবিজ্ঞানীর ভুমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ! বিভিন্ন নেটওয়ার্ক , রিলিফ টিমের সাথে এদের নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতিকে আরও শক্তিশালী করবে। দুর্যোগ সম্পর্কে সঠিক বোঝাপড়া, মজবুত রিলিফ টিম, এবং দ্রুত উপস্থিতি থাকলে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়।
একদিকে প্রযুক্তির বিকাশ ও মানুষের ক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি দুর্যোগের চরিত্র রোজ চেঞ্জ হতে হতে যাচ্ছে। আজ মানব সভ্যতা উন্নতির নামে প্রকৃতির সাথে যে অসামঞ্জস্য ও ভারসাম্যহীনতার সম্পর্ক তৈরি করেছে তাতে দুর্যোগ বা disaster অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী।
“We cannot STOP Natural Disaster but we can arm ourselves with knowledge, so many life would not have to be lost if there was enough disaster preparedness.” – Petra Nemcova। যদি আমরা সঠিক ভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারি তাহলে হয়তো অনেকেই মারা যাবেন না।। প্রস্তুতি, প্রতিরোধ ও দুর্যোগ পরবর্তী সাহায্য আমাদের সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।এটাই আজকের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।একটা ধারাবাহিক চক্রাকার সাইকেলের মতো সঠিক প্ল্যানিং, নির্মাণ, সংযোগস্থাপন ও বাস্তবায়িত করার সঠিক ইচ্ছে ও লোকবল নিয়ে, দুর্যোগ থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা ও তীব্রতা কমাতে, আমরা অনেকাংশেই সার্থকভাবে সফল হতে পারব।