চাঁদ আসে, শেষ রাতে
একাকী নিঃশব্দ চাঁদ।
টুপটাপ শিশিরের জ্যোৎস্নায়
ডুবে যায় বাতিল মানুষ।।
‘মৃত্যু আয়, তিনপাত্তি খেলি’
কবি একথা যতই বলুন না কেন, ব্যপারটা অতটা ঘটনাবিহীন নয়। কবিরা তো কত কিই না বলেন!
জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও সাহিত্যিক চারুচন্দ্র চক্রবর্তী (জরাসন্ধ) নিজের জেলের চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন ‘লৌহকপাট’। সে লেখায় মৃত্যুদন্ডের আসামীদের ফাঁসি-র আগের রাতের ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। তাতে তো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর সামনে খুব বীরত্ব বা সাহসের কথা বলা নেই!
সব কিছুতে আমাদের সেই ঘুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথের কাছেই আসতে হয়। তিনি বলেছেন,
“আমিও রেখে যাব কয়-মুষ্টি ধূলি, আমার সমস্ত সুখদু:খের শেষ পরিণাম-
রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্রাসী সকল-পরিচয়-গ্রাসী
নি:শব্দ ধূলিরাশির মধ্যে।”
আরো লিখলেন-
“মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান॥”
মরণ কি সত্যিই শ্যাম? কৃষ্ণবর্ণ? না কি বর্ণহীন, অবয়বহীন এক শূন্যতা?
যে বর্ণ-ই হোক, যে চেহারা-ই হোক না কেন, জীবনের চরমতম এবং কঠিনতম সত্য হল মৃত্যু। যার পরাজয় নেই, ব্যত্যয় নেই। জীবজগতের সবচেয়ে বড় রহস্যও তাই। তার সামনে আলেকজান্ডার দি গ্রেট, চন্দ্রগুপ্ত, চেঙ্গিস খান, হিটলার, হকিং, মাইকেল জ্যাকসন- সবাই তুচ্ছ, সবাই অসহায়। তাহলে আমজনতার কিসের আশঙ্কা? আশঙ্কা হল অজানা-র, আশঙ্কা অচেনা-র, অসহায়তার। আমরা যতই একে অন্যকে পিছন থেকে ছুরি মারি, সামনে থেকে বুকে জড়িয়ে ধরি, লেঙ্গি মারি, বোকা বানাই না কেন- এই এক জায়গায় সবাই অসহায়।
জীবনানন্দ লিখলেন,
“মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।”
মাঝে মাঝে মনে হয়, এই যে এ-বছর এত বীর স্বাস্থ্যকর্মী, এত বন্ধু, এত সতীর্থ অকালে চলে গেল- যাওয়ার আগের মুহুর্তে তারা কি ভাবছিল? মৃত্যু কি বড় কষ্টের? শান্তির? স্নিগ্ধতার? ভয়াবহতার? অসহায়তার? কে জানে! মনোবিজ্ঞানীরা, মনোচিকিৎসক-রা বলতে পারবেন হয়ত। এই যে জীবন- উপরে ওঠা, নীচে নামা, অনিশ্চয়তা-র খেলা- তারপর শেষমেশ অতলে তলিয়ে যাওয়া- এর উদ্দেশ্য কি? কেউ জানে না। আর এই না জানাতেই গভীর আশঙ্কা।
মানব জীবনের মহত্ব, বীরত্ব, স্বত্ত্বা, ভালোবাসা, ঘৃণা, তঞ্চকতা, প্রবঞ্চণা, স্বার্থ, পরমার্থ সবশেষে মিলেমিশে একাকার। তবুও মানুষ অনন্ত পথ চলে। সারা জীবন ধরে ভালোবাসে, ঘৃণা করে, ক্ষমা করে, ঈর্ষা করে, লড়াই করে- কারণ মৃত্যু তার একবারই হয়।
পাশ্চাত্য মানুষ মৃত্যু নিয়ে বেশী ভাবে নি। মার্ক টোয়েন লিখেছিলেন-
“আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। জন্মের আগে আমি হাজার হাজার কোটি বছর ধরে মৃত ছিলাম। তাই মৃত্যুতে আমি অস্বস্তিবোধ করি না।”
কাহলিল জিব্রান লিখলেন
“For life and death are one, even as the river and the sea are one. In the depth of your hopes and desires lies your silent knowledge of the beyond; And like seeds dreaming beneath the snow your heart dreams of spring.Trust the dreams, for in them is hidden the gate to eternity.”
এই লেখা ফেসবুকের মেমরি-তে চলে যাওয়ার আগেই হয়ত এই লেখক মেমরি-তে চলে যেতে পারে। তাই এক পরিচিত সাহসী মানুষের মৃত্যুভয়ের কথা বলে তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করি। সেই সাহসী মানুষ হলেন আমার ঠাকুমা সুরবালা নাথ। নাম সুরবালা হলেও জীবনে অনেক অসুরকে দমন করেছিলেন তিনি। দেশভাগ,দাঙ্গা, মৃত্যু, লুটপাঠ,খন্ডিত স্বাধীনতা-র আবহে, স্বামী ব্রিটিশ জেলে- এই অবস্থায়, একা সন্তানদের নিয়ে অসম লড়াই, ব্রিটিশ পুলিশের তল্লাশি, কাটারি হাতে চোর-ডাকাতের মোকাবিলা করা বেঁটেখাটো সাধারণ চেহারার সেই মহীয়সী নারী চলে যাওযার আগের রাতে ছোট ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন,
‘বড় ভয় করছে রে রমেন।’
‘কিসের ভয়?’
‘মরণের।’
ছবি: ইন্টারনেট থেকে