“চিকিৎসকরা ভুত দেখছেন, শারীরিক নিগ্রহের ভুত”
১# ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের নীতি নির্ধারকরা স্বাস্থ্য বিষয়টা নিয়ে চিরকালই বিভ্রান্ত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও ভারতের সংবিধানে স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলো না। উচ্চারিত হ’ল না সেই প্রত্যয় যে স্বাস্থ্য কোনো পণ্য নয়, দয়ার দানও নয়, এটা অর্জিত অধিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের নাগরিকদের। বঞ্চনা প্রতারণার সেই শুরু।
২# স্বাস্থ্য, পরিষেবা না পণ্য এই দোদুল্যমানতার মধ্যে দেশ পথ চলা শুরু করলো। কল্যাণকর রাষ্ট্র মডেল অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে কিছু বাজেট বরাদ্দ করা হ’ল যা দিয়ে সরকারি স্তরে জনস্বাস্থ্যের কর্মসূচি রূপায়ন ও স্বাস্থ্য পরিসেবামূলক কাজ যেমন হাসপাতাল ইত্যাদি চালানোর পাশাপাশি মেডিক্যাল, নার্সিং জাতীয় শিক্ষা প্ৰতিষ্টান গড়ে তোলা ও চালানোর কাজ শুরু হয়।
৩# এই বিপুল কর্মকান্ডে প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ নেহাতই অপ্রতুল সেই গোড়া থেকেই। ফলে শুরু থেকেই প্রয়োজনের তুলনায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল, চিকিৎসক ও অচিকিৎসক কর্মচারী, ওষুধপত্র, সাজসরঞ্জাম এর বিপুল ঘাটতি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে শুরু করে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। পরিকাঠামোর ঘাটতি জন্ম দেয় এক অদ্ভুত কর্ম সংস্কৃতির। রোগী শয্যার অভাবে মাটিতে স্হান পায়। সময় মতো টাকা না পাওয়ায় হাসপাতালে বন্ধ হয়ে যায় অক্সিজেন।
৪# নাগরিকরাও ধীরে ধীরে এই ঘাটতি জনিত অসুবিধার সাথে মানিয়ে নিতে শুরু করেন। কেউ নীতি নির্ধারক, শাসকদের দিকে আঙ্গুল তুললেন না। জানতে চাইলেন না কেন আরো এম্বুলেন্স না কিনে মন্ত্রীদের জন্য বুলেট প্রুফ গাড়ি বেশি করে কেনা হবে। নাগরিকদের এই মেনে নেওয়ার প্রতিফলন ঘটে তাদের প্রিয় রাজনৈতিক দলগুলির মনোভাবেও। দেশের সাধারণ নির্বাচন গুলিতে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী ইস্তেহারগুলিতে চোখ বোলালেই ধরা পড়বে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইস্যুগুলির অনুপস্থিতি বা অত্যন্ত দায়সারা উপস্থিতি।
৫# এর পাশাপাশি বেসরকারী স্তরে ব্যক্তিগত ক্লিনিক ও ছোটখাটো নার্সিংহোম গোছের ব্যক্তি- মালিকানাধীন হাসপাতাল স্বাধীনতার থেকেই ছিল। সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা নিতে অনিচ্ছুক লোকেরাই এর গ্রাহক ছিলেন।
৬# এরপর যত দিন যায় তত বিজ্ঞানের সামগ্রিক উন্নতি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হতে থাকে। এর সুফল কিছুটা হলেও দেশের সাধারণ নাগরিকরাও পেতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য সূচকগুলি যেমন মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার এসব কমতে থাকে। বাড়তে থাকে নাগরিকদের গড় আয়ু। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্য প্রায় কল্প বিজ্ঞান কেও হার মানাতে শুরু করলো। হৃৎ যন্ত্র অবধি প্রতিস্থাপন শুরু হল। এযাবৎ কাল দুরারোগ্য হিসেবে চিহ্নিত ব্যাধিগ্রস্ত রুগীরাও মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসতে লাগলো একের পর এক।
৭# পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের আস্থা, সম্ভ্রম ও প্রত্যাশা। মানুষ তখন ডাক্তারকে বসিয়ে দিল এক জাদুকর দেবতার আসনে।
৮# সঙ্গে দেশ এগিয়ে চললো এক জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এর দিকে। প্রচুর মানুষ মানে প্রচুর রোগীর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ল না পরিকাঠামো। নাগরিক পিছু চিকিৎসকের অনুপাত ভালো হওয়ার বদলে আরো খারাপ হতে লাগলো।
৯# প্রযুক্তি নির্ভর এই উন্নতি ভারত পৃথিবীর অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি আমদানি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাজেট অপ্রতুলতার কারনে গুটিকতক বাছাই করা সরকারি হাসপাতালে ওই গুলি উপলব্ধ করা সম্ভব হয়। যে হারে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অন্য শাখাগুলিতে গবেষণা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশ ধীরে হলেও স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো, সেই হারে চিকিৎসা প্রযুক্তি বা ওষুধ আবিষ্কার এর ধারা এগোল না।
১০# অন্যদিকে দেশের মধ্যে ধীরে ধীরে ধনাঢ্য শ্রেণীর পাশাপাশি উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে যারা ওই আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর চিকিৎসা পরিষেবার সুফল নিতে উদগ্রীব এবং সচ্ছল। এই নতুন তৈরি হওয়া চাহিদার যোগান দিতে এগিয়ে আসলো কর্পোরেট পুঁজি। ব্যক্তি-মালিকানাধীন বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি মাথা চাড়া দিতে শুরু করলো কর্পোরেট হাসপাতাল। চিকিৎসক তখন মালিকের ভূমিকা থেকে চলে গেলেন কর্মচারীর ভূমিকায়। এমন কি তাকে হোয়াইট কলার মজুরও বলা চলে।
১১# বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগকারী, ব্যক্তিমালিক বা প্রতিষ্ঠাননের স্বভাবতই উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ালো মুনাফা অর্জন এবং দ্রুত মুনাফা অর্জন। সেই অভীষ্ট পূরণের জন্য এরা বহুক্ষেত্রেই নানা রকম অনৈতিক কাজকর্ম শুরু করলো। এর ফল ভুগতে শুরু করলেন পরিষেবা গ্রহণকারীরা। ততদিনে পয়সা দিয়ে স্বাস্থ্য কেনার এই স্রোতে উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্তরা ছাড়াও নিম্নমধ্যবিত্ত এমনকি ঘটিবাটি বেঁচেও সামিল হতে শুরু করলেন।
১২# নির্বাচকমন্ডলীর এই বিপুল অংশের ক্ষোভ কে কোনো দেশের রাষ্ট্র্শক্তিই অবহেলা করতে পারে না। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে সরকার বেছে নিল সহজ রাস্তা। সদ্য তৈরি হওয়া ক্রেতা-সুরক্ষা আইনের আওতায় নিয়ে আসা হল স্বাস্থ্য পরিষেবাকে। সরকার অলিখিত ভাবে মেনে নিল যে স্বাস্থ্য আর অধিকার নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ত্ব নয় তার নাগরিক কে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া। স্বাস্থ্য আসলে পণ্য। পরিষেবাদানকারী থেকে চিকিৎসক পরিণত হলেন বিক্রেতায়।
১৩# সাধারণ মানুষ তথা ক্রেতা বুঝলেন না যে অন্য পণ্যের বিক্রেতার থেকে পরার্মশদানকারী চিকিৎসক যিনি নিজেই একজন সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারী, তার তফাৎ কোথায়। সুকৌশলে গুলিয়ে দেওয়া হ’ল চিকিৎসকের সামাজিক অবস্থান।
১৪# নব্বই দশকে ভারতে শুরু হল নতুন মনোমোহিনী অর্থনীতি। সারা পৃথিবীর ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে মন্দা বাজারের জন্য দেশি বিদেশি হন্যে হয়ে খুঁজছিল পুঁজি বিনিয়োগের নতুন বাজার। তারা লুফে নিলো এই আর্থিক সংস্কার। তাদের হয়ে আসরে নামা বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের নির্দেশ মেনে বিভিন্ন দেশের সরকারের মতো আমাদের দেশের সরকারও ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য দেখাতে শুরু করলো বিভিন্ন পরিসেবামূলক কাজে ব্যয়বরাদ্দে যেমন পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি।
১৫# এই সঙ্কোচনটাই চাইছিল কর্পোরেট পুঁজি। তারা বুঝে গিয়েছিল যে মানুষ চড়া দামে, যে কোনো দামে এমন কি সর্বস্বান্ত হয়েও যেটা কিনতে রাজি সেটা হল স্বাস্থ্য। কর্পোরেট হাসপাতাল গজিয়ে উঠলো ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে। তার খদ্দের এর টাকার যোগান দিতে পিছু পিছু আসলো স্বাস্থ্য বীমা বেচার দল। মধ্যবিত্ত স্বাস্থ্য নিরাপত্তার খাতিরে ওই বীমা কোম্পানির খদ্দের হতে লাইন লাগিয়ে দিল।
১৬# ভোগ্যপণ্যের জয় জয়কার শুরু হল চারদিকে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়কার কৃচ্ছসাধনের মানসিকতার শেষ চিন্হ টুকু মুছে ফেলতে শুরু করলো দেশবাসী। ভোগবাদ-ভিত্তিক সমাজে বড় হয়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম জন্ম দিল নতুন মূল্যবোধের। স্বাস্থ্য, শিক্ষা সর্বত্র ছড়িয়ে গেল এই বিষবৃক্ষের ফল। টাকা দিয়ে সব কিছু কেনা যায় এই বিশ্বাস আরো গভীরতর হ’ল যখন মানুষ দেখলো মেধার বদলে অর্থের বিনিময়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হওয়া যায় যেটা দু’দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল।
১৭# তাই এই সমাজ নতুন করে ভাবতে বসলো, নতুন করে মূল্যায়ন করলো চিকিৎসকের। তাকে দেবতার আসন থেকে টেনে নামানো হ’ল আবেগহীন, নিছক পেশাদার এর আসনে। পরিবার, পরিজন, নিয়োগকর্তা, সমাজের কাছে সে পরিণত হ’ল নিছক টাকা কামানোর যন্ত্রে।
১৮# অনিয়ন্ত্রিত পুঁজির এই বাজার সময়ে সময়ে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের একদিনেই পেট কেটে সমস্ত ডিম লাভের আশায় জড়িয়ে পড়লো নানা বেপরোয়া অনৈতিক কাজে। অপ্রয়োজনীয় হাসপাতাল ভর্তি থেকে শুরু করে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার অবধি চালু হলো। মালিকদের মুনাফা কামনোর প্রধান সহায় হয়ে উঠল একশ্রেণীর বিবেকহীন চিকিৎসক কর্মচারী।
১৯# একশ্রেণীর চিকিৎসক চোখ বন্ধ করে দুহাত তুলে চিকিৎসা ব্যবস্থার এই বাজারিকরণ কে স্বাগত জানালো। তারা স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়লো নানা কাজে যেমন হাসপাতাল মালিকানায় পুঁজি বিনিয়োগ, শেয়ার কেনা, গোলমেলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেওয়া, এবং অনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে ম্যানেজমেন্ট কে মদত দেওয়া ইত্যাদি।
২০# চিকিৎসকদের একটা অংশ বরাবরই অন্য অংশের এইসব কাজের বিরোধিতা করে এসেছে নানা ভাবে। কিন্তু চিকিৎসকদের পেশাদার সংগঠনগুলি এই ধরণের দু নম্বরি কাজকর্ম যেমন কিকব্যাক নেওয়া, অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক ওষুধ লেখা, অস্ত্রোপচার করা, ওষুধ কোম্পানির টাকায় প্রমোদ ভ্রমণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে বেশিরভাগ ডাক্তারকে একজোট করে বৃহৎ আকারের বিরোধিতার মঞ্চ তৈরি করতে পারেনি। সাধারণ অচিকিৎসক সহ নাগরিকদের সামিল করে বৃহত্তর মঞ্চ তো অনেক দূরের কথা। সংগঠন ও সরকার যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়ে অনৈতিক কাজে রাশটানার জন্য পেশাদারদের জন্য প্রযোজ্য আইন কানুনে নীতি নৈতিকতা নিয়ে গালভরা কতগুলি বাছা বাছা শব্দ যুক্ত করে সংশোধনী আনলো, সাধারণ মানুষের কাছে যার ব্যবহারিক মূল্য প্রায় শূন্য।
২১# যেকোন পেশাদার পরিষেবাদানকারীর পরামর্শ এর সামনে সিদ্ধান্ত নিতে অপেশাদার গ্রাহক অসহায় বোধ করে। প্লাম্বার এর দেওয়া এস্টিমেট এর সামনে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বা ইলেকট্রিশিয়ান এর এস্টিমেট এর সামনে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অসহায় বোধ করেন তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতই খ্যাতনামা হন না কেন। সেবক-গ্রহীতার এই সম্পর্কের সূত্র ধরে অসহায়তার বোধ মানুষ সবচেয়ে বেশী বোধ করে চিকিৎসকের পরামর্শের সামনে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নূন্যতম ধ্যানধারণা না থাকার জন্য রোগীর বাড়ির লোক ডাক্তারের সিদ্ধান্ত এর কাছে অনিচ্ছা স্বত্বেও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বর্তমান পরিষেবা = পণ্য এই মূল্যবোধ ভিত্তিক সমাজে অত্যন্ত সহজবোধ্য কারনেই রোগীর বাড়ির লোক ওই আত্নসমর্পণটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারলো না। সন্দেহ অবিশ্বাসের ঐ বাতাবরণে আগুন জ্বালানোর কাজ করলো আত্মীয় স্বজন ও গণমাধ্যম এর বিভিন্ন গল্প কাহিনী।
২২# বর্তমান দশকে প্রযুক্তির দৌলতে তথ্য চলে এলো আক্ষরিক অর্থে হাতের মুঠোয়, অন্ততঃ একদল মানুষের জন্য। আট বছর ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে তৈরি হওয়া একজন চিকিৎসকের জ্ঞান বুদ্ধির সাথে পাল্লা দিতে লাগলো আট মিনিটের অন্তর্জালের দুনিয়ায় ঘোরাঘুরি। মিনিটে মিনিটে জন্ম নিতে লাগলো ওইসব আট মিনিটের বিশেষজ্ঞদের মতামত। চিকিৎসকদের শ্রদ্ধার আসনটা আরেকবার টলে গেল ওইসব অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করীদের কাছে। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ফেসবুকের দেওয়াল, কলতলার গল্প আড্ডা থেকে বহুল প্ৰচারিত সংবাদপত্রের পাতা, সর্বত্র সমালোচনার ঝড় বয়ে যেতে লাগলো। চিকিৎসায় গাফিলতির নিত্য নতুন দিক আবিষ্কার হতে লাগলো। রাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে বোধবুদ্ধিহীন পুলিশ নেমে পড়লো চিকিৎসকদের গ্রেপ্তারে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর অভিযোগের সেই আইনি ধারা কে কাজে লাগিয়ে যা দিয়ে বেপরোয়া লরি চালককে গ্রেপ্তার করা হয়।
২৩# জন্ম নিল মানুষের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ বিক্ষোভ। পাছে তীরটা তার দিকে ঘুরে যায় এই ভয়ে সরকার আবার সেই কৌশল নিল। জন্মদিল নতুন কর্পোরেট হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ আইনের। কিন্তু ভুলেও বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নিল না। মানুষ চাইল স্বাস্থ্য নিরাপত্তা আর তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল শুকনো আইনের একটুকরো কাগজ।
২৪# যখন মানুষ মরিয়া হয়ে, সর্বস্বান্ত হয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করে এবং সেই কিছুটা হল তার প্রিয় জনের প্রাণ তখন স্বভাবত ই তার মনে এক আকাশচুম্বী প্রত্যাশার। সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে হতাশার পাশাপাশি তার মনে জন্ম নেয় অক্ষমের ক্রোধ। সেই ক্রোধ বা ক্ষোভ যদি সঠিক পথে পরিচালিত না করা যায় তাহলে সেটা বহুক্ষেত্রেই ধ্বংসাত্মক দিকে চলে যায়।
২৫# অন্যদিকে সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মানুষের অভিজ্ঞতা তিক্ত থেকে তিক্ততর হতে লাগলো।
পরিকাঠামোর ঘাটতির অবশ্যম্ভাবী ফলাফল স্বরূপ করদাতা সাধারণ নাগরিক পেল দাঁড়ালো দম বন্ধ পরিবেশে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিটের পরার্মশ, জীবনদায়ী পরীক্ষার তারিখ পরের দিনের বদলে তিন মাস বাদে পাওয়া, জরুরি আপদকালীন ভর্তির জন্য, একটি হাসপাতাল শয্যার জন্য এদিক থেকে ওদিক উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি, হয়রানির অভিজ্ঞতা।
২৬# একদিকে প্রতারণার শিকার এর কাহিনী তো অন্যদিকে হয়রানির। এই ক্ষুব্ধ মানুষ প্রতিবাদের জন্য বেছে নিতে শুরু করলো হাতের কাছে সহজলভ্য লক্ষবস্তু – পরিষেবা দিতে দিতে ধস্ত, ক্লান্ত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের। নেমে আসতে শুরু করলো একের পর এক ছোট বড় শারীরিক নিগ্রহের ঘটনা। প্রতিবাদ ক’রে, প্রতিশোধ নিয়ে ডাক্তারের হাত পা ভেঙ্গে, তাকে বিষ্ঠা মাখিয়ে, নার্সের গালে চড় কষিয়ে, তার শ্লীলতাহানি করে আপাত তৃপ্ত জনতা বাড়ি ফিরে গেলেন। ভুলেও ভাবলেন না, সবই হ’ল, খালি প্রতিকারটুকু হ’ল না।
২৭# এই অলীক কুনাট্যে রাষ্ট্রযন্ত্র মুখ্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা নিল। কারন তার অপদার্থতা, তার নীতি-পঙ্গুত্ব এতে ঢাকা পড়ে গেল। রাষ্ট্রযন্ত্র তখনই নীরব থেকে সরব হ’ল যখন সে মানবদরদী সাজতে গিয়ে সুকৌশলে নিজের অপদার্থতার দায় চাপিয়ে দিল চিকিৎসকের একাংশের অনৈতিক আচরণ আর সীমাহীন লোভের দিকে। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই কৌশল আরো বেশি করে উস্কে দিল জনমানুষের অসহিষ্ণুতা। চিকিৎসক দেবতার আসন থেকে আগেই স্থানচ্যুত হয়েছিলেন। এবার তাকে দেওয়া হল অসুর এর তকমা। গণশত্রু।
২৮# চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা আর সাম্প্রতিক কালে বিচ্ছিন্ন দু একটা ঘটনায় সীমাবদ্ধ নেই। দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় এজাতীয় ঘটনা না থাকাটাই ব্যতিক্রম হয়ে উঠছে। সাধারণ নাগরিকদের গা-সহা হয়ে যাচ্ছে। ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে তাদের অনুভুতিগুলো। তারা আর চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনায় উদ্বেলিত, উদ্বিগ্ন হন না। গ্রামের প্রান্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নবীন চিকিৎসকের গায়ে বিষ্ঠা লেপন থেকে শুরু করে ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট হাসপাতালের প্রবীণ চিকিৎসকের রক্তাক্ত মুখ সবই সয়ে যেতে শুরু করেছে বিবেকবান সহ নাগরিকদের।
২৯# এর বিষময় ফল ফলতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকই আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। স্রেফ পিঠ বাঁচানোর তাগিদে বিশেষজ্ঞদের কাছে রেফার এর সংখ্যা, বাড়ছে যেকোনো অসুখে মাথায় চুল থেকে পায়ের নখ অবধি পরীক্ষা করার জন্য টেস্ট এর সংখ্যা। সরকারি চাকরি থেকে আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ বা এমনি বসে যাওয়া চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ছে। নবীনরা ভিন দেশে পাড়ি জমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এসব দেখে শুনে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ডাক্তারি পড়াশোনা বেছে নেবেন কিনা তাই ভাবতে শুরু করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে চিকিৎসক নাগরিক অনুপাত আরো খারাপ হবে। সহ-নাগরিকদের ভাববার সময় এসেছে রুগী ছাড়া যেমন ডাক্তারি পেশাটা বাঁচবে না তেমনি ডাক্তার ছাড়াও রুগীরা বাঁচবে না। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এই দুর্বিষহ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছু সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেবার।
৩০# গণ-অসহিষ্ণুতার এই বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিকায় প্রকৃত পেশাদার হিসেবে চিকিৎসকদের দায়িত্ব থেকে যায় নিজের ইন্টেলেকচুয়াল সুপিরিওরিটি এর উচ্চ আসন থেকে নেমে এসে সহজ সরল ভাষায় রোগীর বাড়ির লোককে তারমত সহজবোধ্য ভাষায় সবকিছু বুঝিয়ে বলা যাতে তারা গ্রাহক হিসেবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সরকারি হাসপাতালের হাস্যকর রুগী-চিকিৎসক অনুপাতের প্রেক্ষিতে এই আশা ক’বে সফল হবে কেউ জানে না।
৩১# রাষ্ট্রের এই পাহাড় প্রমাণ ব্যর্থতার কাহিনী সহ-নাগরিকদের কাছে তুলে ধরলেই দায়িত্ত্ব শেষ হয়ে যায় না। অথবা সতীর্থ চিকিৎসকদের এক অংশের হিরন্ময় নীরবতার দিকে আঙ্গুল তুলে ধরলেও দ্বায়িত্ব শেষ হয় না। এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথনির্দেশ দিতে হবে। রাষ্ট্র যেমন বাধ্য করছে তার বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা ভাবনা করতে হবে, বাজার অর্থনীতির প্রবক্তাদের তৈরি করা মাকড়শার জাল চোখের সামনে থেকে সরিয়ে তাকাতে হবে চারপাশে। সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল তৈরি করতে হবে।
৩২# হাসপাতালগুলির পরিচালকদের দায়িত্ত্ব থেকে যায় রুগী বা তার লোকজনদের ওই চিকিৎসার সম্ভাব্য বিজ্ঞানভিত্তিক ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করা, মুনাফার দিকে তাকিয়ে অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দেওয়া থেকে বিরত থাকা, অপ্রয়োজনীয় ওষুধপত্র বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা লেখা থেকে একশ্রেণীর চিকিৎসককে বিরত করা এবং দ্রুত ও বিশ্বাসযোগ্য একটি ক্ষোভ-প্ৰশমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৩৩# রাষ্ট্রযন্ত্রের আশু দায়িত্ব মূলতঃ তিনটি ক্ষেত্রে। প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল থেকে হাসপাতালে নিগৃহ সহ সকল প্রকার বিশৃঙ্খলার ঘটনাকে খোলাখুলি নিন্দা করা, দোষীদের খুঁজে বার করে দ্রুত শাস্তি বিধান করা এবং হাসপাতালগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা ইত্যাদি।
৩৪# এর পাশপাশি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্হা হিসেবে রুগীদের পক্ষ থেকে দায়ের করা অভিযোগগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি র ব্যবস্থা করা, একটি সবল জন সংযোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, বিজ্ঞান সম্মত একটি নজরদারি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা ইত্যাদি
৩৫# দীর্ধমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় সংকোচনের নীতি থেকে সরে এসে স্বাস্থ্যখাতে ব্যায়বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, পরিকাঠামোর উন্নতি করা।
৩৬# একজন চিকিৎসক দেবতা বা দানব কিছুই নন, বরং আর পাঁচ জনের মতোই একজন সাধারণ মানুষ যার খালি একটি শাস্ত্রে বিশেষ শিক্ষন-প্রশিক্ষণ আছে এই সত্যিটা সহনাগরিকরা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন ততই মঙ্গল। তারা সবাই অর্থলোলুপ হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই যে এদ্দিনে ভেঙে পড়তো এটা বোঝা ও বোঝানো প্রয়োজন।
৩৭# কোনো কাজটাই বলা যত সহজ করা তত সহজ নয়। রাজনৈতিক দলগুলো এইসব কর্মসূচি কবে নেবে সেই ভরসায় বসে থেকে লাভ নেই। যেকোনো রাজনৈতিক নেতা বা সরকারি আমলার থেকে সমস্যার গভীরে গিয়ে তার সমাধান খোঁজার মত বুদ্ধি বিবেচনা বোধ ও অভিজ্ঞতা একমাত্র চিকিৎসকদেরই আছে।
৩৮# কেবল নিজেকে বা সহকর্মীকে দৈনন্দিন নিগ্রহ লাঞ্ছনার ভয়, গ্রেপ্তার হয়ে যাবার ভয় থেকে মুক্ত করার তাগিদে শুধু নয়, তার স্ত্রী পুত্র কন্যা পরিবার কে মানসিক উদ্বেগ থেকে মুক্ত করার তাগিদ শুধু নয়, তার অসংখ্য প্রিয়জন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব সহ সমগ্র সমাজ কে এই অসহনীয় অবস্থা থেকে রেহাই দেবার তাগিদে ছোট থেকে বড়, সরকারি থেকে বেসরকারি, নবীন থেকে প্রবীণ, দলমত নির্বিশেষে চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে।
৩৯# আতঙ্কিত চিকিৎসকরা সত্যিই নিগ্রহের ভুত দেখতে শুরু করেছেন। কাজের দিনটি শুরু করার সময় কেউ জানেন না দিনটা কেমন কাটবে
সবাই ভাবছেন আজ আমার নিগৃহীত হবার পালা নয়তো। এই ভাবনা থেকে চিকিৎসকরা জোট বাঁধছেন। সরকারের দরজায়, আদালতের দরজায় যাচ্ছেন আবেদন নিবেদন নিয়ে। রাস্তায় নামছেন মিছিল করতে। দাবি তাদের সুরক্ষা চাই, নিরাপত্তা চাই, নিগ্রহের আতঙ্ক থেকে মুক্তি চাই।
৪০# যে সভ্য সমাজ চিকিৎসককে বাধ্য করে নিরাপত্তার দাবিতে রাস্তায় নামতে সেই সমাজের আত্মনিরীক্ষন প্রয়োজন। এবং আশু প্রয়োজন। সাধারণ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে এই চিকিৎসক নিগ্রহের প্রতিবাদ করতে হবে দ্বিধাহীন ভাষায়। মনে রাখতে হবে কোনো কারণ, কোনো যুক্তি দিয়ে চিকিৎসাকর্মী নিগ্রহের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা যায় না।
৪১# তাই সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসকদের ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সংগঠনগুলিকেই দলমত নির্বিশেষে এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ তৈরি করবে চিকিৎসকদের সুরক্ষা বলয়।
৪২# “স্বাস্থ্য কোন পণ্য নয়, এটা মৌলিক অধিকার” – এই স্লোগান চিকিৎসকদের নেতৃত্বে সকল স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদেরই তুলতে হবে। সাধারণ মানুষকে এই স্লোগানে গলা মেলাতে হবে তার স্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে। তবেই রাষ্ট্রকে বাধ্য করা যাবে চিকিৎসককে দৈহিক নিরাপত্তা ও সাধারণ মানুষ কে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে তার দায়িত্ব পালনে।
৪৩# চিকিৎসক দেবতা নয়, দানব নয়, চিরন্তন আশাবাদী এক মানব যে সাহস করে রোগ ও মৃত্যুর সাথে অসম লড়াই এ অভ্যস্ত। পালিয়ে যাওয়া ধাতে নেই, সে আক্রমণ এর মুখোমুখি হোক কিংবা অসুখের।
এই লড়াইতে ওই আশা আর সাহসটুকুই তো সম্বল।
“ভয় করার কিছু আর নেই, জয় করার জন্য পড়ে আছে সারা মানুষের মন।”