বেলাল হোসেন স্যার ফেসবুকে একটি পোস্টে রোগীর বাড়ির লোকেদের এমারজেন্সি বোধ নিয়ে একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন। সেই লেখায় মন্তব্য করতে গিয়ে মনে হলো এই ধরনের এমারজেন্সি রোগী নিয়ে আমারও অভিজ্ঞতা কম নয়। প্রথমেই ওই পোস্টে যে মন্তব্য করেছিলাম সেটাই লিখি।
রোগীর বাড়ির লোকের কাছে সবই এমারজেন্সি।
ডক্টরস ডে’র নির্ভেজাল সত্যি কাহিনী। বাড়িতে রোগী দেখি দুপুর ১২ টা থেকে বিকাল ৪ টে। ৪ টের সময় এক মহিলা কন্ঠের ফোন। ‘ডাক্তার বাবু, আমার বাবাকে আপনার বাড়ি নিয়ে এলে একটু দেখে দিতে পারবেন।’
বললাম, ‘কাল আসুন। আমি এখুনি বেরিয়ে যাব।’
ওপাশের কণ্ঠস্বর কাঁদোকাঁদো, ‘ডাক্তার বাবু, আজই দেখে দিন না। খুব এমারজেন্সি।’
মায়া হলো। বললাম, ‘তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন তাহলে। আধঘন্টার মধ্যে আসুন।’
মহিলাকন্ঠ উত্তর দিল, ‘যদি আরেকটু দেরি হয়। আসলে বাবা সাইকেল নিয়ে একটু বেরিয়েছেন তো। কখন ফিরবেন বুঝতে পারছি না।’
এরকম ঘটনা মোটেই ব্যতিক্রমী নয়। রোজই ঘটে। বিশেষ করে আমাদের মতো খুপরিজীবী চিকিৎসকদের সাথে, যারা প্রতিদিন অগুনতি রোগী দেখি- অথবা দেখতে বাধ্য হই।
দু-চারদিন আগের ঘটনা। বাড়িতে রোগী দেখছি- হঠাৎ দরজাটা একটু ফাঁক হলো। আমার সহকারী সঞ্জয়দা দরজার অল্প ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার আর রোগীর কথা শুনছে।
বিষয়টা বেশ অস্বস্তিকর। যদিও আমি হাটে-বাজারে রোগী দেখেই অভ্যস্ত, তবু্ও এভাবে কেউ উঁকি মেরে দেখলে অস্বস্তি হয়।
তবে সঞ্জয়দা কখনোই এরকম করেনা। বরঞ্চ একজনক রোগী দেখার সময় অন্য কেউ ঘরে ঢুকলে তাকে ঝাড় দেয়। তাই অবাক হলেও কিছু বললাম না।
তাছাড়া মধ্যবয়সী রোগীর গোপন কোনো রোগ নেই। সুগারটা একটু বেড়ে আছে। যে ট্যাবলেটটা সকালে একবার খাচ্ছেন, সেটা সকাল রাতে দুবার খেলেই সম্ভবত ঝামেলা মিটবে।
সেইটাই বলতে যাচ্ছিলাম, সুযোগ পেলাম না। হঠাৎ সঞ্জয়দা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো এবং বেশ উত্তেজিত হয়ে চিৎকার শুরু করল, ‘বেরোন, আপনি চেম্বার থেকে এক্ষুনি বেরোন।’
ভদ্রলোক মিন মিন করে কিছু বলতে গেলেন, বুঝতে পারলাম না। সঞ্জয়দা অত্যন্ত উদ্ধত ভাবে বলল, ‘আপনি না বেরোলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করবো।’
আমি হতবাক। সঞ্জয়দা একজন রোগীর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করছে কেন? এরপর নিশ্চিত ঝামেলা হবে। হাতাহাতিও হতে পারে। আমাকে সেই হাতাহাতি আটকাতে হবে। ভোর থেকে রোগী দেখতে দেখতে এমনিতেই আধমরা হয়ে গেছি। আর ঝুটঝামেলা ভালো লাগে না।
বললাম, ‘সঞ্জয়দা, কী হচ্ছে কী?’
‘আপনি জানেন না ডাক্তারবাবু, এ কতো বড়ো মিথ্যাবাদী। কুড়িজনের পিছনে লাইন, এমারজেন্সি বলে ঢুকেছে। আমাকে বলেছে সকাল থেকে শুধু জলের মতো পায়খানা হচ্ছে। অপেক্ষা করলে কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যাবে। আমারই বোঝা উচিৎ ছিল। অতবার পায়খানা করলে এমন জেল্লা মারা চেহারা হয় না। তাই ওঁত পেতেছিলাম। ছি ছি, আপনার কী বিবেক বোধ বলে কিছু নেই? একটা রোগী পেটে ব্যথায় কোঁ কোঁ করছে। সেটা দেখেও আপনি মিথ্যে বলে গট গট করে ঢুকে গেলেন।’
এই এমারজেন্সির চক্করে স্ত্রী রূপালীর সাথে মনোমালিন্য অবশ্যম্ভাবী। আমি বাড়িতে থাকি শুধু বাড়ির চেম্বারের সময়টুকুই। বাকি সময় বিভিন্ন খুপরিতে রোগী দেখে বেড়াই। মোবাইল প্রায় সারাদিনই বন্ধ থাকে। না হলে একজন রোগী দেখতে দেখতে পাঁচটা ফোন আসে। রোগী দেখা শেষ করে রাত সাড়ে ন’টা, দশটা নাগাদ ফোন খুলি। ফোনপর্ব শুরু হয়।
আমি বাড়িতে না থাকার সময়ে অনেকেই রোগী নিয়ে হাজির হয়। রূপালী সবাইকেই বলে, ‘ডাক্তারবাবু বাড়ি নেই।’
অধিকাংশই বিশ্বাস করেন না। দু-একজন সরাসরি বলেন, ‘আমরা জানি ডাক্তারবাবু মোবাইল বন্ধ করে রেস্ট নিচ্ছেন। রোগীর ভয়ংকর এমারজেন্সি, একবার ডাক্তারবাবুকে ডেকে দেন না।’
রূপালী বাড়ি ফেরা মাত্রই আমার উপর সেই রাগ ঝাড়ে। আমি চুপচাপ শুনি। ফোন এলে হ্যাঁ হুঁ করতে করতে বারান্দায় চলে যাই।
গতকাল রাত দশটায় বাড়ি ঢুকেছি, দেখি বাড়ির সামনে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে একজন বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার বোনকে একটু দেখে দিন না। খুব এমারজেন্সি।’
আমার তখন একমাত্র চিন্তা একে যে করেই হোক কাটাতে হবে। সেই ভোর সাড়ে ছটায় গৌড়ের চেম্বারে রোগী দেখা শুরু করেছি। আর ভালো লাগছে না। তাছাড়া রোগিণীকে দেখে মোটেও এমারজেন্সি বলে মনে হচ্ছে না।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’ জ্বর জ্বারি হলে মুখেই দু’চারটে ওষুধ বলে কাল দুপুরে বাড়িতে আসতে বলব।
মেয়েটি বলল, ‘বোনের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে নখকুনি হয়েছে। দু’দিন ধরে খুব ব্যথা। আজ বাড়াবাড়ি।’
গম্ভীর মুখে বললাম, ‘নখকুনি আমি দেখিনা। মেডিসিনের ডাক্তারদের নখকুনির রোগী দেখার নিষেধাজ্ঞা আছে।’ তারপর মেয়ে দুটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে ঢুকে গেলাম।
দোতলায় যাওয়া মাত্রই রূপালী জিজ্ঞেস করল, ‘দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘অত্যন্ত অভদ্র মহিলা। যতবার বলছি তুমি এখনো ফেরোনি, তত বলছে, কেন মিথ্যা বলছেন। খুব এমারজেন্সি। একবার ডক্টরকে ডেকে দিন না। কী হয়েছে ওদের?’
বললাম, ‘নখকুনি।’ তারপর স্ত্রীর হতভম্ব মুখের দিকে সভয়ে তাকিয়ে স্নানে ঢুকে গেলাম। গালিগালাজ খাওয়ার আগে স্নানটা সেরে নি।
ছবিঃ ©শ্রীময় ভট্টাচার্য?