“Aged? But he does not appear aged, just look his hair has remained young!” Lost Time’, Marcel Proust.
চুল নিয়ে মানুষের সমস্যা চিরকালীন। প্রাচীন মিশরে ফারাও ও তার রানিরা আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই পরচুলা ব্যবহার করতেন। কেউ কেউ বলেন প্রচন্ড গরম থেকে রক্ষা পেতেই তারা মাথা কামিয়ে পরচুলা পরতেন। ইউরোপে সপ্তদশ শতকে ত্রয়োদশ লুই প্রথম পরচুলা ব্যবহার করা শুরু করেন। খুব অল্প বয়সে তার মাথায় টাক পড়ে গেছিল। ফ্রান্সে একে বলা হত ‘পেরুক’। ব্রিটিশরা বলতেন ‘পেরিউইগ’। অভিজাত পরিবার ও রাজ পরিবারে এই ধরণের পরচুলা পরার চল ছিল। রানি প্রথম এলিজাবেথ পরচুলা পড়তেন। জজ, ব্যারিস্টারদের মধ্যে তো এখনও অনেক জায়গায় পরচুলা পরার চল আছে।
আমাদের প্রাচ্য দেশের মধ্যে জাপান ও চিনাদের উচ্চবিত্তদের মধ্যে পরচুলা পড়ার চল এখনো আছে। মুরাকামির বইয়ে পড়েছি জাপানে যেসব বিরাট উইগ কোম্পানি আছে তাদের চুল নাকি আসে ইন্দোনেশিয়ার মেয়েদের মাথা থেকে। ওরা বিয়ের যৌতুক সংগ্রহ করতে নিজেদের চুল বিক্রি করে দেয়। আজ বাজারে নানান উন্নত ধরনের পরচুলা এসে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বাইরে থেকে দেখে তাদের বোঝারই উপায় নেই। কিন্তু তবু পরচুলা তো পরচুলাই! আসল চুল! নিজের চুল! স্থায়ী চুল! কয়েক বছর আগে পর্যন্তও এটা ছিল সোনার পাথরবাটির মত ব্যাপার।
একজন মানুষের চুল নিয়ে যতরকম সমস্যা থাকতে পারে আমার যুবক বয়স থেকে সবকিছুই ছিল। ক্লাস এইট থেকে মাথার চুল পাকা শুরু হয়েছিল। তার কিছুদিন পর থেকে শুরু হল চুল উঠে যাওয়া। সেই পতনের স্রোত এত তীব্র হয়ে উঠল যে আমি কিছুতেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য অনেক যুবকের মত আমিও চুল নিয়ে আমার ধারাবাহিক অবসাদের জগতে পাকাপাকিভাবে ঢুকে পড়লাম। নিজেকে অনেকবার বুঝিয়েছি, ধুর ওসব নিয়ে ভেবে কী হবে? মহামতি সেক্সপীয়রই তো বলে গেছেন, “দেয়ার ইজ নো টাইম ফর অ্যা ম্যান টু রিকভার হিজ হেয়ার দ্যাট গো বল্ড বাই নেচার।” (যদিও ‘পেরিউইগ’ থেকে এখন প্রচলিত ‘উইগ’ শব্দটি নাকি তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন)। তবু মন তো মানে না। প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়াতে হয়। দাড়ি কাটতে হয়। মাথার সামনের দিকে দ্রুত পাতলা হয়ে আসা হেয়ারলাইন দেখে প্রতিদিন সকালেই মন খারাপ হয়ে যায়। পৌরুষত্ব কমতে থাকে। টের পাই।
এটা খুব সত্যি কথা যে মেয়েদের থেকে ছেলেরাই চুল পড়ার সমস্যায় বেশি ভোগেন। হ্যারি পটারের রচয়িতা রাউলিং যেমন রসিকতার ছলে বলেছেন, ‘একজন মেয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবে আজ পার্টিতে কোন গাউনটা পরে যাব। আর একজন ছেলে ভাবে আজ আমার মাথা থেকে সারাদিন ক’টা চুল উঠবে’! ছেলেদের এই চুল ওঠার জন্য দায়ি যে হরমোন তার নাম টেস্টোস্টেরন। যে হরমোন তার পুরুষালি বৈশিষ্ট নিয়ন্ত্রণ করে সেই হরমোনই তার মাথার সামনের, মাঝখানের চুল হাপিস করে দেয়। সঠিকভাবে অবশ্য বলতে গেলে এই টেস্টোস্টেরন আরেক উৎসেচকের প্রভাবে ডাই হাইড্রো টেস্টোস্টেরনে(ডি এইচ টি)পরিবর্তিত হয়। এটিই চুল ঝরিয়ে দেবার জন্য প্রধান দায়ি।
আপনারা বলতে পারেন, এই হরমোন তো সব ছেলেদেরই আছে। সবার তো চুল উঠছে না? আসলে এই হরমোনের প্রভাবে কার কতটা চুল উঠবে তা জিন নিয়ন্ত্রিত। তাই যাদের পরিবারে বাবা-কাকা-দাদুর টাক আছে তাদের টাক পড়ার সম্ভাবনা অন্যদের থেকে অনেক বেশি। ঘটনাচক্রে আমি সেই ভাগ্যবানদের দলে পড়ি। এই চুল পরার সাথে বাহ্যিক সৌন্দর্যের এতটা হানি হয় যে বাজারে নানান তেল আর শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের কোনো অভাব নেই। কিন্তু সত্যি কথা হল, এদের কোনোটাই নতুন চুল গজাতে ছিটেফোঁটাও সাহায্য করে না। অনেক লোক এদের চক্করে বহু অর্থ নষ্ট করেছেন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি।
গ্ল্যাক্সো কোম্পানির মাথায় খুসকির জন্য একটি ভালো শ্যাম্পু আছে তার নাম ‘নিজ্রাল’। এই কোম্পানির প্রধান এক বিজ্ঞানীকে এক সেমিনারে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘আপনি সবাইকে কোন শ্যাম্পু ব্যবহার করার পরামর্শ দেবেন’? তার মাথা ভর্তি চুল। পনিটেল। তিনি বললেন, ‘সপ্তাহে দুদিন যে কোনো শ্যাম্পু। এই ধরুন হেড অ্যান্ড শোলডার’। সবাই শুনে তাজ্জব হয়ে গেল। গ্ল্যাক্সো কোম্পানি তাকে এত টাকা বেতন দিয়ে রেখেছে আর তিনি নাকি এই কথা বললেন। আসলে তার বলার উদ্দেশ্য ছিল শ্যাম্পু শুধু মাথার তৈলাক্তভাব কমাতে পারে। এছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। এটা নতুন চুল গজাতে কোনোভাবেই সাহায্য করে না। যদিও খুসকি থেকে মাথার চুল পড়ে গেলে আপনাকে মেডিকেটেড শ্যাম্পু ব্যবহার করতেই হবে। সেটা আলাদা ব্যাপার।
অনেক ফিল্মস্টার, খেলোয়াড় এদের আগের সাথে পরের ছবি দেখলে চিনতেই পারি না। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সলমন খান আর আমাদের দাদা সৌরভ গাঙ্গুলিকে। পরে জানলাম তারা দুজনেই হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করিয়েছেন। সলমন তো একাধিকবার। আমির খানের যুবক যুবক চেহারা, গৌতম গম্ভীরের সামনের ঢেউ, ঋত্বিক রোশনের চেহারায় গ্রিক দেবতার আভাস আবার ফিরে আসা, অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগনের সামনের দিকের বদলে যাওয়া হেয়ারলাইন, শেন ওয়ার্ন, জ্যাক কালিস, মাইকেল ভন, ইউসুফ পাঠান, হার্দিক পান্ডিয়া, সেহবাগ থেকে শুরু করে বিরাট কোহালি ও সর্বশেষে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি সকলেই হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করিয়েছেন। আরো কত যে করিয়েছেন তাদের নাম না হয় নাই বললাম।
এসব যখন জানলাম, যখন তাদের চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম তখন মনে ভাবনা হল আমিও করালে কেমন হয়? কিন্তু এই অপারেশন যেহেতু গল ব্লাডার বা অ্যাপেন্ডিক্স নয় তাই তা এমারজেন্সি কিছু নয়। সেই কারণে বাড়িতে জানালে তুলকালাম লেগে যাবে। তারপর আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে যেখানে বেঁচে থাকাই অনেক সেখানে হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট-এর কথা মনে আসাটাই একটা বিপত্তি। তাই ঠিক করলাম করাই বা না করাই বাড়িতে ব্যাপারটা বেমালুম চেপে যাব। অন্তত যতদিন না অপারেশন করাচ্ছি।
তারপর প্রশ্ন এল কোথা থেকে করাব? আমাদের কলকাতায় হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্টের কথা বললে, বা নেটে সার্চ করলে একজনের কথাই সবার প্রথমে আসে। নানা জায়গায় কত খরচ সেই ব্যাপারে খোঁজ নিলাম। খরচ নেহাত কম নয়। তারপর এর জন্য মেডিক্লেম পাওয়া যায় না। তাই পুরোটাই ট্যাঁকের পয়সা দিয়ে করাতে হবে। এই কারণে প্রথম প্রথম একটু পিছিয়ে গেলাম। কিন্তু কয়েকদিন বাদেই আবার সেই ঢেউখেলানো স্বপ্ন এসে বিভ্রান্ত করে দিল। সত্যিই কি হতে পারে? সত্যিই কি আমার আগের হেয়ারলাইন কিছুটা হলেও আমি ফিরে পেতে পারি? আমার নিজেরই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
একদিন হঠাৎ করেই আমার কলেজের দাদা, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে আমার কলিগ ডক্টর বিক্রম সিং রাঠোরকে ফোন করলাম। দাদা এখন সরকারি চাকরি ছেড়ে শুধুই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে। দাদা বলল, যে কোনো দিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে চলে আসতে। আমি ফোনে বুক করে একদিন চলেই গেলাম। দাদার ‘কায়াকল্প কসমেটিক অ্যান্ড লেসার সার্জারি ক্লিনিক’ কাঁকুড়গাছিতে। সকাল সকাল চলে গেলাম। তখন সবে কলকাতার ওপর দিয়ে কোভিডের ফার্স্ট ওয়েভ চলে গেছে। তাই ক্লিনিকে অনেক বিধিনিষেধ। দাদা অনেকক্ষণ কথা বলল। আমাদের পুরনো কলেজের কথা হল। ব্ল্যাক টি খেলাম। তারপর দেখে বলল, আমার গ্রেড টু বল্ডনেস। হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করলে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেকটাই।
দাদা আমাকে বোঝালো যে দুরকম সার্জারি হয়। একটাকে বলে FUT বা ফলিকুলার ইউনিট ট্র্যান্সপ্লান্ট অন্যটিকে বলে FUE বা ফলিকুলার ইউনিট এক্সট্র্যাকশন। প্রথমটিই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড সার্জারি। তাতে মাথার পেছনে কানের নীচ থেকে একটি লম্বা আয়তাকার অংশ কেটে নিয়ে তাতে যে হেয়ার ফলিকলগুলো আছে তাকে জায়গামত প্রতিস্থাপিত করা হয়। অন্যটিতে মাথার পেছন থেকে হেয়ার ফলিকল বিশেষ যন্ত্র দিয়ে তুলে নিয়ে লাগানো হয়। প্রথমটিতেই সাফল্যের হার অনেক বেশি। আমিও রাজি হলাম যে আমি এফ ইউ টি-ই করাবো। এক্ষেত্রে মাথা নেড়া হলে মাথার পেছনে লম্বা একটা কাটা দাগ অবিশ্যি সারাজীবন দেখা যাবে। সে যাক আমি তো আর মাথা নেড়া করতে আসি নি। চুল লাগাতে এসেছি।
আপনাদের মনে হতে পারে মাথার পেছনের দিকের চুল কেন? আসলে দেখবেন যিনি একদম নেড়া তারও মাথার পেছনে চুল থাকে। আসলে আমাদের মাথার পেছনের দিকের চুলগুলো ‘ডি এইচ টি’ রেসিস্ট্যান্ট। এদের ওপর সেই হরমোনের কোনো কাজ নেই। তাই তারা সহজে ঝরে পড়ে না। সেই কারণে সেই চুলগুলো লাগালে তারা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু আমার নিজের চুলই আমি লাগাচ্ছি তাই এরা ‘অটোলোগাস গ্র্যাফট’। সেই কারণে এদের গ্র্যাফট রিজেকশন কম হয়। আমার আর তর সইছিল না। তারপর আবার কবে কোভিড চলে আসে। তাই আমি ঠিক করলাম দুদিন বাদেই করাব। সেদিনই কোভিডের ‘আর টি পি সি আর’ আর অন্যান্য ব্লাড টেস্ট করতে দিলাম। রিপোর্ট রাতেই পেয়ে গেলাম যে সব ঠিকঠাক আছে। তার একদিন পরে বাড়িতে বললাম যে কলকাতায় পরীক্ষা নিতে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে। ৩ ডিসেম্বর সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে কাঁকুড়গাছির দিকে রওনা হলাম।
(চলবে)