গভীর জঙ্গলের একেবারে ভেতরে, যেখানে গাছগুলো প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে, সেখানে তাদের গুঁড়িগুলো এত মোটা যে দশটা লোক মিলেও হাত মেলে বেড় দিতে পারে না। সেখানে গাছের ডালে-ডালে, পাতায়-পাতায় জড়িয়ে আকাশ ঢেকে আঁধার হয়ে যায়। সেখানে দিনের বেলায় জঙ্গলের মাটিতে সবুজ অন্ধকার, ঝোপঝাড় লতাপাতা এতই ঘন, যে চলার পথ নেই। সেইখানে, উঁচু গাছের একেবারে মগডালে উঠলে হঠাৎ ডালটা ঘন পাতার ভেতর থেকে যখন খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে আসে, তখন ঝকঝকে সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়! এতক্ষণ গভীর জঙ্গলের মধ্যে বোঝা-ই যায়নি বাইরে কত আলো, আকাশটা কত নীল, আর তাতে টুকরো টুকরো কত সাদা মেঘ। মাটিতে আর গাছে যে পশুপাখিরা ঘুরে বেড়ায় এখানে তারা নেই। সেখানে মাকড়সা, কেন্নো, শামুক আর পিঁপড়েদের ভীড়। তাদের পেছনে পেছনে আসে সেইসব প্রাণীরা যারা ওদের খায়… ইঁদুর, সাপ, গিরগিটি, বেজি… গাছের ওপর দিকে বেয়ে ওঠে কাঠবিড়ালি, বানর… আর উড়ে বেড়ায় পাখির ঝাঁক — যারা হয় ফুলের মধু খায়, নয়তো মধু খেতে আসা পোকাদের ধরে ধরে পেট ভরায়।
আর যেখানে গাছ শেষ হয়ে গেছে, তারও ওপরে, খোলা হাওয়ায় আকাশের নিচে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় আর একরকম পাখি। তারা জঙ্গলের ভেতরের ছোটো ছোটো মেটে রঙের বা সাদা-কালো পাখি নয়, উজ্জ্বল লাল-নীল রঙ-ও তাদের নেই। তারা জঙ্গলের পাখিদের মতো ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ এধার-ওধার উড়ে-উড়ে, খুঁটে-খুঁটে দানা, বা পোকামাকড় ধরে-ধরে খায় না। ওরা বড়ো পাখি। মস্তো ডানা মেলে খোলা আকাশে ওড়ে। ওরা ডানা ঝাপটায় কম, দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন শূন্যে ভেসে রয়েছে… হঠাৎ দেখা যায় ডানাটা একটু ভাঁজ করে, বা লেজটা বাঁকিয়ে হু-হু করে উড়ে চলে গেল অনেক দূর। শিকার দেখতে পেয়েছে।
ওরা শিকারী পাখি। ওরা ইগল।
ঈগলরা বাসা করে গাছের মগডালে। এরাও তাই করেছে। একেবারে ওপরের ডালে নয়। ওখানে ডালগুলো বড্ড সরু সরু। মস্তো ঈগলের বিশাল বাসা অত ছোটো ডালে দাঁড়ায় না। তাই অনেক উঁচুতে যেখানে মোটা ডাল গাছের গা থেকে বেরিয়েছে, সেইখানেই ওরা বাসা বাঁধে। প্রত্যেক বছর একই জায়গায় এসে একই বাসাতে ডিম পাড়ে। বাচ্চা বড়ো হলে সবাই বাসা ছেড়ে চলে যায়, আবার পরের বছর এসে সেই বাসাটাই কাঠ-কুটো দিয়ে সারিয়ে তুলে আবার ডিম পাড়ে। এমনি করে বছরের-পর-বছর বাসাটা বড়ো আর ভারি হয়ে যায়। শেষে একদিন নিজের ওজনেই, ঝড়ে-বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে যায়। পরের বছর ইগলরা নতুন করে শুরু করে বাসা বাঁধা।
এ বছর ঈগলরা একটাই ডিম পেড়েছে। তাই আজ বাসায় একটাই বাচ্চা। এখন একটু বড়ো হয়েছে। এখনও উড়তে পারে না, কিন্তু হেঁটে হেঁটে বেরিয়ে বাসার ধারে দাঁড়ায়, বা ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে ডালের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এদিক ওদিক দেখে। খিদে পেলে আকাশের দিকে মুখ তুলে খোঁজে, কখন মা-বাবা আসবে খাবার নিয়ে। মা, বা বাবা, যে-ই শিকার করে, সে-ই খাবার নিয়ে আসে ওর জন্য। ও যখন একেবারে ছোটো ছিল তখন মা-বাবা খাবার খেয়ে ফিরত। বাসায় ফিরে অর্ধেক হজম করা মাংস বের করে দিত ওর জন্য। এখন ও অনেকটাই বড়ো। ওর জন্য আর খাওয়া মাংস আনে না মা বাবা। ঠোঁটে ধরে নিয়ে আসে একটা খরগোশের, বা বানরের টুকরো, কখনো বা একটা গোটা কাঠবিড়ালি। বাচ্চাটা এখন ধারালো ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে মাংসটা গিলে নিতে পারে মা-বাবার সাহায্য ছাড়াই।
আজকে আকাশটা খুব নীল। অনেক সাদা মেঘ। হাওয়ার টানে মেঘগুলো তরতরিয়ে আকাশ বেয়ে দূর দেশে কোথায় চলে যাচ্ছে। সূর্যের আলো যখন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ছে তখন ইগলের বাসায় ছায়া পড়ছে, আর হু-হু হাওয়ায় মেঘ যখন সরে গিয়ে রোদ বেরিয়ে আসছে তখন আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। যতবার ছায়া আসছে আর যতবার আলো বেরোচ্ছে, বাচ্চাটা ভয়ে চমকে চমকে উঠছে।
কাল থেকে বাবা খাবার নিয়ে ফেরেনি। মা সন্ধেবেলা এসেছিল একটা ছাগলের পা মুখে নিয়ে। অনেকটাই মাংস ছিল তাতে। তাই বাচ্চাটার এখনো পেট ভর্তি — এক্ষুনি খাবার না হলেও চলবে।
রোজের মতো আজ সকালেও মা রোদ্দুর চড়া হবার কিছুক্ষণ পরে বাসা ছেড়ে উড়ে গেছে। ওরা ভারি পাখি। ওদের ওজন বেশি। ডানা ঝাপটে উড়তে কষ্ট হয়। তাই ওরা অপেক্ষা করে কতক্ষণে সূর্যের আলোয় গরম হয়ে মাটি তেতে উঠবে… গরম হাওয়া মাটি থেকে সূর্যের দিকে ঠেলে উঠবে। সেই হাওয়ায় ডানা মেলে ওরা ভেসে বেড়ায়। তাকিয়ে থাকে নিচে — কোথায় দেখা যাচ্ছে শিকার?
দুপুরবেলাও মা ফিরল না। এতক্ষণে বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে। সারা সকাল হু-হু হাওয়ায় নিজের ডানা দুটো মেলার চেষ্টা করেছে। যদি মা-বাবার মত উড়ে যেতে পারে? কিন্তু যতবার ডানাটা অর্ধেক খুলেছে ততবার দমকা হাওয়ায় প্রায় ছিটকে উড়ে গেছে ডাল থেকে। দু’তিনবার শেষ মুহূর্তে প্রাণপণে পা দিয়ে ডালটাকে আঁকড়ে ধরে তড়িঘড়ি ডানা বন্ধ করেছে আবার। ভয় পেয়েছে উড়ে চলে গেলে যদি আর ফিরতে না পারে?
দুপুরের পর বাসায় পড়ে থাকা হাড়গোড়ে লেগে থাকা শুকনো মাংস আর কচকচি অংশগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে কোনও রকমে গিলে ফেলল। শক্ত, ধারালো ঠোঁট দিয়ে লম্বা হাড়গুলো ভেঙে তার ভেতর থেকেও যতটুকু পারে মজ্জা বের করে নিল। এতে খিদে একেবারে মিটলো না বটে কিন্তু খিদের জ্বালাটা তবু সহ্য করবার মত হয়ে এল।
সূর্য ঢলে পড়েছে — এখন তার আর অত তেজ নেই। এখন আর গরম হাওয়ার স্রোতে গা ভাসিয়ে ঈগলরা, বা চিল শকুনরা আকাশে ভেসে থাকতে পারবে না। বাসায় ফিরতে হবে। পশ্চিমের আকাশটা যখন কমলা থেকে লাল হয়ে প্রায় বেগুনি রং ধরেছে, তখন ডানা ঝটপট করে এসে বসলো মা ইগল — মুখে একটা কাঠবিড়ালি।
বাচ্চার সামনে কাঠবিড়ালিটা ফেলে দিয়ে মা ইগল সরে গেল। মুখ নামিয়ে খেতে গিয়ে বাচ্চাটা হঠাৎ বুঝল কাঠবিড়ালিটা এখনো জ্যান্ত! প্রাণ বাঁচাতে প্রাণপণে ঝাঁপ দিয়েছে ঈগলের বাসা থেকে বেরিয়ে পালাবার জন্য। কিন্তু ইগলের বাচ্চাটা কি ছেড়ে দেবে! খিদেয় ছটফট করছে যে! তীরবেগে ছোঁ মারলো আর কাঠবিড়ালিটা প্রায় সবটাই খেয়ে ফেলল এক গরাসে। ওর মা বাসা ছেড়ে ডালের ওপর দিয়ে বসলো। বাসায় পড়ে থাকা শুকনো হাড়গোড় দেখে ও বুঝেছে ওর বাবা সারাদিন বাচ্চাকে খাওয়াতে ফেরেনি। এটাই ওদের নিয়ম। বাচ্চা যখন ছোটো থাকে তখন ওরা দূর দূর থেকে খাবার খেয়ে ফেরে। বাসায় বাচ্চার জন্য মুখ থেকে বের করে দেয় খানিকটা হজম হওয়া মাংসের টুকরো। আস্তে আস্তে বাচ্চারা বড়ো হলে ওরা গোটা মাংস নিয়ে আসে যাতে বাচ্চারা নিজেরাই সেটাকে ছিঁড়ে টুকরো করে খেতে শেখে। এবারে বাচ্চাটা আরও বড়ো হয়ে গেছে। বেশ অনেক দিনই হলো, ওকে ওরা জীবন্ত ছোটো ছোটো প্রাণী এনে দিচ্ছে যাতে ও শিকার করা শিখতে পারে। এটাই ওদের নিয়ম। এবারে বাচ্চাকে নিজেই শিকার করতে বেরোতে হবে। একা। এটাই নিয়ম।
অন্ধকার হয়ে গেছে। কাঠবিড়ালিটার শরীরে মাংস বেশি ছিল না, কিন্তু যতটুকু ছিল তাতে রাতটা ইগলছানার শান্তিতেই কাটবে। ছানাটা বাসার মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুল। অবাক হয়ে ভাবল, রোজের মতো মা এসে ওকে ডানা দিয়ে আগলে শুল না কেন? বাসা থেকে দূরে ডালের উপরেই বসে ডানায় মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল… কেন?
পরদিন সকালে সূর্য তখনও ওঠেনি কিন্তু আকাশ ফর্সা হয়েছে — মা ইগলের প্রবল ডানা ঝাপটানোর শব্দে বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে গেল। অবাক হয়ে দেখল সূর্য ওঠার আগের ঠাণ্ডা, ভারি বাতাসে অতিকষ্টে ডানা ঝাপটে ঝাপটে ওর মা উড়ে যাচ্ছে। গাছের মাথার ওপরে বেশি দূরে উঠছে না — প্রায় পাতাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়তে উড়তে ওর মা দেখতে দেখতে ভোরের আধো-অন্ধকারে মিলিয়ে গেল দূরে। একা বাসায় এদিক ওদিক তাকিয়ে বাচ্চাটা বুঝল ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে আবার। সন্ধেবেলা খাওয়া ছোট্ট কাঠবিড়ালিটা হজম হয়ে গেছে কখন! এখন ও বড়ো হয়েছে। অত অল্প খেলে পেট ভরে না। ভাবল হয়তো সে জন্যেই মা ভোর থাকতেই বাসা ছেড়ে চলে গেছে — খাবার নিয়ে আসবে। এই মনে করে ডানা ঝাড়া দিয়ে আবার গুটিসুটি বসলো বাসার মধ্যে।
কিন্তু বেলা বয়ে যায়, সূর্য উঠতে উঠতে প্রায় মাথার কাছে পৌঁছে যায়, মা আসে না। খিদের চোটে ইগলছানা আর কিছু ভাবতে পারছে না। সারা সকাল বাসায় পড়ে থাকা পুরোনো হাড়গুলো তুলে তুলে খুঁজেছে। যেটার গায়ে অল্প এতটুকুও মাংস লেগে ছিল সেটা জিভ আর ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে। ক্রমে দুপুর পেরিয়ে যায়… সূর্য ঢলে বিকেলের দিকে। সারা দুপুর হু-হু হাওয়ায় বাচ্চা ইগল বারবার ভেবেছে ডানা মেলে উড়ে যাবে, কিন্তু সাহস হয়নি। বেলা পড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ কমেছে, হাওয়াও কমছে আস্তে আস্তে। বিকেলের এই হাওয়াতে ডানা মেলে উড়ে আসে ওর মা। চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় গাছে গাছে পাখিরা ফিরে আসছে, কিন্তু ওর মা’র ফিরতে এত সময় লাগছে কেন? প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে তো!
দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে গেল। আকাশ থেকে মুছে গেল দিনের শেষ আলো। গাঢ় কালীর মত আকাশে এখন শুধু অজস্র তারা আর এক ফালি চাঁদ। ও জানে এত রাতে ও দেখতে পায় না যেমন, ঠিক তেমনই ওর মা-বাবাও রাতে দেখতে পায় না।
আজ রাতে মা আর আসবে না বুঝতে পেরে বাচ্চাটা খিদের জ্বালা সহ্য করে ঘুমোনোর চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা তো সহজ না। এতদিন পেট ভরে না হলেও সবসময়ই কিছু না কিছু খেয়ে ঘুমিয়েছে। আজ সারাদিন কিছুই প্রায় খায়নি। শুকনো-হাড়ে-লেগে-থাকা, রোদে-শুকিয়ে-যাওয়া মাংসের যতটুকু পেটে গিয়েছে তা হজম হয়ে গিয়েছে কবেই। অনেক কষ্টে ছটফট করতে করতে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুম ভেঙে গেল ভোর না হতেই। এখনও যদি মা খাবার নিয়ে না আসে তাহলে কী হবে? কিন্তু মা তো এখন আসতে পারবে না। রোদের তেজ চড়া না হলে মা আকাশে উড়ে শিকারও ধরতে পারবে না, মাংস নিয়ে আসতেও পারবে না। কী করবে ও? একটু আলো ফুটতে বাচ্চাটা লক্ষ করল গাছের ডালে পিঁপড়ের সারি ধরতে একটা গিরগিটি আস্তে আস্তে ওর বাসার খুব কাছে চলে এসেছে। ও জানে গিরগিটিরা খুব তৎপর প্রাণী। আশেপাশে নড়াচড়া হলেই তারা লাফিয়ে পালিয়ে যায়। তাই একেবারে পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে ঈগলের বাচ্চাটা বসে রইল। খেয়াল না করে গিরগিটিটা আস্তে আস্তে যখন খুব কাছে এসে গিয়েছে তখন হঠাৎ অতর্কিতে ঝাঁপ দিয়ে এক-ছোঁয়ে তুলে নিল তাকে মুখে। ভীষণ খিদে পাওয়া সত্ত্বেও গিরগিটির স্বাদ জিভে ঠেকলো খারাপ, কিন্তু আর ভাবার সময় নেই। কোনও রকমে গিলে ফেলে আবার আকাশের দিকে খুঁজতে শুরু করলো… মা কি আসছে? মা আসছে না, বাবা আসছে না, কেউ আসছে না। ইগলছানা ওর ছোট্ট বুদ্ধিতে বুঝতে পারছে আর কেউ আসবে না। এবারে শিকার ধরে নিজের খাবার নিজেই খেতে হবে।
হাওয়া এখনও শনশন করে বইছে। গাছের মাথায় বসা ইগলছানার মাথার ঝুটির পালক হাওয়ার টানে খাড়া হয়ে উঠেছে বারবার। ভাবছে এই সুযোগ, এখনই ডানা মেলে উড়ে যেতে হবে। ভয়ে ভয়ে ডালের শেষ প্রান্তে গিয়ে, যেখানে নিচে তাকালে অনেকটাই দেখা যায় সেখানে বসে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ডালটা। আগার দিকে ডালগুলো মোটা নয়। ইগলছানা পা দিয়ে শক্ত করে ধরে সাবধানে আস্তে আস্তে ডানা মেললো, কিন্তু কী কাণ্ড! আধখানা ডানা মেলা-মাত্র দমকা হাওয়া ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায় আর কী! প্রাণপণে ডালটা আঁকড়ে ধরল আবার, কিন্তু পাতলা ডালটা মুচড়ে প্রায় ভেঙে যাওয়ার জোগাড়! তাড়াতাড়ি ডানা বন্ধ করে আবার গিয়ে ডালের মোটা অংশে গিয়ে দাঁড়ালো ইগলছানা। বুকের ধুকপুকানি কমে যাবার পর আবার পেটের খিদেটা বুঝতে পারল। আর উপায় নেই। খাবারের খোঁজে এবারে যেতেই হবে। চোখ বুজে দমকা হাওয়ার সামনে ডানা মেলে দিল ইগলছানা। কিছু বোঝার আগেই এবারে হাওয়া ওকে ধরে টেনে নিয়ে গেল। চোখ খুলে যা দেখল তাতে এক লহমার জন্য ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছিল। মাটি থেকে বহু উঁচুতে, হওয়ার টানে ও উড়ে যাচ্ছে। নিচে যে গাছে ওর বাসাটা ছিল, সেটা ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে।
দেখতে দেখতে বাসাটা আর দেখা যায় না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেল কেবল অজস্র গাছের মাথা। এ সব গাছের মাথার উপরে ও যে যে প্রাণী ধরে খেতে পারে তারা কেউ নেই। কোথায় থাকে তারা? ইগলছানা জানে না। এদিক-ওদিক হাওয়ার স্রোতে উড়তে উড়তে হঠাৎ দেখল দূরে যেন একটা ছোটো বিন্দুর মতো পাখি দেখা যাচ্ছে। আর একজন ইগল। ইগলের চোখের খুব জোর। তাদের দৃষ্টিকে বলে শ্যেনদৃষ্টি। ইগলছানা দেখতে পেল… বাবা! নিজে নিজেই ওর লেজ কেমন যেন বাঁক নিতে শিখেছে। ডানা ভাঁজ করে হু-হু করে উড়ে চলল দূরে তার বাবার দিকে। কিন্তু বাবা তো উড়ে যাচ্ছে আরও দূরে। ওকে ধরতে পারবে না ইগলছানা, কিন্তু কিছুদুর যাবার পর দেখল নিচের ঘন জঙ্গল যেন পাতলা হয়ে আসছে। গাছগুলো এখন আর অত উঁচু-ও নয়, মোটাও নয়। কিছুক্ষণের মধ্যে গাছপালা শেষ হয়ে নিচে ঘাসজমি। লম্বা ঘাসের মধ্যে কোথাও শিং-ওয়ালা হরিণ, কোথাও বা জলের ধারে কুমির। এরা সকলেই বড় প্রাণী। এদের ধরে খাওয়া যাবে না। কিন্তু একটু পরেই দেখতে পেল ঘাসজমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল খরগোশ। দেখামাত্র ওর খিদে চাগাড় দিল… ডানায় ভর করে তীরবেগে ঝাঁপ দিল মাটির দিকে। কিন্তু ও তো শিকার করতে শেখেনি এখনও। ফলে ধরতে পারল না কাউকেই। কাছাকাছি পৌঁছনোর আগেই খরগোশগুলো কেমন লাফিয়ে, ছুটে গর্তে ঢুকে পড়ল। মাটির কাছে কাছে উড়ে ও গিয়ে বসল জলের ধারে। সেখানেই মুখ ডুবিয়ে জল খেল একটু। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল জলের পাশে কোনও একটা প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে আছে। হয়তো কেউ শিকার করেছিল, খেয়ে বাকিটুকু ফেলে রেখে গেছে। তাও চিল-শকুন খেয়ে গেছে বলে প্রায় কিছুই বাকি নেই। এখন পোকামাকড়ের মেলা, তবু যতোটুকু আধ-পচা মাংস হাড়ে লেগেছিল তা-ই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খানিকটা পেট ভরালো ইগলছানা। তারপর দেখল জলের ধারে এক ঝাঁক ছোটো ছোটো পাখি। তারা সকলে দল বেঁধে জল খেতে এসেছে। ডানা ঝাপটে মাটি ছেড়ে উঠল ইগলছানা। বেশি ওপরে না গিয়েই ঝাঁপ দিল পাখিদের দিকে। ওকে আসতে দেখে পাখির দল সকলে মিলে একসঙ্গে ডানা মেলে উড়ল। অজস্র ছোটো ছোটো পাখি… ইগলছানার সব গুলিয়ে যাচ্ছে… কাকে ফেলে কাকে ধরবে? কিন্তু বেশি দেরি করলে সবাই উড়ে চলে যাবে — তাই উড়ন্ত অবস্থাতেই পা বাড়িয়ে দিয়ে যে ছোটো পাখিটাকে কাছে পেল তাকে আঁকড়ে ধরল। তারপর শিকার নিয়ে উড়ে গেল জলের ধারে একটা উঁচু গাছের ডালে। সেখানেই খাওয়া শেষ করে জিরিয়ে নিল গাছের ডালে বসে।
বাচ্চা ইগলছানার প্রথম শিকার। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবার নতুন উদ্যমে ডানা মেলে উড়ল। এখন ও জানে শিকার ধরতে গেলে কী করতে হয়।
আজ জঙ্গল আর ঘাসজমির অনেক উপরে রোজই ওকে উড়তে দেখা যায়। ওর মা-বাবা কোথায় ও জানে না। মাঝে মাঝে দূরে আর একটা ইগলকে উড়তে দেখে… হয়তো সে তার মা… হয়তো সে বাবা। তাদের সঙ্গে ওর দেখা হয় না। ঘাসজমি আর জঙ্গলের পাশ থেকে শিকার ধরে, আর সন্ধের হলে জঙ্গলের উঁচু গাছের ডালে ঘুমোয়।
আর দূরে, জঙ্গলের গভীরে একটা উঁচু গাছের মগডালে একটা বাসা খালি পড়ে থাকে। পরের বছর আবার ইগলরা এসে সেখানে ডিম পেড়ে বাচ্চা বড়ো করবে।