আমাদের পাশের বন্ধু যখন কোনও বিষয় নিয়ে খুব ‘টেনশন’ করে কিম্বা সামনে কোনও নতুন ‘ইভেন্ট’ আছে বলে খুব অস্থির হয়ে ওঠে, আমরা বলি –“আরে এত চিন্তা করিস না। ক্যাজ থাক। সব ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু সে ক্যাজ হতে পারে না।ছটফটানি বাড়তে থাকে, কপালে ভাঁজ পড়ে, রাতে ঘুম নষ্ট হয়। এবং ভবিষ্যতেও এই ধরনের ঘটনা বা পরিস্থিতিতে সে একই রকম দুশ্চিন্তা করে। ভয় পেতে শুরু করে।
এবার একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, কিছু কিছু জিনিসে আমরা ভীষণ ভয় পাই আবার কিছু কিছু বিষয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা করে ফেলি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ভয় ও দুশ্চিন্তা একসঙ্গে থাকলেও দুটো জিনিস কিন্ত আলাদা। ভয় বা fear হল কোনও এক বাস্তব বা আসন্ন কোনও উপলদ্ধ বিপদ। দুশ্চিন্তা বা anxiety হল ভবিষ্যতে কিছু খারাপ ঘটবে এই ভেবে অহেতুক উদ্বেগ। অর্থাৎ ভয় হল অনেক বেশি বাহ্যিক, স্পষ্ট, সুনির্দিষ্টভাবে ‘জানা’ কোনও বিষয় বা জিনিসের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া, অন্যদিকে দুশ্চিন্তা বা anxiety সেইভাবে কোনও জানা বিষয়ের জন্যে নয়, অনেক বেশি অজানা, অস্পষ্ট, আভ্যন্তরীণ এক বিরোধের প্রতিক্রিয়া।
সাধারণত আমরা যাকে ‘ফোবিয়া’ (phobia) বলি- তা হল অমূলক আতঙ্ক, একটি ভয় বা fear রেসপন্স। যেমন অনেকের একটু বেশি উচ্চতায় উঠলে ভয় লাগে (Acrophobia- অ্যাক্রোফোবিয়া), কুকুর দেখে ভয় লাগে (Cynophobia- সায়নোফোবিয়া)।
অন্যদিকে আমাদের পরীক্ষার আগে খুব দুশ্চিন্তা বা অ্যানজাইটি (anxiety) হয়, নতুন জায়াগায় অপরিচিত লোকজনের সাথে কথাবার্তা শুরু করতে উৎকণ্ঠা বাড়ে চিন্তা হয়, সবার সামনে কোনও কাজ সম্পাদনা করতে গিয়ে আমাদের উদ্বেগ হয়, উৎকণ্ঠা বাড়ে।
মোটামুটি ভাবে ভয় বা fear এবং দুশ্চিন্তা বা অ্যাংজাইটি (anxiety) এর শারীরিক কিম্বা মানসিক বহিঃপ্রকাশ একই রকমের হয় তবুও কিছু জায়গায় আলাদা আমরা করতে পারি।যেমন ভয় বা fear হলে আমাদের তাৎক্ষণিক, খুব কাছাকাছি আসন্ন এক বিপদের চিন্তা মাথায় কাজ করে, আমাদের অটোনোমিক হাইপারঅ্যাক্টিভিটি (autonomic hyperactivity) বেশি হয় অর্থাৎ রক্ত চাপ, হার্ট রেট, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া, ঘাম হওয়া শুরু হয়। আসন্ন উপলদ্ধ বিপদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটি প্রবৃত্তি তৈরি হয়। যেমন কুকুরে ভয় থাকলে যে পথে কুকুর থাকে তা এড়িয়ে অন্য পথে যাওয়া।
অন্যদিকে দুশ্চিন্তা বা anxiety-তে আমাদের মাংসপেশির টান (nuscle tension) বাড়ে, চাপা উত্তেজনা অনুভূত হয়, ভবিষ্যতের আশংকার কথা ভেবে মস্তিষ্ক অতিরিক্ত সতর্ক,সদা জাগ্রত (hypervigilance) অবস্থায় থাকে।
দুশ্চিন্তা বা anxiety বা ভয় সম্পর্কিত মানসিক রোগ ছোট থেকে বড় বিভিন্ন বয়সেই শুরু হতে পারে এবং তার রকমফেরও বিভিন্ন। যেমন সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (Social Anxiety Disorder)- বিভিন্ন সামাজিক অবস্থায়, ঘটনাতে, কিছু পারফর্ম করার থাকলে দুশ্চিন্তা হতে শুরু করা।
বিভিন্ন ফোবিক ডিসঅর্ডার যেমন অ্যাগোরাফোবিয়া (Agoraphobia)- কোনও ফাঁকা বা বদ্ধ জায়াগায়, জন-পরিবহণ ব্যবস্থায় গেলে সেই জায়গা থেকে কোনও রকম ভাবে বের হওয়া সম্ভব নয় এই ভয় হতে শুরু করা।
স্পেসিফিক ফোবিয়া (Specific Phobia)-সুনির্দিষ্ট বিষয় বা জিনিসে অকারণ ভয়। যেমন পোকামাকড় দেখে ভয়, উচ্চতা দেখে ভয়।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল- জেনারালাইসড অ্যানজাইটি ডিসঅর্ডার (Generalised Anxiety Disorder)
একজন ব্যক্তি যখন জীবনের প্রায় সমস্ত কিছু নিয়েই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করে ফেলেন,সাংসারিক যা কিছু তার সবেতেই অহেতুক উদ্বেগের জন্ম হয় এবং এই দুশ্চিন্তার শারীরিক অসুবিধা যেমন মাথাব্যাথা, মাথার চারপাশ টান টান হয়ে থাকা, যখন এগুলো তাঁর কাজের জায়গায়, পারস্পারিক সম্পর্কেও নেতিবাচক ভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করে তখন এই রোগ সন্দেহ করা হয়।
দিনের বেশির ভাগ অত্যধিক চিন্তা এবং উদ্বেগ, ভবিষ্যতে কিছু খারাপের সম্ভাবনা রয়েছে এই নিয়ে মানসিক হয়রানি এই রোগের প্রধানতম লক্ষণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটি নির্দিষ্ট কোনও পরিস্থিতি বা বিষয় নিয়ে নয় একের বেশি ঘটনা বা কাজে এটি লক্ষ করা যায় যেমন পরিবারের মধ্যে, বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানে।
মোটামুটি ভাবে দৈনন্দিন সমস্ত কাজকর্মেই এক সাংঘাতিক দুশ্চিন্তার জন্ম হয়। একটা বিষয় চলে গেলে আর একটা বিষয় নিয়ে শুরু হয়। যাকে বলে ফ্রি-ফ্লোটিং অ্যানজাইটি (Free-Floating Anxiety) কাজের জায়গায় নিজের কাজের দায়িত্ব নিয়ে, পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য নিয়ে, আর্থিক অবস্থা নিয়ে, প্রতিদিনকার ছোটোকাঠো ঘটনা এই দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়, যার উপর এনাদের কোনও নিয়ন্ত্রন থাকে না।
তাহলে কি আমাদের রোজকার জীবনের যেকোনো চিন্তাই প্যাথোলজিকাল(pathological) অর্থাৎ অস্বাভাবিক দুশ্চিন্তা বলে বিবেচিত হবে?? না তা নয়-
প্রথমত, GAD তে আক্রান্ত ব্যক্তির দুশ্চিন্তা সময়পর্ব, তীব্রতা অনেক বেশি। অনেক ক্ষণ ধরে থেকে সহজে ছেড়ে যেতে চায় না। সাধারণ দুশ্চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় বন্ধুদের সাথে কথা বলে বা নিজে থেকেই চেষ্টা করে।
দ্বিতীয়ত, GAD তে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক অনেক ছড়ানো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন, কোনও একটি বিষয় নিয়ে কিন্তু এই প্যাথোলজিকাল দুশ্চিন্তা ফ্রি ফ্লোটিং স্থান থেকে আর এক স্থানান্তরিত হয় যা আমাদের কাজের ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে আমাদের কর্মগত ভাবে পঙ্গু কর তোলে।
তৃতীয়ত, GAD তে আক্রান্ত ব্যক্তির দুশ্চিন্তা অনেক বেশি শারীরিক সমস্যা নিয়ে আবির্ভূত হবে।
দুশ্চিন্তা বা anxiety-র শারীরিক সমস্যা গুলো যেমন গা-হাত পা কাঁপা, মাংসপেশি শক্ত হয়ে থাকা, কপালের আশেপাশে টান ধরে থাকা, শুকিয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, পেটের উপরের দিকে অস্বস্থি, বেশি ঘাম হওয়া এগুলো ধারাবাহিক ভাবে টিকে থাকে। এছাড়া সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়া,মনোযোগ দিতে না পারা, ঘুমের সমস্যা বিশেষ করে দেরিতে ঘুম আসা, বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে না থাকতে পারা, ঘুমের সময় অস্থির লাগা, মন মেজাজ খিট খিটে হয়ে থাকা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এই রোগ ধরা পড়তে পারে- সেক্ষেত্রে তাদের স্কুলের ফলাফলে এর প্রভাব পড়ে।
মূলত ৩০ বছরের আশেপাশে বেশির ভাগ সময় ধরস পড়ে, যদিও বাচ্চা থেকে বুড়ো অনেকের ক্ষেত্রেই এই রোগ থাকতে পারে। এই রোগের কো-মরবিডিটি খুব বেশি। অর্থাৎ এর সঙ্গে অনেক রোগ থাকে যেমন মানসিক অবসাদ (depression) অন্য ধরনের জনিত রোগ, নেশা করার প্রবণতা এগুলো থাকতে পারে।
অনেক সময়েই জেনারালাইসড অ্যানজাইটি ডিসঅর্ডার(GAD) রোগীরা খুব সমস্যায় পড়েন। বিভিন্ন মেডিসিন (anxiolytic psychotropics-যারা অ্যানজাইটি কমাতে সাহায্য করে), রিল্যাক্সেশান থেরাপি, systemic desensitization- যেখানে ধীরে ধীরে ভয় উদ্দীপনা রোগীর সামনে হাজির করে ধাতস্থ হতে শেখানো হয়, কগনিটিভ বেহেভিয়ারল থেরাপি (CBT), এনাদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দুশ্চিন্তাকে মোকাবিলা করার জন্যে বিভিন্ন বিকল্প আচরণ (Alternate Coping Skill) শেখা, নিজের অনুভুতিকে (emotion)চিনতে শেখা-পুরোটা অনুভূতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত না হয়ে সময় নিয়ে ভাবতে শেখা- যা অ্যানজাইটি অ্যাটাক অর্থাৎ তীব্র দুশ্চিন্তার সময় আপনাকে সাহায্য করবে।
মনে রাখতে হবে যেকোনো দুশ্চিন্তাজনিত রোগ পুরোপুরি সেরে যেতে সময় লাগে। ভয় এবং দুশ্চিন্তা যতটা আমাদের অনুভূতির সাথে জড়িয়ে ততটাই আমাদের চিন্তা-ভাবনা,স্মৃতির সাথে জড়িয়ে। উপযুক্ত সময়,কাছের মানুষের নির্ভরতা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেলে একজন মানুষ এই রোগকে পরাস্ত করতে পারেন।