বাঙালরা কেন জানি না কিছু কিছু হিন্দি শব্দ ব্যবহার করে তাদের ভাষায়। চুলকায় বোঝাতে বলে খাউZলায়। কাককে বলে কাউয়া। কুকুরকে বলে কুত্তা। ভাষাবিদরা জানবেন কেন এমনটি হয়। জলকে পানি কিম্বা চানকে গোসল বলার মধ্যে যে ধর্মীয় প্রভাব বা অন্য ভাষার প্রভাব ইত্যাদি রয়েছে তার মত নয় ব্যাপারটা। আমার ছোটবেলায় এই ব্যাপারটা খুব লক্ষ্য করেছি।
পঁয়ষট্টি সালে তাড়া খেয়ে সদ্য সীমান্ত পেরিয়ে আসা এক তৎকালীন সদ্য যুবতী আত্মীয়া প্রাণপণে চেষ্টা করছেন, এ দেশীয় ভাষা আত্মস্থ করতে। তো বাইরে মেলে দেওয়া শাড়িতে কাক শারীরিক বর্জ্য ত্যাগ করে নোংরা করেছে এটি তাঁর মাকে বলতে গিয়ে উত্তেজিত ভাবে বলছেন,
– মা মা, দ্যাখো, নয়া শাড়িটায় কাউয়ায় লেদেছে।
এ আমার নিজের কানে শোনা।
ঝুট বোলে, কাউয়া কাটে…
‘লেদেছে’ শব্দটা খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই। এই প্রসঙ্গে এই শারীরিক কর্মটির বঙ্গীয় বিবর্তনটিও লক্ষণীয়। পঞ্চাশ বছর আগে মানুষেরা হাগত। তিরিশ বছর আগে পায়খানা করত। আর এখন বাঙালি পটি করে।
যে কথায় ছিলাম। বাঙালদের কাছে শুনে শুনে, এপার বাংলার মানুষজনও কুকুরকে কুত্তা বলা শুরু করেছেন। সেও আজ বহুদিন হল। বিশেষ করে নেড়ি প্রজাতিকে কুত্তা বলাটা যেন প্রায় সার্বজনীন।
– বেয়াদবদের ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াব, বড়লোক মস্তানদের এই ডায়ালগ বেশ প্রাচীন। যদিও বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডালকুকুরই ছিল। ডালকুত্তা নয়। এক্ষুনি আমার অভিমানিনী কন্যা যাচ্ছেতাই রেগে গিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তার প্রায় পোষা কুত্তাদের উল্লেখ করল। তখনই পুরোনো এক ঘটনা মনে পড়ে গেল।
আমি হাওড়া হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে ডিউটি দিচ্ছি। এক চতুর্দশ বর্ষীয়া এলেন। খুব স্মার্ট। সঙ্গে তাঁর সাত বছরের তুতো ভাই। তাঁর কোলে কিম্বা কাঁখের উষ্ণতায় একটা কানঝোলা সিকনি ও লালাঝরা কুকুর।
– ডাক্তারবাবু, আমার কেল্টু এই ভল্টুকে ছোট্ট করে কামড়ে দিয়েছে।
কে কেল্টু আর কে ভল্টু হৃদয়ঙ্গম করতে অসুবিধে হচ্ছে দেখে, বিশদ হলেন পরীটি, – ভল্টু মানে ভাস্বরজ্যোতি বাসু হচ্ছে আমার এই ভাইটা। এখানে থাকে না। কালই এসেছে টাটা থেকে। কেল্টুসোনা ওকে চেনে না তো! একটু চেটে মানে চেখে দেখতে গেছিল। কেল্টুর কিন্তু সব ইঞ্জেকশন দেওয়া আছে।
– তা থাকলেও, তোমার ভাইকে অ্যান্টিরেবিজ দিতেই হবে জননী, অ্যাজ পার শিডিউল।
মা জননী কণ্ঠে যতেক উৎকণ্ঠা মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, – ডাক্তারবাবু, কেল্টুতো ভেট-কাকুর দেওয়া সব ইঞ্জেকশন নিয়েছে। ভল্টুর থেকে ওর কোনও খারাপ রোগ হবে না তো?
এই উল্টোদিকের বিপদের কথা আমার সিলেবাসে ছিল না। কেউ শেখায়নি। জানি না। সত্যিই জানি না। কথা ঘোরানোর মানে অজ্ঞানতা চাপা দেবার জন্য প্রতিপ্রশ্ন করলাম, – তোমার এই কুত্তাটা কী জাতের কুত্তা, খুকু?
প্রশ্ন শুনেই ঠোঁট ফুলে উঠল নন্দিনীর। একরাশ বিরক্তি আর অভিমান মিশিয়ে তিনি ফোঁস করে উঠলেন,
– ম্যানারস জানেন না? আপনি আমার কেল্টুকে কুত্তা বললেন কেন? জানেন ওর ভাল নাম কিটস। কিটস বাসু। আপনি খুব বাজে। সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানেন না। কুকুর বলে কি মানুষ নয়?
বুঝলাম পারিবারিক বসু পদবীতেও ভূষিত করা হয়েছে শ্রীমান কিটস নামের শ্বাপদটিকে। ব্যাপারটা পারিবারিক সম্মানে আঘাত করা গোছের হয়ে গেছে।
আমি শশব্যস্ত হয়ে প্রশ্নের ভাষাটা পাল্টে জোড়হাত জিজ্ঞেস করলাম, – মা গো, আপনার কোলের এই সারমেয়টি কোন বংশের?