পয়লা জুলাই। জাতীয় চিকিৎসক দিবস। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী (হ্যাঁ, প্রথম; প্রফুল্লবাবু ‘প্রধানমন্ত্রী’ ছিলেন) ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জন্ম ও মৃত্যুদিবস। ডাক্তার হিসেবে সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষদের তালিকায় ডাঃ রায়ের নাম উপরদিকে আছে, আজ নয়, বহুকাল যাবৎ। এবং চিকিৎসক বিধান রায় সম্পর্কে এই শ্রদ্ধার একটুও বাড়তি নয় কোনোমতেই। পাটনার একেবারে দরিদ্র বাঙালি পরিবারের সন্তান, সেখান থেকে চূড়ান্ত স্ট্রাগল করে ডাক্তারি পড়া কলকাতা মেডিকেল কলেজে; বিলেতযাত্রা এবং একই সাথে MRCP ও FRCS খেতাব অর্জন করা (সার্জারি আর মেডিসিন একসাথে করাটা কত কঠিন বলে বোঝানো মুশকিল); দেশে ফিরে এসে প্রায় ধন্বন্তরিতুল্য চিকিৎসক- সোনায় মোড়া ছাত্রজীবন এবং পেশাগত কেরিয়ার। এরপর (আদতে পুরোই গল্পকথা) নীলরতন সরকারের কন্যা কল্যাণীদেবীর সঙ্গে সম্পর্ক ও সম্পর্কের পরিণতি পাবার আগেই ইতি, এবং তারপর স্পার্টান জীবন। সাথে আইসিং অন দ্য কেক এককালে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থাকা, এবং পরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদ। চিরকাল দুর্বলের প্রতি সহানুভূতিশীল, মেধার গুণমুগ্ধ, রোমান্টিক বাঙালির আদর্শ হয়ে ওঠার জন্য একেবারে আদর্শ কম্বিনেশন। তাই ডাক্তারি পড়ছি শুনলে একটা উপদেশ ধেয়ে আসেই, “ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মতো ডাক্তার হও।” সত্যি বলতে, ডাক্তার হিসেবে বিধানচন্দ্রের নখের যোগ্য হতে পারলেও বিরাট ব্যাপার। কিন্তু তা বাদে? রাজনীতিবিদ, প্রশাসক বিধান রায়ও কী ততটাই শ্ৰদ্ধার যোগ্য? একটু বিচার করা প্রয়োজন বটে।
পশ্চিমবঙ্গের রূপকার হিসেবে প্রায় সব লোকে এক বাক্যে বলে তাঁর নাম। এক অর্থে, সেটা সত্যিই। আজকের পশ্চিমবঙ্গ ঠিক কেমন হবে, সেই ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়েছিল বেশিরভাগটাই ডাঃ রায়ের আমলে। আজকের পশ্চিমবঙ্গকে আমরা যে রূপে দেখি, তা হয় সেই আমলের সিদ্ধান্তের সরাসরি ফলশ্রুতি, নয়তো তার প্রতিক্রিয়া। প্রথমেই উঠে আসে শহর তৈরি- পরপর গড়ে উঠেছে দুর্গাপুর-সল্টলেক-কল্যাণী। সঙ্গে দুর্গাপুরে ইস্পাত কারখানা। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পোন্নয়ন ও নগরায়ণের সূচনা নাকি এর সাথেই। এত অবধি বললে অমত হবো না। কিন্তু তারপরের লাইনে যখন শুরু হয় ‘বিধান রায়ের আমলেই বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতি, তারপরই তো পতন’, তখনই বিরক্তি জাগে। না, বাম শাসনকে ডিফেন্ড করতে বলা নয় (সে চর্চা অন্য জায়গায় হবে, এখন থাক), বলা ভুলে যাওয়া কটা কথা মনে করাতে। দুর্গাপুর-আসানসোল অঞ্চল, কোলিয়ারী বেল্ট, ভারী শিল্পাঞ্চল নাকি ভারতের রূহর! অথচ সেই রূহর কেন প্রায় মৃত, সেই প্রশ্নর উত্তর লুকিয়ে আছে বিধান-শাসিত বাংলার ইতিহাসেই। সালটা ১৯৫২, দেশে শিল্পের উন্নতির জন্য সরকার চালু করলো মাশুল সমীকরণ নীতি। পূর্ব ভারতের খনিজ চলে গেল দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের বন্দর শহরের নবনির্মিত কারখানায়। কেন? কারণ ‘র মেটেরিয়াল’ পরিবহনে তো বাড়তি খরচ নেই- মহারাষ্ট্র হোক বা আসানসোল, রানীগঞ্জের খনি থেকে ট্রেনে কয়লা যাবে দু’জায়গায়ই সমান খরচে। এবং অবশ্যই, পশ্চিমের সাথে নৈকট্য এবং বন্দরের উপস্থিতি- শিল্পের ভূমি হয়ে উঠলো পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলো। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার কপালে রইলো আমের আঁটিটি। এবং এসব হলো ঠিক সেই সময়, যখন বাংলার আর এক প্রধান শিল্প, পাট, ডুবছে দেশভাগের ফলে। হ্যাঁ পাঠক, মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা-ই নেমে এসেছিল তখন। এবং ফেডারেল স্ট্রাকচারের তোয়াক্কা না করা মাশুল সমীকরণ নীতি লাগানো কেন্দ্রের কংগ্রেসের দায়িত্বশীল সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন বাংলার ‘রূপকার’।
অথচ এই বিধান রায়ই তো কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন বলে খ্যাত, তাই না? প্রধানমন্ত্রীকে ‘জহর’ বলে সম্বোধন করতেন, ইনকাম ট্যাক্সে বাংলার শেয়ার কমিয়ে দেবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সবই তো বিধান রায়ের! হ্যাঁ, প্রতিবাদ হয়েছিল বটে, বাংলার শেয়ার ২০ শতাংশ থেকে কমে ১২ শতাংশে নামাবার সময়। সেই প্রতিবাদ উঠেও যায়, যখন ১২ বেড়ে সাড়ে ১৩-য় ওঠে। হ্যাঁ, নিট সাড়ে ছয় শতাংশ লোকসান। এবং চূড়ান্ত অর্থনৈতিক ক্রাইসিসের মধ্যেই।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি ডাঃ রায়ের বিশেষ প্রেম কোনোকালেই ছিল বলে জানা যায়না। কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বের কাউন্টারওয়েট হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের মতো কখনোই রাজ্যের স্বাধিকারের লড়াই ছিল না সেটা। লড়াই ছিল ‘ব্যক্তি’ বিধান রায়ের সঙ্গে কেন্দ্র কংগ্রেসের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। স্বাধীনতা-উত্তর যুগে কংগ্রেসের বিভিন্ন গোষ্ঠী- ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় সে সময়ের অন্যতম গোষ্ঠিপতি, এই যা। সেখানে কখনোই বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্ন ছিলনা। ১৯৫৫-র স্টেট রি-অর্গানাইজেশন কমিশনের সুপারিশ এলো বিহারের পুরুলিয়া ও ইসলামপুর অঞ্চলগুলি বাংলা ভাষাভাষী হবার দরুন বাংলার সাথে যুক্ত করা হোক। দুই অঞ্চলেই তখন তীব্র হয়েছে ভাষা আন্দোলন। বেঁকে বসলেন বিহারের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ। হুমকি জারি হলো কংগ্রেস-ভাগের। এবং শেষবধি বিধানচন্দ্র কংগ্রেস নেতাই। দলের ঐক্য বাঁচাতে মাঠে নামতে হলো তাঁকে। প্রথমে পুরুলিয়া এবং ইসলামপুরের উপর দাবি জানিয়েও পরে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলেন বিধান রায়। শ্রীকৃষ্ণ সিংহকে নিয়ে একসাথে প্রেস কনফারেন্স করে ১৯৫৬ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের ঠিক আগেই গোটা পুনর্গঠনের premise টাকে উচ্ছেদ করে দিয়ে প্রস্তাব দিলেন বাংলা ও বিহারকে এক করে ‘পূর্ব প্রদেশ’ গঠনের। হ্যাঁ, জাতীয় স্বনিয়ন্ত্রণকে নস্যাৎ করে। হ্যাঁ, পশ্চিমবাংলার ‘রূপকার’ চাইলেন পশ্চিমবাংলাকে ভারতের ম্যাপ থেকে মুছে দিতে! দু’রাজ্যের বিধানসভাতেই কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ, ঘরে-বাইরে বিক্ষোভ সত্ত্বেও পাস হলো সংযুক্তিকরণ প্রস্তাব, মন্ত্রিসভা,রাজ্যপালেরা জয়ধ্বনি দিলেন। কিন্তু জনরোষের সামনে কংগ্রেসি ক্ষমতার দম্ভ টিকতে পারলো না। বামেদের নেতৃত্বে আন্দোলন চলছিল রাজ্যের স্বাধিকারের দাবিতে, উত্তর কলকাতা ও খেজুরিতে বাম-সমর্থিত প্রার্থীর কাছে ভোটে হেরে গেলেন কংগ্রেস প্রার্থীরা। বিধানচন্দ্রকেও পিছু হটতে হলো। বাংলার অস্তিত্ত্ব বজায় থাকলো, পুরুলিয়া-ইসলামপুরও ভাষার স্বাধিকার পেলো।
এছাড়াও রায়সাহেবের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অদক্ষতার আরো একগাদা অভিযোগ তোলা যায়। দণ্ডকারণ্য বা আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের fiasco হোক (যেটা নিজে একটা গোটা প্রবন্ধ ডিজার্ভ করে, কিন্তু তুলনামূলক পরিচিত ঘটনা, এবং এখানে স্থানাভাব, তাই ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক) , বা রাজ্যের ক্রমাগত অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বা তুলনামূলক ছোট পর্যায়েই ‘কমিউনিস্ট’ বলে দেগে দিয়ে স্টুডেন্টস হেলথ হোম মুভমেন্টকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা। কিন্তু সেসবই নেহাত ক্ষুদ্র। অন্ততপক্ষে তাঁর বাকি দুই কীর্তির তুলনায়। সেটা অদক্ষতার পরিচায়ক নয়, পরিচয় দেয় এক অতি সুদক্ষ কিন্তু ক্রূর নিষ্ঠুরতার। একটি তাও লোকে মনে রেখেছে, আরেকটি বিস্মৃতির অতলে। মনে রাখা ঘটনাটা দিয়েই শুরু করি।
সালটা ১৯৫৯। স্বাধীনতার ঠিক বারো বছর পর। ধুঁকছে তখন বাংলার অর্থনীতি। জনবিস্ফোরণ, উদ্বাস্তু সমস্যা, ক্ষেতের ফসলের পরিমাণে হ্রাস, শিল্পের শ্লথ গতি। সব সমস্যার নাগপাশই চেপে বসছে গলায়। সঙ্গে রয়েছে আদি অনন্তকালের সমস্যা- কালোবাজারি। কংগ্রেস সরকার যা কিছুরই দাম বাগে আনতে যায়, তা উবে যায় বাজার থেকে। জমা হয়ে মজুতদারের কাছে। নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলেই বাজারে ছেয়ে যায়ও বটে, কিন্তু আগুন দামে। মজুতদারের মজুত কংগ্রেস সরকার ভাঙবে, এ আশা করাও বাতুলতা। তাই কাপড় থেকে কেরোসিন, সবই স্বাভাবিক নিয়মেই অগ্নিমূল্য। এতদিন অবধি হিসেবে গোল ছিল না। গোলমালটা বাঁধলো যখন চালের ক্ষেত্রেও এক জিনিস চালু হলো। পেটের টান বড় টান- প্রায় দু’দশক আগে এক মন্বন্তর দেখা খেটে-খাওয়া বাঙালি কিন্তু আর পড়ে থেকে লাথি খেতে রাজি হলো না। জুলাই মাস থেকে জেলায় জেলায় শুরু হলো বিক্ষোভ। ৫ আগস্ট বহরমপুরের জেলা শাসককে ঘিরে বিক্ষোভের দিন কোনরকমে পালিয়ে বাঁচলেন জেলাশাসক। পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন বকুল ও বন্দনা। এত অবধি ঠিকঠাকই ছিল। সরকারের স্বভাবসিদ্ধ অদক্ষতা, বাংলা যা দেখছে প্রায় দুশো বছর ধরে। কিন্তু তারপর?
৩১শে আগস্ট, ১৯৫৯। রাজধানী কলকাতার রাজপথে জনঅরণ্য। একদিন আগেই দিল্লি থেকে আগত কংগ্রেস নেতা নিদান দিয়েছেন, বাংলায় খাদ্যাভাব নেই, চাল অতি সস্তা ও সুলভ, কাঁকর আছে কারণ সেটা পাথুরে মধ্যপ্রদেশে উৎপন্ন হয়। ঠিক তারপরের দিনই কলকাতায় নিরন্ন মানুষের মিছিল। পুলিশের ব্যারিকেড এড়িয়ে, শত বাধা টপকে শহরে প্রবেশ করলো মিছিল সন্ধ্যা নামার আগেই। ময়দান থেকে এস্প্ল্যানেড লোকারণ্য। বৃষ্টি সত্ত্বেও চললো মিটিং। তারপর মিছিল মহাকরণের উদ্দেশ্যে। রাজভবনের কাছে এসে গ্রেফতারবরণ করলেন নেতৃবৃন্দ। তারপরই শুরু হলো পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ। গ্রাম থেকে শহর ঘিরতে আসা মানুষকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে ঘিরে ফেলা হয়েছিল ধর্মতলা চত্বরের চারদিক। আশেপাশের গলিতেও সশস্ত্র পুলিশ। যাতে আক্রমণের মুখে প্রাণ বাঁচাতে পালানো ‘ছোটলোক’-রাও পালাতে না পারে। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে আনন্দবাজারের সাংবাদিকের রিপোর্ট ছিল ঠিক এরকম:
‘‘রাস্তার উপর অজস্র জুতা মালিকবিহীন অবস্থায় পড়িয়া আছে। এখানে ওখানে ছেঁড়া কাপড়, জামা, গামছা, টিফিন কেরিয়ারের বাটি, রুটি, মুড়ি গড়াগড়ি খাইতেছে।… একটু দূরে খানকয়েক আধলা ইট এবং রাস্তার বিজলী বাতির ভাঙ্গা কাঁচের অজস্র টুকরার ছড়াছড়ি দেখা যায়। কিছুক্ষণ আগেই এক পসলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, মেঘের ফাঁক দিয়া এক ফালি চাঁদ উঠিয়াছে। মনে হইতেছিল তাহার বিস্ময়ের বুঝি আর সীমা নাই।’’
আরো একদল প্রত্যক্ষদর্শী তাদের বর্ণনা লিখে গেছেন- ডঃ পূর্বাচল মুখোপাধ্যায়, ডঃ করুণা মুখোপাধ্যায়, ও ডঃ অমিয়কুমার দত্ত। সেটাও না হয় থাক:
” আমরা তিনজন চিকিৎসক স্ব স্ব বাড়িতে অনবরত টেলিফোনের রিং শুনে হাওড়ার কয়েকটি বিপন্ন অঞ্চলের এ কদিন আহত মুমূর্ষুদের সেবা করতে উদ্যত হই। সর্বক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছি আহত বা নিহতদের বেশিরভাগই কপালে বা বুকে বুলেট লেগেছে। ইহার দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায় সরকার শান্তিপূর্ণ জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করবারই আদেশ দিয়েছেন। আমরা অনেক ক্ষেত্রে মিলিটারী পুলিশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হই (যদিও আমাদের গাড়িতে Doctor বা + এই চিহ্নগুলি উজ্জ্বলভাবেই লেখা ছিল)। মুহূর্তেই ভেবেছিলাম সরকার কতখানি নির্মম হয়েছে – বোধ হয় তাহারা জনসাধারণের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, গত বৃহস্পতিবারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখনও হাওড়ার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ও বেপরোয়া ধরপাকড় হচ্ছে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কেহই এই অত্যাচার থেকে বাদ যাচ্ছে না। কোথায় গেল মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংস নীতি’ – যা আজ কংগ্রেস সরকার বড়াই করছে।
গতকাল আমরা দাশনগর থেকে যখন কদমতলার দিকে ফিরছিলাম হঠাৎ এক স্ত্রীলোকের করুণ আর্তনাদে আকৃষ্ট হই। গাড়ী থেকে নেমে গিয়ে দেখি একটি রেল-লাইনের ধারে স্ত্রীলোকটির দেহের চারদিক থেকে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। তার বয়স আনুমানিক ২৫। তার কাছ থেকে আরও জানলাম যে, মিলিটারী পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিতা হয়েছে।
এরপর যখন তাকে আমরা গাড়িতে তুলতে যাচ্ছিলাম তখন দেখি কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য আমাদের দিকে এগিয়ে আসে এবং আমাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে। প্রাণের ভয়ে আমরা ঐ স্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হই। জানিনা ঐ মহিলার কি দুর্দশা হবে। মনে হয়েছে সমস্ত দাশনগরেই বোধ হয় সরকারের সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। দশনগর, শানপুর, ইচ্ছাপুর ও সদর বক্সী লেনে নরনারীর উপর অকথ্য নির্যাতন চলছে। সদর বক্সী লেনে এক সাত মাসের সন্তান সম্ভবার বুকের উপর সশস্ত্র সৈন্য লাথি মারে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঐ অসহায়ার প্রাণ হারায়। আজ ঐ সব অঞ্চলে কোনও রুগ্ন শিশুর জীবনই নিরাপদ নয় – কারণ তারা চিকিৎসকের কাছেই যেতে পারছে না। মা-বোনের স্তনকে পর্যন্ত ঐসব অঞ্চলে দলিত করা হয়েছে। পুলিশী ও মিলিটারী বর্বরতা ছাড়া একে কি বলব ?
মা-বোনের ইজ্জত বাঁচাতে হলেও আজ বাঙালীকে আবার জাগতে হবে, কারণ এই কংগ্রেসী শাসকদের আমলে দেখছি আমাদের মা-বোনের ইজ্জত ব্রিটিশ আমলের তুলনায় অধিকতর বিপন্ন।
আমরা নিশ্চয়ই দুঃখিত যে কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী অ্যাম্বুলেন্স পুড়িয়ে অসভ্যতার পরিচয় দিয়েছে। তার মূলে কে আছে ? আমাদের মনে হয় বর্তমান সরকার নিজেই। কেন তারা গত ৩১ শে আগস্ট হাজার বৃদ্ধ লোক ও অসহায়া নারীকে উলঙ্গ করে বেত্রাঘাত করেছে ? যে দেশ এই বর্বরতার আশ্রয় নেয় সে আবার কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ? এক্ষণে বর্তমান সরকার পদত্যাগ করে গণতন্ত্রের সুমহান আদর্শ রক্ষা করুন।”
হ্যাঁ, এই নরমেধ যজ্ঞেরই পূজারী হয়েছিলেন বাঙালির সর্বজনশ্রদ্ধেয় চিকিৎসক। এরপরেও তাঁর মমত্ব জাগেনি, উল্টে ক্রমাগত সমর্থন করে গেছেন তিনি পুলিশের কীর্তিকে। অবশ্য করারই তো কথা। শোনা যায়, তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কালীপদ মুখার্জিই তো লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে বসে পরিচালনা করছিলেন পুলিশকে। টানা বিক্ষোভ, প্রতিবাদ চলেছিল ৬ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। চলছিল জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধও। নিহতের সংখ্যা, জনতা পক্ষে, ৮০, ৪ জন ছাত্রসহ। স্রেফ ৩১শ তারিখেই আহতের সংখ্যা বিভিন্ন পত্রিকার মতে ৩৫০ থেকে ৪০০। এবং পশ্চিমবাংলার রূপকার বিধানচন্দ্র রায় অস্বীকার করেছিলেন বিধানসভায় নিহত মানুষের স্মৃতিতে নীরবতা পালন করতে। তাঁর দলের বিধায়ক বিজয় সিংহ নাহার বরং দোষ চাপিয়েছিলেন কমিউনিস্টদের উপরে। কমিউনিস্টরা কেন চাষাদের নিয়ে এসেছিল যখন জানতো পুলিশ গুলি চালাবেই? যেন বুভুক্ষু মানুষের উপরে গুলি চালানোই সরকারের কর্তব্য! হ্যাঁ, সেই সরকারেরই কর্তার নাম ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়।
পশ্চিমবাংলার রূপকারের দ্বিতীয় কীর্তিটি অনেকটা স্মরণ করায় বিজেপির মতে ‘পশ্চিমবাংলার জনক’কে। রাজনৈতিক অবস্থানে শ্যামাপ্রসাদ ও বিধানচন্দ্রের ফারাক যতটাই থাক না কেন, পশ্চিমবাংলার মুসলিম বাসিন্দাদের প্রতি আচরণে মিল আশ্চর্য। হ্যাঁ, আমি সরাসরি অভিযুক্ত করছি ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে সাম্প্রদায়িকতার অপরাধে। না, শুধু কলকাতা দাঙ্গার অন্যতম পাণ্ডা গোপাল মুখার্জি ওরফে গোপাল পাঁঠাকে নিজের ডান হাত হিসেবে ব্যবহার করা নয়। একেবারে মুর্শিদাবাদ জেলায় মুসলমানদের এথনিক ক্লিনজিং করতে বলার অপরাধের দায় বর্তায় ডাঃ রায়ের ঘাড়ে। বিধান রায়, তাঁর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরণশংকর রায়, স্বরাষ্ট্রসচিব রণজিৎ গুপ্ত ও নদিয়ার জেলাশাসক রণজিৎ রায়- চারজন বিভিন্ন সময়ে বারংবার নির্দেশ-হুকুম-অনুরোধ করেন মুর্শিদাবাদের জেলাশাসককে সীমান্ত অঞ্চলের মুসলমানদের ঠেলে-গুঁতিয়ে হলেও পূর্ববঙ্গে পাঠিয়ে দিতে। কারণ তারা নাকি আসন্ন যুদ্ধে শত্রুপক্ষের চর হতে পারে। জেলাশাসক প্রতিবাদ করলেন, এতে রক্তপাত হতে পারে। জাতীয় নীতির বিরোধী এ কাজ তিনি কোনোমতে করবেন না। সরকারের তরফ থেকে বলা হলো, রক্তপাত হলে হোক না। লক্ষ্য, যত দ্রুত সম্পূর্ণ করা কাজ। প্রধানমন্ত্রী নেহরু দেশের বাইরে তখন। সেই সুযোগেই ধর্মনিরপেক্ষ নেহরুর নজরের আড়ালেই কাজ সেরে ফেলা। বাধা হয়ে দাঁড়ালেন সেই জেলাশাসক। তাঁর পদত্যাগ ঘিরে উত্তাল হলো রাজনীতি। থমকে গেল ষড়যন্ত্র। জেলাশাসকটির নাম অন্নদাশংকর রায়। এবং এসব নেহাত সাংবাদিকের রিপোর্টিং নয়। তথ্যের উৎস তাঁরই প্রবন্ধ সমগ্র, খণ্ড নম্বর নয়। বাঙালি এক রায়কে মনে রাখতে আরেক রায়কে ভুলেছে। সম্ভবত, গোধরার অর্ধশতক আগে ঘটতে পারা সমান মাত্রার এক পাপকে আড়াল করতেই!
সত্যি বলতে, এত কিছু টেনে নামাবার ইচ্ছা ছিল না। মানুষের জন্মদিনে ফুলই ভালো কাটার চেয়ে। কিন্তু তার মানে এই না যে সব অপরাধ ভুলে যেতে হয়, বা ভুলে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। আর সত্যি বলতে গতকাল সারাদিন এত আদর্শ চিকিৎসকের সঙ্গে আদর্শ মানুষ ও আদর্শ প্রশাসকের গল্প (বলা ভালো হ্যাজ) শুনতে হলো, যে এইটুকু বলতে বাধ্য হলাম। এর মানে কখনোই নয় যে রাজ্য হোক বা কেন্দ্র, কারো স্বৈরাচারী শাসকের সঙ্গেই তুলনা টানছি বিধান রায়ের। খালি একটাই কথা মনে করিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি, আলোর সাথেও আঁধার থাকে। অনেক সময়ই, একগাদা আঁধার থাকে।
(পুরোনো লেখা। আবার শেয়ার করছি। প্রত্যেক বছর আজকের দিনে বারবার করবো। আর আগে বলেই এত ধৈর্য্য ধরে ভালো ভালো কথা লিখেছিলাম শুরুতে, আজকে হলে ভদ্রবেশী গুন্ডা বা সাম্প্রদায়িক খুনি বলে দিতাম সরাসরি।)
ঋণ স্বীকার: রৌণক বিশ্বাস, অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
তথ্যসূত্র:
https://www.anandabazar.com/editorial/sixty-years-of-food-movement-in-west-bengal-1.1039552
https://thewire.in/politics/bc-roy-first-decade-india-federalism-nehru-bengal
https://en.wikipedia.org/wiki/Freight_equalisation_policy
https://en.wikipedia.org/wiki/Purva_Pradesh
http://www.jstor.org/stable/44158893
https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://www.mha.gov.in/sites/default/files/State%2520Reorganisation%2520Commisison%2520Report%2520of%25201955_270614.pdf&ved=2ahUKEwifsJaTtNr4AhWM2TgGHYbPC4UQFnoECEQQAQ&usg=AOvVaw3i0-bCN5g47dzeMwoClDNt
https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://ir.nbu.ac.in/bitstream/123456789/3899/1/Karatoya%2520vol%252010%2520Article%2520No%252013.pdf&ved=2ahUKEwih5-ODtdr4AhXCyDgGHVZpBV0QFnoECA0QAQ&usg=AOvVaw1Yms6iN7-loJH6Aqoxlb2D
অন্নদাশঙ্কর রায় প্রবন্ধ সমগ্র, নবম খণ্ড