যেদিকে তাকাচ্ছি সেখানেই কোভিড পজিটিভ! আগে শুধু আইসোলেশন ওয়ার্ডে ধরা পড়তো। এখন সেসবের বালাই চুকেছে। সাধারণ শিশু ওয়ার্ড থেকে নবজাতকদের বিভাগ.. সব জায়গায় থাবা বসিয়েছে কদম ফুলের মতো দেখতে মারণ ভাইরাস। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে রোগ উপসর্গগুলো বড়দের থেকে অনেকটাই আলাদা। পেট ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা, খিঁচুনি, গায়ে ব্যথা এসবই বেশি। তাছাড়া জ্বর, সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট এসব তো আছেই। অনেকের আবার প্রায় কোনও উপসর্গ-ই নেই। রুটিন টেস্টে কোভিড ধরা পড়ছে। পেশেন্টের ছুটির কাগজ লিখে ফেলার পরেও বাতিল বা সংশোধন করতে হয়েছে অনেকবার।
‘পজিটিভ’ এলেই বাড়ির লোকের কান্নাকাটি আর উৎকন্ঠা! “কী করে হ’ল ডাক্তারবাবু, আমার তো বাচ্চার তো কিছু সমস্যা ছিল না। রোগ কোথা থেকে এলো? আমার বাচ্চার কিচ্ছু হয়নি। আপনি ছুটি লিখে দিন।” এদিকে দিনের পর দিন চিৎকার করে করেও কাউকে মাস্ক পরানো যাচ্ছে না। সবাই কেমন নিশ্চিন্ত! বাজার-হাট, চায়ের দোকান, মিছিল-সমাবেশ, খেলার মাঠ.. সব জায়গায় কেমন ছুটি ছুটি ব্যাপার! শুধু আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরাই চেঁচিয়ে, হেদিয়ে মরছি। অনেকে তো আবার একঘাট এগিয়ে বলে দিয়েছেন করোনা-টরোনা কিচ্ছু নয়, সব বহুজাতিক সংস্থাগুলোর চক্রান্ত। গোমূত্র, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রসুন-আদা-হলুদের ক্কাথ কিংবা অ্যালকোহল ফোঁটা আর্সেনিকাম অ্যালবামে রোগ সারানোর দাবী উঠলো। এবং, যথারীতি বিশ্বাসও করলেন অনেকে। প্রাথমিক ভয়ের জুবুথুবু ভাব কাটিয়ে খুল্লমখুল্লা ঘুরে বেড়ানো এখন বেশ চোখ সয়ে এসেছে। এদিকে কোভিড সেরে যাওয়ার পরেও দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যাচ্ছে হৃৎযন্ত্রে, ফুসফুসে, স্নায়ুতন্ত্রে, মানসিক স্বাস্থ্যে। একেবারে হারিয়ে গেলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ..
শুধু করোনা নয়। মারীর দেশের শত্রুশিবিরে আরও অনেক শ্বাপদেরা শিকারের অপেক্ষায়। স্ক্রাব টাইফাস রোগটির কথা এখন বোধহয় অনেকেই শুনে ফেলেছেন। মূলত ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকায় বন্য জন্তু থেকে ০.২-০.৪ মিমি. ব্যাসের মাইটের কামড়ে রোগটি ছড়ায়। গত ক’মাসে স্ক্রাব টাইফাসের ফাঁস চেপে বসেছে মারাত্মকভাবে। জ্বর, র্যাশ, পেট ফুলে যাওয়া, বুকে-পেটে জল জমে যাওয়া, যকৃত-প্লীহাবৃদ্ধি, লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, খিঁচুনি নিয়ে ভর্তি হওয়া অনেক রোগীরই স্ক্রাব টাইফাস ধরা পড়ছে। রক্তে সোডিয়াম, অ্যালবুমিন, অনুচক্রিকা কমছে। বাড়ছে যকৃত নিঃসৃত উৎসেচক। ভয়ের ব্যাপার হ’ল- সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে স্ক্রাব টাইফাস রীতিমতো প্রাণঘাতী। জ্বরের প্রাথমিক চিকিৎসায় কাজ না হওয়া এবং চামড়ায় পোড়া ঘায়ের মতো দাগ দেখলেই সতর্ক হোন। যদিও সবার ক্ষেত্রে এরকম দাগ পাওয়া যায় না। তাছাড়া, আমাদের বাদামী চামড়ার দেশে সবক্ষেত্রে দাগ খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। খুব অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পক্ষেও সবসময় রোগটি ধরে ফেলা বেশ কঠিন।
আর আছে বহু বহুদিনের পোড়খাওয়া শত্রু। শত্রুদের আদিপুরুষদের একজন- ম্যালেরিয়া। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে এককালের ত্রাস ম্যালেরিয়া এখন বেশ নরমসরম রোগ। খুঁজেই পাওয়া যায় না, মানে যেত না আজকাল। আমার পর্যবেক্ষণের ভুল কিনা জানিনা, ম্যালেরিয়া কিন্তু ঘুরে দাঁড়াচ্ছে! গত একমাসে বেশ কয়েকজন ম্যালেরিয়া রোগী পেলাম। অনেকের অবস্থাই ভয়াবহ। রক্ত দিতে হচ্ছে কিংবা অন্যান্য আপৎকালীন চিকিৎসার প্রয়োজন হচ্ছে। এই ঘুরে দাঁড়ানো যে কারোর জন্যই সত্যি। মানুষ-ই হোক বা জীবাণু.. দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সবাই বদলা চায়! খুব পরিচিত রোগগুলোও পাঁচ-সাত বছর ছাড়া ছাড়া মারাত্মক হয়ে ফিরে আসে!
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? সিয়াচেনের তাপমাত্রা আর মন্দির-মসজিদের বাইরেও আরও অনেক কিছু ভাবার আছে। যাক গে, সেসব বড় বড় কথা.. আপাতত নাকের বা থুতনির নিচের ঝুলন্ত মাস্কটা ভালোভাবে পরে নিন। সমাজের সবার কথা ভাবার দরকার নেই। আপনার নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষার জন্যই মাস্ক পরাটা জরুরি।
চতুর্দিকে শত্রুরা ওঁত পেতে আছে। কাউন্টডাউন শুরু.. টিক.. টিক..
**
বি. দ্র.– স্ক্রাব টাইফাসের পোড়া দাগ। মায়ের অনুমতি নিয়ে ছবি তোলা হয়েছে।