টেলিভিশনের খবরে বলছে, “বিস্ফোরণের পিছনে ডি কোম্পানি। ডি মানে দাউদ নয়, ডাক্তার।” টেলি-সাংবাদিক বেশ রসিয়ে বলছেন আর আমি সীতার মতো “ধরণী দ্বিধা হও” বলে পাতাল প্রবেশ করে মুখ লুকোনোর তাল খুঁজছি। মনে হচ্ছে, মুখ দেখাবো কী করে? অবশ্য এই প্রথম নয়। আর জি কর কাণ্ডের সময়েও আমরা কিছু চিকিৎসকের কুকীর্তি অনুমান করেছিলাম এবং তখনও এই অনুভূতি হয়েছিল৷ তাবড় রাজনেতারা ভয় দেখিয়ে ডাক্তারদের দিয়ে নিজেদের অপকর্মের ঢাল তৈরি করিয়ে আমাদের মাঝেমধ্যে এরকম পরিস্থিতিতে ফেলে দেন। তবু সন্ত্রাসী হিসেবে একদল চিকিৎসকের চিহ্নিত হওয়া একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। মহান সাংবাদিকের বচনামৃত কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে।
পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের পর গর্ব করে ছবি পোস্ট করেছিলাম, যেখানে ভারতীয় কাশ্মিরী চিকিৎসকেরা (অধিকাংশ বা সবাই সম্ভবত ধর্মে মুসলমান) আহতদের বাঁচানোর জন্য লড়ে যাচ্ছিলেন বীরবিক্রমে। পাকিস্তানি নাশকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে তাঁরাও ছিলেন সৈনিক। চিকিৎসক গর্ব করে ‘শোলে’ সিনেমার ডায়লগ বদলে নিয়ে বলেছিলাম, “তুম এক মারোগে, হম চার বাচায়েঙ্গে।” সেই অহংকার চুরমার হল।
আসলে ‘উগ্রপন্থা’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর অর্থ আর চরিত্রে তফাত আছে। উগ্রপন্থা মানে militancy, যার মধ্যে একটা সম্মুখ সমরের তেজ এবং সৎসাহস আছে। সন্ত্রাসবাদের সেসব বালাই নেই। সাধারণ মানুষের মনে ‘terror’ তৈরি করাই তার লক্ষ্য। সেটাই তার সাফল্য। Unpredictability তার হাতিয়ার। তার পদ্ধতি যা ইচ্ছে হতে পারে এবং যুদ্ধের নৈতিকতা সেখানে অপ্রাসঙ্গিক। মানুষকে ত্রস্ত করার একটা বড় উপায় হল গভীরে প্রোথিত বিশ্বাসগুলোর ভিত নাড়িয়ে দেওয়া। যেসব বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষ সহজে বেঁচে থাকে, সেগুলোকে ধ্বংস করা। সিনেমাহল, বাজার, পার্ক, কোনোকিছুকেই এক মুহূর্ত নিরাপদ ভাবতে পারবেন না, এটাই হল ত্রাস। “ডাক্তার ইচ্ছে করে আমাকে মারবে না,” এই বিশ্বাসটাকেও শেষ করে দেওয়া হয়ত এবারের অন্যতম লক্ষ্য।
পহেলগাঁও কাণ্ডে ধর্ম জিজ্ঞেস করে মারার একটা বড় উদ্দেশ্য সম্ভবত ছিল ভারতে হিন্দু-মুসলমান রায়ট লাগানো, ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বড়সড় আভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্টি করা। সৌভাগ্যক্রমে আমরা সেই ফাঁদ এড়াতে পেরেছি। যে দলটিকে আমরা সবসময় সাম্প্রদায়িক কারণে গালি দিই, সেই ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ নেতারা অন্তত সেই সময়ে সংযত আচরণ করে বড় মাপের দাঙ্গা এড়াতে সাহায্য করেছিলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এবার হয়ত আরও গভীরভাবে এবং কৌশলে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিশ্বাস নষ্ট করার চেষ্টা হল বা হচ্ছে। সব ভারতবাসীর দায় দেশের ফ্যাব্রিক ছিঁড়ে দেবার এসব ছক বাঞ্চাল করা। অবশ্যই সেকুলার মনস্ক মানুষের দায়িত্ব গুরুতর। সেই দায়িত্ববোধ থেকে কেউ কেউ এমন কথাও বলে ফেলবেন বা বলার আভাস দিচ্ছেন যে অভিযুক্তেরা দোষী নাও হতে পারে। কিন্তু সরল মনে এই অভিযুক্তদের পক্ষে কোনো কথা বলে ফেলার আগে দুটো জিনিস ভেবে দেখা দরকার।
প্রথমত এরা কোনো অবদমনকারী শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-টুদ্ধ করছে না। শাসকের নজরদারি এড়িয়ে (বা তাদের সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে) সাধারণ মানুষকে সন্ত্রস্ত করতে চাইছে।
দ্বিতীয়ত, এরা কাদের স্থায়ী ক্ষতি করছে (নিহত আর আহতদের বাদ দিয়ে)? আমি হিন্দু বলে হয়ত কাল আবার দেশের মধ্যে মোটামুটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ডাক্তারি করতে পারব কিন্তু দিল্লি, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ বা অন্য কোনো প্রদেশে যে মুসলমান ছেলেটি বা মেয়েটি মানুষ বাঁচাবে বলে মন দিয়ে ডাক্তারি পড়ে পাস করেছে এবং সারাদিন সেই উদ্দেশ্যেই পরিশ্রম করে, তার কী হবে? তার কী ক্ষতি করল এই কটা লোক, সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়। সুতরাং সংখ্যালঘু কার্ডটা কুচক্রীদের স্বার্থে ভুলক্রমেও ব্যবহার করে ফেলাটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়, কারণ সমস্ত সলিডারিটি প্রাপ্য কেবল সংখ্যালঘু (বা যেকোনো) সম্প্রদায়ের সেইসব মানুষদের, যাঁরা সৎ, সুস্থ জীবনযাপন করেন, সৎভাবে নিজের কাজ করেন। মহান কিছু হবার প্রয়োজন নেই, আমার-আপনার মতো আটপৌরে, ছাপোষা, স্বাভাবিক মানুষ যাঁরা। তাঁরাই অধিকাংশ কিন্তু এই অল্পাংশ কুচক্রীদের তৈরি করা অবিশ্বাসের অভিঘাত সহ্য করতে হয় তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি। এবং এই অবিশ্বাস সৃষ্টি করা সন্ত্রাসবাদের একটা অন্যতম উদ্দেশ্যও বটে। যেকোনো অমানবিক মানুষ, বিশেষত সন্ত্রাসবাদী, তার নিজের পেশা, দেশ বা ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। এটা মনে রাখা প্রয়োজন। এদের কাজকে জাস্টিফাই করা প্রকারান্তরে এদের পেশার বা সম্প্রদায়ের সৎ মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাও বটে।










