নাঃ, আবারও হল, মানে ঘটল ব্যাপারটা। মাথা নীচু করে অরুণাচলকে স্বীকার করতে হল। বলতেও হল, আগে যা বহুবার বলতে হয়েছে। একই ভাষায় বারবার।- আর হবে না। আর কোনও দিন হবে না।
★
– আপনি একটু ওপাশের বেঞ্চিতে সরে বসুন তো।
মালিকের চোখের কোনও ত্রস্ত ইঙ্গিতেই বোধহয়, ফুটপাথের চায়ের দোকানে বসা অরুকে বলল, চায়ের দোকানের ছেলেটা।
অরু এ’পাড়ায় নতুন ভাড়া এসেছে। সকালের এক কাপ চা দোকানে বসে খাওয়া তার বহুদিনের অভ্যেস। বাড়ির চায়ে এই প্রভাতী স্বাদ সে কিছুতেই পায় না।
সেই মত সে এই দোকানটি খুঁজে বার করেছে। দুটো বেঞ্চি। আর ডানদিকের কোণায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। ফাঁকা চেয়ারটায় সবে জুতমত বসেছে অর্ডার দিয়ে। ছেলেটার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল অরু।
ব্যাপারটা বুঝতে চাইল বোধ হয়। বুঝিয়েও দিতে চাইল নিজের আপত্তিটা। পছন্দের জায়গাটা সে যে মোটেই ছাড়তে চায় না সেই ব্যাপারটা। এই টানাপোড়েনে আধমিনিট মত সময় যেতে না যেতেই বাজখাঁই গলায় চিৎকার শুনল সে। – অ্যাই বেজো, আজও আমার সিটে একটা শোরের বাচ্চাকে বসিয়ে রেকেচিস? শালা, সকালের চাটা হারাম করে দিলি!
বেজো মানে মূল দোকানি, তড়িঘড়ি নেমে এলো তার ঘুপচি থেকে। অরুর সামনে এসে মোটামুটি ভদ্র ভাষায় যা বলল, তা হল, – কেন ঝামেলা কচ্চেন স্যার? কালাদা’ এই পাড়ার পেসিডেন। কালাদার সিটে কেউ বসলে কালাদা’ হেব্বি খচে যায়। যান, আপনি ও পাশের ফাঁকায় বসুন গিয়ে। চা দিচ্চি।
অরু একটু ম্রিয়মান প্রকৃতির মানুষ। ম্রিয়মান মানে সে অর্থে উজ্জ্বল অস্তিত্ব নয় তার। তার জন্য যে তার খুব কোনও ক্ষতি হয়েছে বড়সড় তা নয়। মোটামুটি ভদ্রসভ্য একটা মধ্যবিত্ত জীবন, কিছুটা অনুজ্জ্বল যদিও সে পার করছে।
সে কালাপাহাড়কে চেয়ারটা ছেড়ে, বেজো মানে ব্রজলালের কথামত, বলা ভালো আদেশমত, অন্য বেঞ্চে অন্যদের পাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে গিয়ে বসল। সিদ্ধান্ত নিল এই দোকানে আর না।
কিন্তু সেই জেদ থাকল কি তার? মোটেই না। এর পর যদ্দিন সেই পাড়ায় ছিল, ওই দোকানেই চা খেয়েছে।
এই যে ঘটমান বর্তমান থেকে ঠোক্কর খেয়ে অনাগত ভবিষ্যতে আর হবে না বলে নাকে খত দেওয়া। সারা জীবন করে এসেছে অরুণাচল। আবারও করল।
★
কলেজে পড়ত যখন, মেডিকেল কলেজে, হোস্টেলে থাকত। সমাসন্ন বিপ্লবের কথা ভেবে চোখে ঘুম না থাকার বয়স সে’টা। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ তখন রক্ত পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে আছে। এমন উজ্জ্বল ছবি মাথায় গেঁথে জরুরি অবস্থার মধ্যে রাত জেগে পোস্টার লাগাত মহানগরের দেওয়ালে। পাছে বিপ্লব রাস্তা ভুল করে পৌঁছাতে দেরি করে, তাই এত পোস্টার, এত পথ নির্দেশ!
সেই বিপ্লব স্পন্দিত দিনে অমিতদা’ বলেছিল কথাটা। অমিতদা’ হোস্টেলে থাকত না। ডে স্কলার। রাত জেগে এই সব বৈপ্লবিক ব্যাপার স্যাপার সেরে হেঁটে বাড়ি ফিরে যেত।
অমিতদা’, না কোনও বিপ্লব সংক্রান্ত কথা বলেনি। বলেছিল একটা ভারি বাস্তবিক কথা। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন সামান্য গল্পের মধ্যে অসামান্য নির্দেশ আর ইঙ্গিত দিতেন, অমিতদা’ও প্রায় সেই রকম।
বলল, – বুঝলি, ওই রাত তিনটের সময় বাড়ি ফিরতে সমস্যা একটাই। বাচ্চা কুকুর।
অমিতদা’ বাড়ি ফেরার সময় হাতে একটা ছোট লাঠি রাখত কুকুরদের ভয় দেখানোর জন্য। অরুণাচল বলল, – কুকুর কী করবে? তোমার সঙ্গে লাঠি থাকে তো! ভয় পায় না?
– না, ঠিক তা না। বড় সাইজের, অ্যাডাল্ট যেগুলো, সেগুলো অত কাছে আসে না। দাঁতটাত বিচ্ছিরি ভাবে বার করে তেড়ে আসে বটে, কিন্তু লাঠিটা দেখালে পিছিয়েও যায়। প্রবলেম হয় ছোটো সাইজেরগুলোকে নিয়ে। ও’গুলো তো জানে না কদ্দুর এগোতে হয়। লাঠিতে ভয় না পেয়ে বিপজ্জনক ভাবে এগিয়ে আসে। তখন লাঠি চালাই। পায়ে পিঠে পড়লেই শিখে যায়। বাচ্চা কুকুর ক্রমে অ্যাডাল্ট হয়ে ওঠে।
অরুণাচল গল্পের সার কথাটা বুঝেছিল। ওই যে লাঠি খেয়ে অনভিজ্ঞ কুকুর ক্রমে অভিজ্ঞ হল, মানে আর্তনাদ করল কেঁউ, ওইটিরই অনুবাদ হল, ‘অভিজ্ঞ হলাম’
★
আজও তাই ঘটল। পাকামি করতে গিয়ে তিরস্কৃত বেচারা পাংশু নতমুখে অবিকল আর্তনাদ করে উঠল, কেঁউ, মানে আর হবে না। নোটেড ফর ফিউচার গাইডেন্স।
★
কেঁউ আওয়াজটা করে বটে। কিন্তু বাচ্চা কুকুরের যে’টুকু মেধা তাও নেই বলে সারা জীবন এই এক দুর্গতি বেচারার। সে আজও কতদূর এগোতে হবে, মানে এগোনো যায় আন্দাজ পায় না। বুঝতেই পারে না, কতখানি দাবী শোভন।
★
চাকরি জীবনে এই ‘নোটেড ফর ফিউচার গাইডেন্স’ কথাটি শিখিয়েছিলেন সোদপুরের রতন দাম।
নাঃ, এই রকম করে বললে কিছুই বোঝানো যাবে না।
অরুণাচল বাংলাদেশ সীমান্তের গ্রাম থেকে শহরতলি খড়দার বলরাম হাসপাতালে পোস্টিং পেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট হবার কড়ারে। ছোটো হাসপাতালের সুপার মানেই, ইন্ডেন্টে সই, ক্যাশবুকে সই। এবং সবচেয়ে ভয়াবহ হল বছরে দু’বছরে অডিটের মুখোমুখি হওয়া।
অরুণাচল চাকরি জীবনের প্রথম অডিট ফেস করবে। হাসপাতালে সাজো সাজো রব। ভয় কি? স্টোর কিপার নিখিলদা, ওয়ার্ড মাস্টার সুনীলদা’, আর ক্যাশিয়ার কাম বড়বাবু শান্তিদা’। তিন পোড় খাওয়া সেনাপতি পাশে নিয়ে অরুণাচল বীরের মত যুদ্ধক্ষেত্র এগোল।
চারজন না পাঁচ জন এসেছিলেন অডিট পার্টিতে। এ’সব ক্ষেত্রে দস্তুর হল, অডিট পার্টিকে কনটিনজেন্সির টাকায় তুমুল আপ্যায়ন করতে হবে, যেন সেই শনি ঠাকুরেরা কিছুতেই ক্রুদ্ধ না হন। সেই সমস্ত বিধিমত করা হল। অডিট চলাকালীন, অরুণাচল আর তার সঙ্গী স্টাফেরা আগামী দিন সাতেক ফিসফিস করে কথা বলবে, অফিসঘরে পা টিপেটিপে হাঁটবে। যেন কিছুতেই ধ্যানভঙ্গ না হয় অডিট-মুণিদের।
সাত দিনের মাথায়, অডিট পার্টির হেড ওই রতন দাম, অরুণাচলকে একটি প্রায় ন’ দশ পাতার গড়মিলের তালিকা দিলেন ডেকে। অবশ্য এই সাতদিনে চলমান অডিটের এই সব গুপ্ত কথা মাঝে মাঝে লিক করছিল আগেই। শান্তিদা’ উঁকিঝুঁকি মেরে জেনে এসে প্রায় অশ্রুত স্বরে শুনিয়ে যাচ্ছিলেন।
কোনওদিন ধরা পড়ছিল কুড়ি পঁচিশ পয়সা কম পড়েছে ক্যাশবুকের অমুক পাতায়। আবার কখনও তমুক পাতায় আড়াই তিনটাকা বেশি। তো অডিটে অনভিজ্ঞ অরুণাচল ওই কুড়ি পঁচিশ পয়সা নিজের পকেট থেকে দিতে বেজায় রাজি। রাজি আবার এক্সেস ওই আড়াই টাকা নিয়ে নিতেও। এই সব শুনে তিন সেনাপতিই আঁতকে উঠলেন, যেন ব্রহ্মহত্যার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ভুল মানে ভুল। তা ওইসব ছকবাজি করে মেটানো যাবে না।
ওই বিশাল কোয়্যারি লিস্ট দেখে অরুণাচল পড়েছে অথৈ জলে। নিখিলদা’র পরামর্শে মিনমিন করে গিয়ে ধরল ওই অডিট পার্টির হেড, কড়া অডিটার শ্রীযুক্ত রতন দামকে। বিস্তর মাথা চুলকে ভয়ে ভয়ে নিবেদন করল আর্জি। – ইয়ে, রতনদা’, বলছিলুম কী, মানে অ্যাদ্দিন থাকলেন। আর একদিন থেকে গিয়ে যদি কোয়্যারির উত্তরগুলোও… মানে আপনারাই যদি লিখে দ্যান!
কী কাণ্ড! যেন পরীক্ষার হলে টিচারকেই বলা হচ্ছে, – স্যার, উত্তরগুলো লিখে দিন, আপনিই।
কপাল ভালো। রতন দা রাজি হলেন। পুরো একদিন আরও থেকে গিয়ে, ওঁরা সবাই মিলে, ঘাড় নীচু করে খস খস করে লিখে দিলেন সব কোয়্যারির উত্তর।
এই কাগজের তলায় সুপার অরুণাচলের সই বসবে। তারপর উত্তর দেওয়া সেই কাগজ পাঠানো হবে যথাযথ জায়গায়।
সই করতে গিয়ে ওই কাগজ পড়ে অরুণাচল অবাক। প্রত্যেকটা প্রশ্নেরই জবাব, ‘নোটেড ফর ফিউচার গাইডেন্স।’
★
সেই থেকে কতবার যে বলল এই একই কথা। কলেজ বেলায় কিছু রাজনৈতিক লব্জ শিখেছিল। সেই কথাগুলো ভিন্ন অর্থে ব্যবহার হল অরুণাচলের জীবনে।
অরুণাচলের উল্টোপাল্টা না বুঝে করা কাজে কেউ ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হয়ে পড়েছে বুঝতে পারলেই অরুণাচল তৎক্ষনাৎ নত মস্তকে ‘সংশোধনবাদী’ হয়ে পড়েছে। মুছে দিয়েছে নিজেকে। আবারও মুছেছে। মুছেই চলেছে।
গ্রুপবাজি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। দেখা যাক।
নোটেড ফর ফিউচার গাইডেন্স।