পৌষের শেষবেলায় যখন আকাশে মেঘ-তখন হাতুড়ের ফোন বেজে উঠলো। সেই সিনেমা হলের পাশের-দেশী মদের গন্ধভরা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা চাটের অবশিষ্টাংশের পাশেই এক দোকানীর কাছ থেকে। খবর এলো-একজন মেথর মারা গেছে। এক বেলা মদ পান না করলে তার হাতপা কাঁপতো, ঘাম হতো; এমনও হয়েছে এই বুড়ো হাতুড়ে ওকে মদ কেনার টাকা দিয়েছে-সে মারা গেছে-জোনাথন বাসফোর। কুয়াশার মতো ঝুপ করে’ সেই সব পুরোনো স্মৃতি এসে হাতুড়েকে ঘিরে ধরলো। দৃষ্টি চলে না। চুপটি করে শুধু ভাবতে হয়। সেই কুয়াশা কাটিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে একটা কিশোর বিজলি খুঁটির তলায় দাঁড়িয়ে। জোনাথনের ছেলে। শীতে কুন্ডলী পাকিয়ে থাকা বুড়ি কুকুরের মাথা থাবড়ে দিয়ে একটা পুরোনো প্রেসক্রিপশন লেখার প্যাড বার করে’ হাতুড়ে চললো সেই কিশোরের সঙ্গে।
একটা বাজারের সামনে ঢাকা জায়গায় ওদের বাস। আব্রু নেই। ছাদ আছে-দেওয়াল নেই। পাশে সিনেমার পোস্টার।নিচে মরা জোনাথন আর তার পরিবার। ওখানেই রমণ;ওখানেই মরণ। বহু দিনের চেনা। তখন জোনাথন কিশোর। তবু হাতুড়ের চোখে জল এলো না-দুঃখ হলো না। এদের এভাবেই মরণ হয়। প্রতিদিন। প্রতি মুহূর্তে।হাজারে হাজারে।এই রকম হাতুড়েরা মৃত্যুর কাগজ তৈরি করে দেয়। জোনাথনের আধার কার্ড নেই। ভোটার কার্ড আছে। নাম আছে।বয়স আছে- আটচল্লিশ। ধর্ম লেখা নেই।মেথরের আবার ধর্ম কিসের?
হাতুড়ে মৃত্যুর কাগজ লিখে ওর মেয়ের হাতে তুলে দিলো। মেয়ের কোলে তার সন্তান। বৈবাহিক চিহ্ন নেই।বিয়েই হয়নি তার চিহ্ন!
হাতুড়ের কাছেই সন্তান হয়েছিল। জোনাথন এবং সবাই সেই শিশুকে নিয়ে বড়ো আনন্দে ছিলো। প্রাইড কিলিং নেই।থানা পুলিশ নেই। অত্যাচার নেই। নতুন প্রাণকে বরণ করার আনন্দ ছিলো। তখন এক পাকা দাড়ি-চলচ্চিত্র অভিনেতা দেশী মদ্য পান করতে আসতেন। তিনি গেলাস হাতে বলেছিলেন-’এটাই আমাদের দেশ, এটাই আমাদের সভ্যতা। নেপালে অবিবাহিত নারীর সন্তান এলে বলা হয় “ভুলি হুয়ি”; ভুল করে হয়ে গেছে এবং সমাজ সংসার সবাই তাকে সাদরে গ্রহণ করে। আদিবাসী সমাজের কোথাও নারীদের আমাদের মতো এতো কঠিন নিগড়ে বাঁধা হয়নি’।
জোনাথনের মেয়ে কাগজ নিয়ে বাবার বুকের ওপরে লুটিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। হাতুড়ে কুয়াশা সরিয়ে সরিয়ে ফিরতে থাকে। কে যেন তার হাতে একটা সিগারেট তুলে দেয়, দেশলাই জ্বেলে ধরে। জোনাথন মরে গেছে।
অসাধারন