মাকড়সার মা থেকে
মানুষের মা
.২০১৮ সালের নভেম্বর মাস, আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে। পৃথিবী তখন ছিল এক আশ্চর্য গ্রহ, হাটে-বাজারে মানুষ মুখোশ ছাড়া ঘুরে বেড়াত। অভিলাশা দাস অধিকারী তাঁর দুধের শিশুকে নিয়ে সাউথ সিটি মলে গিয়েছিলেন। বাচ্চাকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য সেখানে আলাদা ঘর চান অভিলাশা, মল-কর্মী তাকে টয়লেটে গিয়ে দুধ খাওয়াতে বলেন। পরদিন মলের ফেসবুক পাতায় অভিযোগ করেন অভিলাশা। মল কর্তৃপক্ষ জানান, “… আপনার শিশুকে যে কোনও মুহূর্তে বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন থাকার কথা নয়, তাই যে কোনও পাবলিক এলাকায় আপনার সন্তানকে যেখানে খুশি বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা কী দরকার?”
ফেসবুকে এ-কথা ক্রমশ চাউর হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। অভিযোগ ওঠে শপিং মল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। কর্তৃপক্ষ ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়। তারা জানায়, মলের প্রতিটি তলায় বাচ্চাকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে। (চিত্র ১ দ্রষ্টব্য)
আজকের গল্প শপিং মলের ক্রেতা মায়েদের, বা চা-বাগিচা অথবা কয়লাখনির নারী-শ্রমিক মায়েদের, কিংবা ঘন্টার পর ঘন্টা একটানা কাজ করা ডায়াপার-পরতে বাধ্য হওয়া কোভিড ডিউটি করা নার্স-আয়া-মহিলা চিকিৎসকদের নিয়ে নয়। (তথ্যসূত্র ১)
আজকের কথা দুধ খাওয়ানো নিয়ে। দুধ খাওয়ালে মায়ের নিজের কোনও সুবিধা নেই, বরং দেহে দুধ তৈরির ঝামেলা আছে, আর মেল-গেজ কালচারে দুধ খাওয়ানোর যন্ত্রণা আছে। মায়ের দুধ পেলে আসল সুবিধা শিশুর। মায়ের জিন পরের প্রজন্মে টিকে থাকে, সেটাতে মায়ের অপ্রত্যক্ষ সুবিধা। তার জন্যই প্রাকৃতিক নির্বাচন মায়েদের এমন করে গড়ে যে সন্তানকে খাইয়ে সে চরম মানসিক আনন্দ পায়। স্নেহ অতি বিষম বস্তু, তবে মাতৃস্নেহ বিষমতর, কারণ দুধের মধ্যে যাবতীয় স্নেহপদার্থ, শর্করা ও প্রোটিন পৌঁছে দেবার মায়ের একারই।
স্তন্যপায়ী সন্তানের পক্ষে দুধ ভারি খাসা জিনিস। সাউথ সিটি মলে যাই ঘটে থাকুক না কেন, মায়ের পক্ষে কিন্তু ব্যাপারটা অবিমিশ্র ভাল নয়। বাচ্চা পালনের সময় কমলে ও বাচ্চার জন্য মায়ের দুধ কম খরচ হলে মা তাড়াতাড়ি আরেকটি বাচ্চার জন্ম দিতে ও বড় করতে পারে। তাতে তার মোট বংশধর বাড়ে, পরের প্রজন্মে তার জিন বাড়ে। অবশ্য কোলের বাচ্চাটিকে একেবারে অযত্ন করা চলে না, সেটি মরে গেলে মায়ের আম-ছালা দুই-ই যায়। মা চায়, প্রত্যেক সন্তানের জন্য প্রয়োজন অনুসারে মোটামুটি সমান যত্ন।
কিন্তু সন্তানের কাছে তার নিজের বেঁচে থাকাটাই সব চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভাইবোন থাকলে তাদের প্রত্যেকে ‘চাইবে’ মা কেবল তারই যত্ন নিক। ভাইবোনের মধ্যে যত্ন ছিনিয়ে নেবার প্রতিযোগিতা চলে।
সন্তানের জিন তাকে ‘প্ররোচিত’ করে। সে বলে, নিজের ন্যায্য পাওনার চাইতে বেশি খাবার দখল কর, বাবা-মায়ের বেশি যত্ন কেড়ে নাও। কিন্তু তার ভাইবোন তারই জিনের কপি বহন করার সম্ভাবনা খুব বেশি। ভাইবোনের বেশি ক্ষতি করলে, তাদের মেরে ফেললে, সেই সব জিনের কপি-সংখ্যা কমে যায়। তাই কোকিলের ছানা কাকের বাসায় বড় হয়ে ওঠার সময়ে কাকের ছানাকে বাসা থেকে ঠেলে ফেলে দেয়, কিন্তু কাকের ছানা নিজের ভাইবোনকে বাসা থেকে ফেলে দেয় না।
মা তার বাচ্চার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কচি ছানারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে পারে, কিন্তু তারা কেমন করে মায়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে?
“একটি টুকটুকে অসম্ভব রকমের ছোট্ট, প্রায় একটা কাচের বড় পুতুলের চেয়ে কিছু বড় জীব কাঁথার মধ্যে শুইয়া— সেটিও ঘুমাইতেছে। … জীবটা চোখ মেলিয়া মিট্মিট্ করিয়া চাহিয়া অসম্ভব রকমের ছোট্ট হাত দুটি নাড়িয়া নিতান্ত দুর্বলভাবে অতি ক্ষীণ সুরে কাঁদিয়া উঠিল। … হঠাৎ অসহায়, অসম্ভব রকমের ছোট্ট নিতান্ত ক্ষুদে ভাইটির জন্য দুঃখে, মমতায়, সহানুভূতিতে খুকীর মন পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।” (পথের পাঁচালী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই ‘অসহায়, অসম্ভব রকমের ছোট্ট নিতান্ত ক্ষুদে’ প্রাণীটি কী করে মায়ের সঙ্গে লড়াই করে?
মা পাখি বাসাতে খাবার নিয়ে এলে বাচ্চারা জোরে চেঁচায়, তাই শুনে শিকারি পাখি বাসায় আক্রমণ করতে পারে। গরু-ছাগলের বাচ্চারা খিদের সময় ম্যা-ম্যা বা ব্যা-ব্যা করার সময় ব্যাকরণ মেনে চলে না। খিদে পেলে মানুষের বাচ্চা চেঁচিয়ে কাঁদে। পালে বাঘ পড়লে গো-মাতা কী বলে বৎসদের চুপ করায় কে জানে। তবে আমাদের বলতে হয়, বর্গী এল দেশে কিংবা বেটে তু শো যা, নেহি তো গব্বর সিং আ যায়েগা।
থিয়োদোশিয়াস দবঝানস্কি বলেছেন বটে, বিবর্তন ছাড়া প্রাণবিজ্ঞান অর্থহীন, কিন্তু খিদে পেলে বাচ্চারা সে কথা শোনে কি? প্রাকৃতিক নির্বাচনের সুবিধা পেতে চাইলে তাদের উচিত ছিল মা-বাবাকে চুপিচুপি খিদের কথা জানানো; বিবর্তনের ফল হওয়া উচিত ছিল নিঃশব্দ ও নিরাপদ ক্ষুধা-সংকেত। তা হয় নি।
প্রাকৃতিক নির্বাচনও কি খিদের কাছে হার মানল? না। বাচ্চার চোখের ভাষায়, তার মুখের হাঁয়ে, মা-বাবা খিদে বুঝতে পারলে বাচ্চারা মা-বাবাকে ঠকিয়ে বেশি খাবার আদায় করে নিত। বাবা-মায়ের সঙ্গেও সন্তানের স্বার্থদ্বন্দ্ব আছে। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচন বাচ্চাকে না কাঁদিয়ে খেতে দেয় না। (তথ্যসূত্র ২)
বাচ্চাকে খাবার পেতে গেলে চেঁচাতে হয়। সে যদি অপ্রয়োজনে চেঁচিয়ে খাবার চায়, তাহলে তাকে শিকারি প্রাণীর হাতে মরার ঝুঁকি নিতে হয়। সেটাই তার খামোকা না কাঁদার গ্যারান্টি। মা-বাবার কাছে এ হল সত্যি-খিদে যাচাই করার কৌশল। বাচ্চা অল্প কাঁদলে মা তাকে খাওয়ায় না। মা ‘জানে’ যে তার বাচ্চা বেশি খিদেতে বেশি কাঁদবে।
আসলে মায়ের সত্যিকারের জানার দরকার নেই, কিন্তু তার আচরণ এমন হতে হবে ‘যেন সে বাচ্চার মনের কথা জানে’। অন্যদিকে, বাচ্চাও আসলে কান্নার ঝুঁকির কথা কিছুই জানে না, কিন্তু তার জিনগত আচরণ এমন, ‘যেন সে চেঁচানোর ঝুঁকির কথা জানে’। সন্তান মা-কে ভুল বুঝিয়ে বেশি খাদ্য আদায় করতে চায়। মা চায় তাকে দরকারমত খাদ্য দিতে। এ হল সমানে সমানে প্রতিযোগিতা।
সাউথ সিটি মলের বাইরে যে জগৎ, তাতে মা যা চায় তার চাইতে বেশি খাদ্য দিতে সে বাধ্য হয়। বাচ্চা তাকে ব্ল্যাকমেল করে। চড়ুই জানে, সে বাচ্চার চেঁচানি বন্ধ না করলে শিকারি পাখি এসে বাসার সব বাচ্চাকে খেয়ে ফেলবে, আর বাচ্চাকে না খাওয়ালে সে থামবে না। ছাগমাতা জানে, ব্যাকরণ না-মানা ব্যা-ব্যা ব্যাঘ্রমামাকে ডেকে আনবে। মায়ের সঙ্গে বাচ্চার এক বিবর্তনীয় লড়াই চলে। আজকের মানুষ-মায়ের বাচ্চাকে ঠেসে খাওয়ানোর লড়াই দেখে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত চোখে আমরা সে-লড়াই সহজে বুঝতে পারি না।
তবে মায়ের সঙ্গে ছা’য়ের লড়াই শুরু হয় গর্ভের ভেতরেই। সে কথা হবে পরে আরেকদিন।
তথ্যসূত্র
১)https://indianexpress.com/article/lifestyle/health/female-health-workers-ppe-challenges-periods-coronavirus-6563136/
২) Godfray HC. Parent-offspring conflict. Curr Biol. 2005 Mar 29;15: R191