সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী ইন্দো-চীন ঐক্যের প্রতীক ডাঃ কোটনিস
‘ডাঃ কোটনিস, আমাদের ভারতীয় বন্ধু, সুদূর চীনে এসেছিলেন আমাদের প্রতিরোধ-যুদ্ধে সাহায্য করতে। ইয়েনান ও উত্তর চীন মিলিয়ে পাঁচ বছর কাজ করেছেন তিনি, আমাদের আহত সেনাদের চিকিৎসা করেছেন এবং অবিশ্রাম পরিশ্রমের দরুন অসুস্থ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। চীনের গণমুক্তি ফৌজের এক সহযোগী হাত আজ হারিয়ে গেল, চীনা জাতি তার এক বন্ধুকে হারালো। তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদী মননকে আমরা যেন চিরকাল মনে রাখি’–মাও সে তুং যাঁর প্রয়ানে একখন্ড রাইস পেপারে নিজের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফিতে এই শোকবার্তা লিখে পাঠিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ না, ভারত-চীন মৈত্রীর সবচেয়ে বড় প্রতীক ডাঃ দ্বারকানাথ শান্তারাম কোটনিস।
চৌ এন লাই তাঁর শোকবার্তায় লিখলেন, ‘ডাঃ কোটনিস মহান চীন-ভারত মৈত্রীর প্রতীক এবং জাপ তথা বিশ্ব ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় জনগণের প্রোজ্জ্বল প্রতীক।’
ম্যাডাম সান ইয়াৎ সেন লিখলেন, ‘তাঁর স্মৃতি শুধু ভারত বা চীনের জনগণের কাছেই উজ্জ্বল থাকবে তা নয়, সমগ্র মানবজাতির স্বাধীনতা ও প্রগতির জন্য নাম লেখানো প্রত্যেক যোদ্ধার কাছে তা চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। বর্তমানের চেয়েও ভবিষ্যৎ তাঁকে অনেক বেশী শ্রদ্ধা নিবেদন করবে, কেননা তাঁর সংগ্রাম ছিল ভবিষ্যতের জন্য।’
মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯১০ সালে আজকের দিনে তাঁর জন্ম। ১৯৩৮ সালে মুম্বাইয়ের শেঠ জিএস মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে এমডি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় খবর এলো জাপানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত চীনা বাহিনীর সাহায্যার্থে সেদেশে এক মেডিক্যাল মিশন পাঠানোর আবেদন এসেছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কাছে। সভাপতি নেহরুকে চিঠি লিখেছেন এইটথ্ রুট আর্মির কম্যান্ডার-ইন-চিফ চে তু। সঙ্গে মাও-এর দু’লাইনের নোট, ‘আমাদের মুক্তি, ভারতীয় ও চৈনিকদের মুক্তি দুনিয়ার সমস্ত নিপীড়িত, শোষিত মানুষের মুক্তির দিশা দেখাবে।’ ঐবছর ফেব্রুয়ারীতে হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হলেন সুভাষচন্দ্র বসু, যিনি তার আগের বছর অক্টোবর মাসেই ‘মডার্ন রিভিউ’-এ চীনে জাপ আগ্রাসনের বিরোধিতায় এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘জাপান’স রোল ইন দ্য ফার ইস্ট’। নেতাজীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেডিক্যাল মিশনে স্বেচ্ছাসেবক হতে সাতশতাধিক চিকিৎসক আবেদন করলেও বেছে নেওয়া হল পাঁচজনকে – এলাহাবাদের ডাঃ মদনমোহন লাল অটল, নাগপুরের ডাঃ এম চোলকার, কোলকাতার ডাঃ দেবেশ মুখার্জী ও ডাঃ রণেন সেন এবং মুম্বাইয়ের ডাঃ কোটনিস। ডাঃ সেন (যিনি পরে সিপিআই জাতীয় পরিষদের সদস্য হন; দুবার বিধায়ক ও দুবার বারাসত থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন) কমিউনিস্ট ছিলেন বলে দেশ ছাড়ার সরকারী অনুমতি পেলেন না। তাঁর জায়গায় কোলকাতা থেকেই ডাঃ বিজয় কুমার বসু গেলেন মিশনে। এর কয়েকবছর আগে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত স্পেনে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল মিশনে যাবার অভিজ্ঞতা ছিল ডাঃ অটলের, তাই তিনিই এবার দলপতি। নেতাজীর উদ্যোগে ১২-ই জুন চীন দিবস পালিত হয়, জুলাই মাসে সারাদেশে তিনদিন গণসংগ্রহ চলে, মিশনের জন্য ২২ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। একটি অ্যাম্বুল্যান্স কিনে পাঠানো হল চিকিৎসকদের সঙ্গে। নেতাজী হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিলেন ডাঃ মুখার্জী ও ডাঃ বসুকে, সরোজিনী নাইডু ১-লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮, বোম্বাই বন্দরে বিদায় জানালেন পাঁচজনকে। জাহাজে য়ুহান অব্দি গিয়ে প্রথমে তাঁরা কুয়োমিনতাং বাহিনীর খপ্পরে পড়লেন। ওদের আস্তানায় তাঁরা প্রত্যক্ষ করলেন বিভিন্ন স্তরের অফিসার ও সেনাদের মধ্যে ভেদাভেদ, বৈষম্য ও জাল ওষুধের কারবার। দ্রুত মোহভঙ্গ হতেই তাঁরা শিবির বদলের জন্য নিকটবর্তী কমিউনিস্ট গেরিলাদের ঘাঁটি সিচুয়ানে যোগাযোগ করে তাঁদের তত্বাবধানে দীর্ঘ স্থলপথ অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিম চীনে কমিউনিস্টদের তদানীন্তন সদর দপ্তর ইয়েনান পৌঁছাতে ফেব্রুয়ারি মাস এসে গেল। মাও এবং চু তে দুজনেই সশরীরে উপস্থিত থেকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন ভারতীয় চিকিৎসকদলকে। ততদিনে অবশ্য নানজিংয়ে জাপানী হানাদাররা ঘটিয়ে ফেলেছে শতাব্দীর নৃশংসতম গণহত্যা, ঘৃণ্যতম গণধর্ষণ, সাংহাইয়ের যুদ্ধে হেরে গেছে চিয়াং কাই শেকের কুয়োমিনতাং ও কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের জাতীয় প্রজাতন্ত্রী সেনাবাহিনী, বন্যায় পীতনদীর গতিপথ দক্ষিণে সরে গেছে একশো মাইল, চীনের সব বড় শহর চলে গেছে জাপানী সাম্রাজ্যবাদের দখলে, লং মার্চের সাফল্য মাওকে পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে পুনর্বহাল করেছে, তাঁর সাথে চৌ এন লাই, লিন বিয়াও, লিউ শাওকি, চু তে, দেং জিয়াওপিং প্রমুখের যৌথ নেতৃত্বে লালফৌজ গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে গেরিলা যুদ্ধে প্রত্যাঘাত হানতে শুরু করেছে।
ইয়েনানসহ সাঙ্কশি প্রদেশের উত্তরভাগ তখন লালফৌজের মুক্তাঞ্চল। সংখ্যায় বিপুল, আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত জাপ বাহিনীর ঝটিতি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে তাদের ঘাঁটি বদলাতে হয় ঘনঘন। উটাই পার্বত্য অঞ্চলের জিন-চা-জি সীমান্তে জোর লড়াই বেধেছে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল মিশন সেখানে পৌঁছে কাজ শুরু করবার কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন ডাঃ অটল ও ডাঃ মুখার্জী। বাকী তিনজন মোবাইল ক্লিনিকে দৈনিক গড়ে আটশো আহত সেনার চিকিৎসা করেছেন অক্লান্তভাবে। ডাঃ কোটনিস একনাগাড়ে ৭২ ঘন্টাও অপারেশন করেছেন। বছর ঘুরলে ফিরে গেলেন ডাঃ চোলকার ও ডাঃ বসুও। কিন্তু কোটনিস কমিউনিস্ট নেতাদের বললেন তিনি ফিরতে চান না, কারণ তিনি বিপ্লবের মতাদর্শকে ভালোবেসে ফেলেছেন।
ঐবছর নভেম্বরে খালিহাতে সার্জারি করতে গিয়ে সেপ্টিসিমিয়া হয়ে মারা গেলেন ডাঃ নর্ম্যান বেথুন। মাও সাঙ্কশি-চাহার-হেবেই সীমান্ত থেকে কোটনিসকে ইয়েনানে ফেরৎ এনে বেথুনের নামাঙ্কিত আন্তর্জাতিক শান্তি হাসপাতালের প্রথম সভাপতি করলেন। সেখানে বেথুনের সমাধি উদ্বোধন করতে গিয়ে কোটনিসের আলাপ হয় নার্সিং টিউটর গুও কিংলানের সঙ্গে, দুজনে প্রণয়ে আবদ্ধ হলেন। পাশাপাশি ডঃ বেথুন হাইজিন স্কুল অব জিনচ্যাজি মিলিটারি কম্যান্ডের লেকচারার হিসেবেও নিযুক্ত হন তিনি।
হাসপাতাল বলতেই আজকাল যে ইমারতের অবয়ব আমাদের চোখের সামনে ভাসে, এই হাসপাতাল সেরকম ছিলনা। নির্দিষ্ট কোন বিল্ডিংয়ে নয়, পরিস্থিতি অনুযায়ী গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, এক গুহা থেকে অন্য গুহায় ঘুরে বেড়াতো হাসপাতাল ও মেডিক্যাল স্কুল। লালফৌজের মুক্তাঞ্চলগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রের উপযোগী সোশ্যালাইজড্ ও ব্যাটলফিল্ড মেডিসিনের প্রবর্তন হয় নর্ম্যান বেথুনের হাত ধরে। বেথুনের যোগ্য উত্তরসূরী কোটনিস তাকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ফ্যাসিস্ট জাপ বাহিনীর ঘোষিত ত্রিফলা নীতি ছিল চৈনিকদের ‘সবাইকে খুন করো, সব বাড়িঘর পুড়িয়ে দাও, সব সম্পত্তি লুঠ করো’। জাপ বিমান হানায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পরিত্যক্ত হলে সেগুলোকে নিজেরাই যথাসম্ভব মেরামত করে নিত মেডিক্যাল টীম। মাটির বাড়ি অথবা পর্বতের গুহায় বাঁশের বেঞ্চ খাড়া করে অথবা ভেঙে যাওয়া দরজার পাটা ইঁটের উপর দাঁড় করিয়ে তৈরী হত অপারেশন টেবিল, রান্নাঘরের চুল্লীর ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া দেওয়ালকে ব্ল্যাকবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করা হত। কৃষকদের ঘরগুলোকে ওয়ার্ড বানিয়ে তার মেঝেতে ইঁট সাজিয়ে তার উপর ম্যাট্রেসের মত করে খড়-বিচালি বিছিয়ে পেশেন্টের বেড তৈরী হত। ভাতের হাঁড়িতে কয়লার উনুনে জল ফুটিয়ে সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করা হত। ঝর্ণা থেকে তুলে আনা জল দিয়ে মোমবাতির আলোয় অপারেশন চলত। সরবরাহ অপ্রতুল থাকায় গজ-ব্যান্ডেজ কেচে, শুকিয়ে পুনর্ব্যবহার করতে হত। দুটো মাইক্রোস্কোপ ছিল, যার একটা বেথুন সাহেব এনেছিলেন, আরেকটা রাশিয়া পাঠিয়েছিল। অল্প কিছু গ্লাস স্লাইড ধুয়ে ধুয়ে ব্যবহার করতে হত। গরম জামা যা ছিল তা রোগীদের দিয়ে ডাক্তার, নার্সরা কনকনে ঠান্ডায় লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে শরীর গরম করতেন। শত্রুহানায় হাসপাতাল ধুলিস্যাৎ হলে তাঁরা পুনর্নির্মিত করতেন কয়েক ঘন্টাতেই। আহত সেনার চিকিৎসায় যাতে সময় নষ্ট না হয়, ডাঃ কোটনিস ফায়ারিং লাইনেই খোলা আকাশের নীচে অপারেশন করতেন। প্রয়োজনে তাঁকে অপারেশন থামিয়ে বন্দুক হাতে গুলিও চালাতে হত। কোন ইউনিফর্ম পড়তেন না কেউ, যাতে সহজেই গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। কৃষকদের ঘরে ঠাঁই হত আহত সেনাদের। শত্রুর চর গ্রামে এলে কৃষক রমণীরা তাঁদেরকে ক্রস-ফায়ারিংয়ে আহত নিজের স্বামী, ভাই বা পুত্র বলে পরিচয় দিত। তাঁদের প্রতি মাওয়ের নির্দেশ ছিল, ‘মরণাপন্নকে উদ্ধার করা ও আহতের চিকিৎসা করার মাধ্যমে বিপ্লবী মানবতার চর্চা করো’
শত্রুবাহিনীর অগ্রসরের খবর পেলেই দ্রুত স্থানবদল করার সুবিধের জন্য ওষুধ, যন্ত্রপাতি বাক্সে রাখা হত। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাবার সময় রাস্তাই হয়ে উঠত চলমান ক্লাসরুম। সার বেঁধে হাঁটতে হাঁটতেই ডাক্তারীর পাঠ দিতেন কোটনিস ও অন্য চিকিৎসকরা, তাঁদের ঠিক পিছনে থাকা ছাত্ররা ইঁট দিয়ে নোট লিখে রাখত রাস্তার পাশে পাথরের গায়ে, পিছনের ছাত্ররা সামনে পৌঁছে সেগুলো টুকে নিত। কখনো কাগজে বড় হরফে নোট লিখে পিঠের ব্যাকপ্যাকে সেঁটে রাখতেন কোটনিস, পিছনের ছাত্ররা পালা করে তা পড়তে পড়তে হাঁটত। পথে কুকুর পেলে তাদের ধরে সার্জারির হাতেখড়ি করাতেন ছাত্রদের। কোটনিসের টীম ঐ একবছরে মোট ৪৩০-টি মেজর সার্জারি করেছিল, তার মধ্যে ৪৫-টি অ্যাম্পুটেশন, ২০-টি হার্নিয়া, ৩৫-টি লাম্বার ও প্রিস্যাক্রাল প্যারাসিম্প্যাথিয়েক্টমি, গ্যাস্ট্রো-এন্টেরোস্টমিসহ বেশ কয়েকটি জটীল অ্যাবডমিনাল সার্জারি ছিল। প্রতি সপ্তায় রিভিউ মিটিং করতেন প্রত্যেকটা কেস ধরে ধরে। শুরু করতেন আত্মসমালোচনা দিয়ে, তারপর অন্যদের ভুল ধরিয়ে দিতেন। একে একে সকলকেই তা করতে হত। সদাহাস্য, রসিক মানুষ ছিলেন তিনি, প্রত্যেকের সঙ্গে বন্ধুর মত মিশতেন। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত কড়া।
কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। দেখেছেন নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের জীবনযাত্রায় কোন ফারাক নেই। মাও নিজে কৃষকদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খান, সেনাদের সঙ্গে মেঝেতে ঘুমান, কমরেডদের পায়ে পা মিলিয়ে দুর্গম পাহাড় জঙ্গলে হেঁটে যাতায়াত করেন। দেখেছেন ডান হাতের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় বাঁ হাত দিয়ে পার্টির জন্য লিখতে চেষ্টা করছেন চৌ এন লাই। ১৯৪২-এর ১-লা এপ্রিল কোটনিস ডাঃ বসুকে চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি ইয়েনানে পৌঁছানোর আগে কিরকম পশ্চাদপদ ছিলাম তুমি জানো, আমার মাথায় বুর্জোয়া ধ্যানধারণা গিজগিজ করত। জাতীয়তাবাদী আবেগে টইটম্বুর থাকতাম আমি, বিপ্লবী নিয়মনীতি সম্পর্কে ধারণা ছিল অস্পষ্ট। এখানে গত একবছর এইটথ রুট আর্মির একজন হয়ে থাকার সময়, মিটিংয়ে বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কমরেডদের কাছে সমালোচিত হয়ে আমার নিজের চরিত্রে, চিন্তাচেতনায় একটা বড়সড় পরিবর্তন এসেছে বলে টের পাচ্ছি’। ১৯৪২-এর ৭-ই জুলাই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ পান। ডাঃ বসুও দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ত্রিপুরাতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও বিস্তারে, এদেশে আকুপাংচারের প্রসারে এবং বাংলায় পিপলস্ রিলিফ কমিটি গঠনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল।
জিনচ্যাজিতে থাকার সময় কোটনিস গুও কিনলানকে বিয়ে করেন, তাঁদের এক পুত্রসন্তান হয়, ভারত-চীন মৈত্রীর কথা মাথায় রেখে যাঁর নাম রাখা হয় ইনহুয়া (ইন=ইন্ডিয়া, হুয়া=চীন)। অল্পদিনের মধ্যেই কোটনিস ঝরঝরে ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে শিখেছিলেন। টেক্সট বই অমিল ছিল বলে ছাত্রদের জন্য তিনি দুটি বই লিখেছেন – ‘জেনারেল ইন্ট্রোডাকশন টু সার্জারি’ ও ‘সার্জারি ইন ডিটেইল’। দ্বিতীয়টি অসম্পূর্ণ, ১৭৭ পৃষ্ঠাটি লিখতে লিখতেই তাঁর এপিলেপ্টিক সিজার হয় এবং তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র ৩২ বছর বয়সে।
তাঁর প্রয়ানের পর চীনের পার্টি, সরকার, সর্বোপরি জনগণ যে অভূতপূর্ব আন্তরিকতার সঙ্গে শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করেছে, আজও তাঁকে যেভাবে স্মরণ করা হয় ওদেশে, তার কোন তুলনা নেই। চীনের জনগণ যে দশজন ভিনদেশী বন্ধুর কথা চিরকাল মনে রেখেছে, ডাঃ কোটনিস তাঁদের অন্যতম। চীনা রাষ্ট্রনায়করা কেউ এদেশে এসেছেন আর শোলাপুরে কোটনিসের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাননি, এমন হয়নি। তাঁর পরিবারের তেরোজনকে ওদেশের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছেন, কোটনিসের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন তাঁরা। হেবেই প্রদেশের শিজিয়াঝুয়াংয়ে শহীদস্মৃতি পার্কের পশ্চিমদিক ডাঃ বেথুনের জন্য ও দক্ষিণদিক ডাঃ কোটনিসের নিবেদিত। সহস্রাধিক মানুষ সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে যান বছরভর, কিংমিং উৎসবে ফুলে ঢেকে দেন পুরো পার্ক। তাঁর নামাঙ্কিত একাধিক স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে ওদেশে। তাঁদের পুত্রের অকালমৃত্যুর পরেও তাঁর স্ত্রী শোলাপুর তথা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ অটুট রেখেছেন আমৃত্যু। ভারত-চীন সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান হোক বা পিপল্-টু-পিপল্ প্রোগ্রাম হোক, কোটনিসকে বাদ দিয়ে কিছু সম্ভব নয়। দু’দেশের তরফেই ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে তাঁর স্মরণে। ১৯৪৬ সালে খাজা আহমেদ আব্বাসের লেখা ‘অ্যান্ড ওয়ান ডিড নট কাম ব্যাক’-এর চলচিত্রায়ন করেন ভি শান্তারাম, ‘ডক্টর কোটনিস কি অমর কহানী’। চীনেও ১৯৮২ সালে তাঁকে নিয়ে ‘কে দেহুয়া দাই ফু’ নামে একটি চলচিত্র তৈরী হয়। প্রসঙ্গতঃ, কোটনিস ওদেশের ভাষায় ‘কে দেহুয়া’ নামেই অধিক পরিচিত।
ডাঃ কোটনিসের আত্মত্যাগের অমলিন ইতিহাস সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী ইন্দো-চীন ঐক্য ও মৈত্রীর ইতিহাস। এই ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার চেষ্টাকে সফল হতে দেওয়া যাবে না কোনভাবেই।