আন্দাজ দুপুর বারোটা। তিনদিনের জ্বর আর তিনদিনে প্রায় ১৪-১৫ বার খিঁচুনি নিয়ে সাত মাসের বাচ্চাটা যখন ভর্তি হয় তখন প্রায় এই যায় সেই যায় অবস্থা। মুখ ভর্তি হয়ে সাদা ছত্রাকের স্তর। কিছুই খেতে পারছে না। স্যালাইন, ইঞ্জেকশন, খিঁচুনি বন্ধের অনেকগুলো ওষুধ দেওয়ার পর বাচ্চাটা খানিক স্থিতিশীল হ’ল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। আজ দু’দিন বাদে মুখে খাবার দেওয়া শুরু হয়েছে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তিনদিনে প্রায় কিছুই চিকিৎসা হয়নি। খিঁচুনি হলেই মাথায় জল ঢালা হ’ত। জ্বর একটু কমলেই মুখে গুঁজে দেওয়া হ’ত স্থানীয় দোকানের আয়ুর্বেদিক জড়িবুটি!
একইরকম রোগ হলেও পাঁচ বছরের কমলের (নাম পরিবর্তিত) ক্ষেত্রে আর সামাল দেওয়া যায়নি। তখন ঘড়িতে রাত দু’টো। খিঁচুনি হ’তে হ’তে হাত-পা ঠান্ডা, ধমনীর স্পন্দন খুব মৃদু। অর্থাৎ যাকে আমরা শক বলি। রক্তশর্করার মাত্রা কমতে কমতে ২৬! তড়িঘড়ি গলায় নল পরিয়ে আইসিইউতে পাঠানো হয়। রক্তচাপ বাড়ানোর ওষুধ, খিঁচুনি বন্ধের ওষুধ আরও হাজার একটা চিকিৎসা দিয়েও কমলের শারীরিক উন্নতি তো হয়ইনি বরং আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। চোখের মণি আলোয় সাড়া দিচ্ছে না। এখনো হৃৎপিণ্ড ধীরে ধীরে কাজ করছে বটে তবে খুব সম্ভবত… জানি, চিকিৎসকের হেরে যাওয়ার কথা ভাবতে নেই। তবু চিকিৎসকের ষষ্ঠেন্দ্রিয় মৃত্যুর আঁচ পেয়ে যায় অনেক আগেই। এক্ষেত্রে শেষ চারদিনে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা চলেছিল। কেননা ‘উসব এলাপাতি উসুদের বোড্ড সাইড ইফেট!’
রোজ রোজ এসব অবৈজ্ঞানিক বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে ঘেঁটে যাওয়া রোগী দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন’ চিকিৎসা করতে করতে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে এনে হাসপাতাল ভাঙচুর এবং অবধারিতভাবে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ। অথচ সোজা হিসেবে এতদিন যে রোগীর চিকিৎসা বিকল্পধারায় হয়ে এসেছে তার আপৎকালীন চিকিৎসাটাও সেই পদ্ধতিতেই হওয়া উচিত। আমার কাছে আউটডোরে বা চেম্বারে দেখিয়ে যাওয়া কোনও রোগীর বাড়াবাড়ি কিছু হ’লে সেটা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব তো আমার ওপরেই বর্তাবে। আমি কাজের জায়গায় উপযুক্ত পরিকাঠামো না পেলে সে সুবিধে আছে এমন জায়গায় রেফার করবো কিন্তু কখনোই সেটা মডার্ন মেডিসিন ছাড়া অন্য ধারায় হবে না। অথচ, বিকল্পধারায় ইমার্জেন্সি চিকিৎসার কথা আমরা কেউই প্রায় শুনে উঠতে পারিনি। কী সেই কারণ? বিকল্পধারার ওষুধ শুধু বেছে বেছে দীর্ঘদিনের রোগগুলিতে কাজ করে? আসলে কারণ আর কিছুই নয়। দীর্ঘদিনের রোগগুলির বেশিরভাগই বিষহীন সাপের কামড়ের মতো। সেখানে ওঝার ফুঁক দিন, শিমুল তুলো পুড়িয়ে ধোঁওয়া দিন, কড়ি বাজিয়ে শোনান বা বিকল্পধারার ওষুধ খাওয়ান সবেতেই কাজ হচ্ছে বলে মনে হবে। অথচ রোগগুলির নাম যদি টিবি, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, অগুনতি ক্যান্সার, সেপ্টিসেমিয়া, মেনিনজাইটিস, স্ক্রাব টাইফাস, খিঁচুনির রোগ, ছানি, গ্লকোমা, স্টিভেন্স-জনসন সিন্ড্রোম, হার্ট ফেলিওর, বাড়াবাড়ি হাঁপানি, মারাত্মক সুগার বা প্রেশার (আরও কয়েক কোটি নাম বলা যায়) ইত্যাদি হয় তখন বিকল্প ধারা ভোকাট্টা। আসলে আপৎকালীন চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতির সোজাসুজি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। অপারেশন লাগবে এমন রোগগুলির কথা বাদই দিলাম। যদিও বিকল্প ধারার প্রথাগত ডিগ্রির শেষে ‘এস’ অর্থাৎ ‘সার্জারি’ জুড়ে দেওয়া আছে। এত অসংখ্য মহামারী রোধ, টিকাদানের মাধ্যমে এত রোগ আর মৃত্যু ঠেকিয়ে দেওয়া, রোগ ডায়াগনোসিস করার এত অজস্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা তার কোত্থাও বিকল্পধারার চিহ্নমাত্র নেই। এদেশে বিকল্পধারা আইনত বৈধ অথচ বিভিন্ন রোগের সরকারি কার্যক্রমেই কোথাও বিকল্পধারার ওষুধের নাম পাওয়া যায় না। যাঁরা পাঁচমুখে জড়িবুটি আর চিনির গোল্লার প্রচার করেন বেগতিক দেখলে তাঁরা সেই মডার্ন মেডিসিনেরই দ্বারস্থ হন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এসব অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি হয় একেবারেই নেই বা থাকলেও অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় দেখতে হয়। তাহলে এগুলো কাদের জন্য? মূলত গ্রামের গরীবগুর্বো মানুষ এসব সরল বিশ্বাসে ব্যবহার করেন। তাঁদের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব অথচ তা না করে চিনির দানা আর জড়িবুটিতে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা! এসব বিকল্পধারার ওষুধের প্রায় কোনওটিরই স্বপক্ষে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই। অশুদ্ধি হিসেবে স্টেরয়েড বা অন্যান্য রাসায়নিক মেশানোর অভিযোগও বহু পুরোনো। করোনাকালেও আর্সেনিকাম অ্যালবাম, করোনিল, জড়িবুটি ক্কাথ ইত্যাদি বিভিন্ন অযৌক্তিক জিনিস আমদানি করে তাঁরা প্রচারের আলোয় ভেসে উঠতে চেয়েছেন। প্রথমে অনেকেই হামলে পড়ে ভাতের বদলে সেসব খেয়েছেন। আজ বছর পেরিয়ে সেসবের ফলাফল সবারই জানা।
আয়ুর্বেদিক ক্কাথ বা অন্যান্য সব জড়িবুটি মিথ্যে প্রমাণ হওয়ার পর বিভিন্ন বাবারা কিছুদিন মুষড়ে ছিলেন। এখন নতুন করে তাঁরা জ্বলে উঠতে চাইছেন। রামদেব বাবা এবং তাঁর সঙ্গী শ্রীমান বালকৃষ্ণবাবু মডার্ন মেডিসিনের নামে বিষোদগার শুরু করেছেন। এককথায় তাঁদের দাবী মডার্ন মেডিসিন একটি অত্যন্ত জঘন্য পদ্ধতি। অথচ দুজনেই কিছুদিন আগেই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন (ভবিষ্যতেও হবেন আশা রাখি)। চিকিৎসা-বিজ্ঞান এমন একটা জিনিস যেটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া অসম্ভব। সেখানে একজন মানুষ যাঁর কিনা চিকিৎসা বিজ্ঞান ছাড়ুন কোনও ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই নেই তাঁর কথা ঠিক কতখানি গুরুত্ব রাখে? যদিও আমাদের দুর্ভাগ্য, খুব সম্ভবত এখনো যুক্তির থেকে গোমূত্রের জোর বেশি। বালকৃষ্ণবাবু একধাপ এগিয়ে দাবী করেছেন, সব আসলে দেশের মানুষকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার চক্রান্ত। মডার্ন মেডিসিন পশ্চিমী সভ্যতার অভিশাপ কিনা!
এতক্ষণে হয়তো অনেকের মনের মধ্যেই গুড়গুড় করে উঠছে- করোনাকালে এত মডার্ন মেডিসিনেও তো কাজ করার দাবী উঠলো আবার মিইয়েও গেল। তাহলে তফাতটা কোথায়? তফাতটা এটাই, এক্ষেত্রে বদলে ফেলার দাবীটাও সিস্টেমের ভেতর থেকেই আসে। মনে রাখতে হবে, সময়টা মহামারী বলেই অল্প প্রাথমিক প্রমাণ পেলেই কিছু কিছু ওষুধকে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আবার ব্যবহারের পর উপযুক্ত সাফল্য না পাওয়া গেলে সিস্টেমের ভেতর থেকেই প্রত্যাহার করা হচ্ছে। কোথাও সেসব ওষুধ সাধারণকে মুড়ি-মুড়কির মতো খেয়ে ফেলার উপদেশ দেওয়া হয়নি। আপনি নিজের ইচ্ছেমতো প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া ওষুধ খেয়ে গেলে সে দোষ সম্পূর্ণভাবে আপনার। মডার্ন মেডিসিনে একটা নতুন ওষুধ বাজারে আসতে অনেকগুলো কঠিন ধাপ অতিক্রম করতে হয়। অনেক বছরের ব্যাপার। প্রতিটি ধাপে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ দিতে হয়। স্বপ্নে পাওয়া ওষুধের মতো জড়িবুটি আর গোমূত্র ঘেঁটে ক্কাথ বানিয়ে বোকা বানানো আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার যুগে অসম্ভব।
রোগজর্জর মারীর দেশ বিজ্ঞানসম্মত সমাধান চায়। আর বিজ্ঞানের আলো থেকে বহুদূরে কিছু প্রাগৈতিহাসিক সুবিধেবাদী মহামারীজনিত অসহায়তার সুযোগ নিতে চায়। মাথায় রাখুন, করোনার ভাইরাস মেরে ফেলার কোনও ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। চিকিৎসা সিম্পটোম্যাটিক। অর্থাৎ, উপসর্গগুলোর উপশম এবং রোগের জটিলতা রোধ। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই সামান্য ওষুধে কোনও সমস্যা ছাড়াই রোগ সেরে যাবে। সেসব ক্ষেত্রে ‘ওঝার ফুঁক’ হয়ে উঠতে চাইছে এসব অবৈজ্ঞানিক ওষুধ। এ এমন এক দেশ যেখানে গরীব মানুষ দু’বেলা বাচ্চাকে ডিম-সব্জি কিনে খাওয়াতে পারে না। অথচ, বিজ্ঞাপনের মোহে ভুলে কপর্দকহীন হয়েও হরলিক্স-কমপ্লান কিনে দিতে চায়। কোভিডকালে দিশেহারা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে সেই ব্যবসার ফাঁদটাই পাততে চাইছে বিকল্পধারার বাবারা। পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জয়যাত্রার কাল জুড়ে কোথাও বিকল্পধারার কণামাত্র ভূমিকা নেই। স্বাধীনতার সময়েও বহাল তবিয়তে ছিল সব ধরনের বিকল্প চিকিৎসাধারা। অথচ মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩২ বছর। আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার সামগ্রিক মানোন্নয়নের একটা ভূমিকা থাকে ঠিকই কিন্তু মূল তফাতটা গড়ে দিয়েছে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানই। মানুষের অসহায়তার সুযোগে অপবিজ্ঞান, অশিক্ষা আর ধর্মীয় সুড়সুড়ির ক্কাথ খাইয়ে সে সত্যকে ঢাকা দেওয়া যায় না।