আমরা অনেক সময় এমন অনেককে দেখতে পাই যাঁদের নাকি ভূতে ধরেছে বা যাঁদের ওপর ভূত ভর করে নানান কাজ করাচ্ছে। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কখনোই ভূতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা তো এখনো সমাজের সর্বস্তরে প্রসারিত হয় নি। তাই অনেক তথাকথিত ভৌতিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকলেও তা সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় নি। মনোবিদ্যার পরিভাষায় এই জাতীয় ভূতে ধরা বা ভর করার ঘটনার নাম হল “ডিসোসিয়েটিভ ট্রান্স এন্ড পোসেশন ডিসঅর্ডার”
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলি একটি বিশেষ ধরনের মানসিক রোগের নাম হল “ডিসোসিয়েটিভ ও কনভার্শন ডিসঅর্ডার”।
“ডিসোসিয়েটিভ ও কনভার্শন ডিসঅর্ডার” হল এমন একধরণের মানসিক রোগ যেখানে রোগী নিজের ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য, স্মৃতি, অনুভূতি, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।এই রোগ আগেকার দিনে ব্যবহৃত “হিস্টিরিয়া” রোগের একটি প্রকারভেদ। এই জাতীয় রোগ মূলত মহিলাদের মধ্যে দেখা যেত এবং সেই সময় মনে করা হত এই রোগগুলির উৎপত্তির পিছনে জরায়ুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জরায়ুর গ্রিক প্রতিশব্দ “হিস্টেরা” থেকে “হিস্টিরিয়া” নামটির উৎপত্তি হল।
“ডিসোসিয়েটিভ ও কনভার্শন ডিসঅর্ডার” নামক মূল রোগটির অনেক প্রকারভেদ আছে। যেমন “মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার” বা “বহুব্যক্তিত্ব” রোগে রোগী কিছু সময়ের জন্য নিজের ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য ও স্মৃতি হারিয়ে সম্পূর্ণ অন্য মানুষে পরিণত হন। রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ডঃ জেকিল ও মিস্টার হাইডের গল্পটিতে এই রোগটিরই বর্ণনা আছে।
আবার আমাদের গ্রামবাংলার ভর হওয়া, ভূতে পাওয়া ব্যাপারগুলির পোশাকি নাম “ডিসোসিয়েটিভ ট্রান্স এন্ড পোসেশন ডিসঅর্ডার”। এক্ষেত্রে রোগী উত্তেজিত হয়ে এমন আচরণ করেন যে মনে হয় রোগীর শরীরে যেন অন্য কোন অশরীরী ঢুকে পড়েছেন এবং রোগীকে দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে নিচ্ছেন।
অনেক রোগীর আবার খিঁচুনির মত উপসর্গ দেখা যায়।
এছাড়া এই জাতীয় রোগ হলে মানসিক চাপের প্রভাবে রোগী হঠাৎ করে কানে শোনা,চোখে দেখার অনুভূতি হারিয়ে ফেলতে পারেন, জীবনের কিছু সময়ের কথা আংশিক বা সম্পূর্ণ ভুলে যেতে পারেন, নিজের হাত-পায়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারেন, ফুসফুসের কোন সমস্যা ছাড়াই শ্বাসের কষ্ট হতে পারে, কথা বলতে বা ঢোঁক গিলতেও সমস্যা হতে পারে ইত্যাদি।
সাধারণভাবে যেটাকে খিঁচুনি মনে হয় সেটা দুরকম হতে পারে-আসল খিঁচুনি বা মানসিক চাপের কারণে হওয়া খিঁচুনি। খিঁচুনির ধারণ দেখে (যেমন খিঁচুনি কতক্ষণ ধরে, কোন কোন জায়গা জুড়ে হচ্ছে, খিঁচুনির সময় জিভ কেটে গিয়েছে কিনা বা অসাড়ে প্রস্বাব হয়ে যায় কিনা?) এবং কিছু পরীক্ষা করে (যেমন ই ই জি, সিটি স্ক্যান) পার্থক্য করা হয়।
মানসিক কারণে হওয়া খিঁচুনি একধরণের কনভার্শন ডিসঅর্ডার।চিকিৎসক নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আসল রোগটি খুঁজে বার করেন।
স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে এই রোগগুলির কারণ কী? এ বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ উপযুক্ত মাত্রায় থাকলে আমরা বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়াগুলিকে সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে পারি। কোন ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা বা মানসিক আঘাত মস্তিষ্কের মধ্যে রাসায়নিকগুলির এই ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে এবং এর ফলে নানান মানসিক সমস্যা দেখা যায়।
অনেক সময় সামাজিক বা নানান চাপের কারণে আমরা আমাদের মনের দুঃখ বা ইচ্ছাগুলিকে সরাসরি বলতে পারি না ।কিন্তু সেগুলি আমাদের অবচেতন মনে থেকে যায়। এই জাতীয় ভর হওয়া বা ভূতে পাওয়ার ঘটনা ঘটলে সেই চেপে রাখা কথা গুলি পরিবার বা সমাজের সামনে প্রকাশ করা যায়।
এর পর আসি এই জাতীয় রোগের চিকিৎসা প্রসঙ্গে। যেহেতু এই সমস্যাগুলি এক রকমের মানসিক রোগ তাই অযথা সময় নষ্ট না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। অনেক সময় আত্মীয় -স্বজনেরা অতিরিক্ত চিন্তা করে এবং রোগীর অতিরিক্ত যত্ন নিতে গিয়ে রোগীর রোগ বাড়িয়ে দেন। যেমন দেখবেন যখন অনেক লোকজন রোগীকে ঘিরে থাকেন তখন যেন রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই রোগীর কাছে অহেতুক ভিড় না বাড়ানোই ভাল।আবার অনেকে রোগীকে এই বলে দোষারোপ করেন যে রোগী ইচ্ছে করে এই সব নাটক করছে। এটিও সত্যি নয়। বরং এতে রোগীর মানসিক চাপ বাড়ে এবং রোগটি বেড়ে যেতে পারে। এই রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট ও এন্টি -এংজাইটি ওষুধ ও কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন পড়ে।
সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী চললে সহজেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।