১৪ বছরের কিশোর লিওনার্ড থম্পসনের উপর ইনসুলিন প্রয়োগ করে সফল হলেন ম্যাক্লাউডের নেতৃত্বাধীন টরন্টো টিম। এই সফল পরীক্ষার পরই দুটো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যাক্লাউড। প্রথমেই তিনি ইনসুলিনের পেটেন্ট করিয়ে নিলেন। ২৫শে জানুয়ারি ১৯২২, কানাডায় পেটেন্ট করানো হলো ইনসুলিনের। পেটেন্ট নম্বর ১,৪৬৯,৯৯৪। না, ইনসুলিনের স্বত্বাধিকারীর তালিকায় নিজের নামে রাখেন নি ম্যাক্লাউড। পেটেন্ট করালেন বান্টিঙ, বেস্ট ও কলিপের নামে। ম্যাক্লাউডের বিচারে এই তিনজনই ইনসুলিনের যোগ্য আবিষ্কর্তা। তিনি নন। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে আবার নিজের বিচক্ষণতা ও উদারতার পরিচয় রাখলেন ম্যাক্লাউড।
এইদিনই আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যাক্লাউড। এবার ইনসুলিন প্রস্তুতির যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দিলেন কনট মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিসের হাতে। এতদিন পর্যন্ত ম্যাক্লাউডের নেতৃত্বে ছোটো এক দল গবেষক, ল্যাবের একটা ঘরে ইনসুলিন প্রস্তুতির দায়িত্বে ছিলেন। এবার ইনসুলিন উৎপাদন, প্রয়োগ, খরচাপাতি, বিধি নিষেধ, আইনি জটিলতা সব দায়িত্ব কনট ল্যাব কর্তৃপক্ষের। সেই মতো আইনানুগ কাগজপত্র তৈরি হলো। ২৫শে জানুয়ারি, ১৯২২, কনট ল্যাবের সাথে চুক্তিপত্র সাক্ষরিত হলো। তাতে সই করলেন চার গবেষক- বান্টিঙ, বেস্ট, কলিপ ও ম্যাক্লাউড। কনট ল্যাবের পক্ষে সই করলেন ডা. জন জেরাল্ড ফিৎজেরাল্ড [পর্ব ৭, পাদটীকা ১৭ দ্রষ্টব্য]। চুক্তিতে, ম্যাক্লাউডকেই ইনসুলিন প্রস্তুতি ও পরিশোধনের নেতৃত্ব দিতে বলা হলো। কনট ল্যাবের পক্ষ থেকে বলা হলো, ম্যাক্লাউড ঠিক করবেন, কে কবে কোথায় কি কাজ করবেন।
থম্পসনের উপর ইনসুলিনের প্রয়োগের সাফল্যকে আরও একটু ঝালিয়ে নিতে চান ম্যাক্লাউড। ফেব্রুয়ারি মাসে ওই হাসপাতালে, একে একে আরও ছ’জন ডায়াবিটিস রোগীকে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই পাওয়া গেল ইতিবাচক ফল। এই সমস্ত সাফল্যই আসছে কিন্তু ‘কলিপ সেরাম’ প্রয়োগ করে। প্রাথমিক এই সাফল্য থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন বান্টিঙের নাম। এরই মধ্যে, ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে, ইউএসএর সেন্ট লুইস থেকে প্রকাশিত ‘দ্য জার্নাল অব ল্যাবরেটরি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল মেডিসিন’এ প্রকাশিত হলো বান্টিঙ-বেস্টের লেখা প্রবন্ধ- ‘দ্য ইন্টারন্যাল সিক্রেশন অব দ্য প্যানক্রিয়াস’। গত ডিসেম্বরে মার্জরির দেহে সফল ভাবে আইলেটিন প্রয়োগের পর এই প্রবন্ধটা লিখেছিলেন তাঁরা। এই প্রবন্ধই আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেয় বান্টিঙকে। কয়েকটা ঘরোয়া সভায় বক্তব্য রাখলেও, ইতিপূর্বে কোনও পত্রিকায় কোনও লেখাই ছাপা হয় নি বান্টিঙের। সে অর্থে এটাই বান্টিঙের লেখা প্রথম প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধের দৌলতেই বিশেষজ্ঞ মহলে পরিচিতি পান বান্টিঙ ও বেস্ট।
২২শে মার্চ ১৯২২ দ্য টরন্টো ডেইলি স্টার পত্রিকার সামনের পাতা। |
৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯২২, টরন্টোর ‘একাদেমি অব মেডিসিন’এ ‘দ্য এফেক্ট অব প্যানক্রিয়াস এক্সট্রাক্ট অন ব্লাড সুগার অ্যান্ড ইউরিনারি সুগার ইন এক্সপেরিমেন্টাল ডায়াবিটিস’ শীর্ষক বক্তৃতা করলেন বান্টিঙ এবং বেস্ট। এখন বক্তৃতা করায় কিছুটা সাবলীল হয়েছেন বান্টিঙ। এখন স্বচ্ছন্দে ভাষণ দিতে পারছেন তিনি। ২২শে মার্চ ১৯২২, ‘কানাডিয়ন মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন জার্নাল’এ প্রকাশিত হলো বান্টিঙ, বেস্ট, কলিপ, ক্যাম্বল, ফ্লেচারের যৌথ রচনা ‘প্যানক্রিয়াটিক এক্সট্রাক্টস ইন দ্য ট্রিটমেন্ট অব ডায়াবিটিস মিলিটস’। ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে, টরন্টো জেনারেল হাসপাতালে লাগাতার ইনসুলিন প্রয়োগের সাফল্যের কথা সামনে আসতে থাকে। ২২শে মার্চ ১৯২২, ‘দ্য টরন্টো ডেইলি স্টার’ পত্রিকার প্রথম পাতার ৮ কলাম জুড়ে করা হেডলাইনসে ডায়াবিটিসের বিরুদ্ধে টরন্টো টিমের সাফল্য ঘোষণা করা হয়। বান্টিঙ, বেস্ট, ম্যাক্লাউড ও কলিপের ছবি সহ বিস্তারিত ভাবে ছাপা হয় তাঁদের গবেষণার কাহিনী। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ জুড়ে সংবাদ শিরোনামে চলে আসেন বান্টিঙ ও তাঁর সহযোগীরা।
বান্টিঙ ভালো করেই জানেন প্রবন্ধ লেখা তাঁর কাজ নয়, তিনি প্রবন্ধ লিখতেও চান না। তাঁর কাজ ইনসুলিন তৈরি করা, পরিশোধিত ইনসুলিন। আর এই কাজে এখনও পুরোপুরি সফল হন নি তিনি। ‘সফল হন নি’ না বলে বরং বলা ভালো ‘ব্যর্থই হয়েছেন’। সফল হয়েছেন কলিপ। টরন্টোর হাসপাতালে যে ক’টা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে এখনও পর্যন্ত, তার সব কটাই কলিপের তৈরি। বান্টিঙের তৈরি ইঞ্জেকশন কোথাও প্রয়োগই করা হচ্ছে না। এই খবরটা আবার চাপাও নেই কোথাও। প্রায় সবাই জেনে গেছেন, কলিপের তৈরি ইঞ্জেকশন দিয়েই সাফল্য এসেছে। আর কলিপের সাথে জুড়ে আছে ম্যাক্লাউডের নাম। বান্টিঙের নাম চলে গেছে অন্তরালে। ব্যর্থ, সর্বতো ভাবে আজ ব্যর্থ তিনি। এই ব্যর্থতার মধ্যে তাঁর স্বপ্নের সামাধি দেখতে পাচ্ছেন বান্টিঙ।
ঠিক এই সময়ই শুরু হয় এডিথ রোচের সাথে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন। গত কয়েক মাস ধরেই বিয়ে নিয়ে বান্টিঙকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে আসছেন এডিথ রোচ। কতদিন আর বান্টিঙের জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন তিনি? রোচ চাইছেন এখনই সেরে ফেলা হোক বিয়েটা। বিয়ে নিয়ে বান্টিঙকে জোরাজুরি করতে থাকেন রোচ। বিয়ে? বান্টিঙ বিস্মিত, ক্ষিপ্ত। ইনসুলিন নিয়ে তাঁর স্বপ্ন শেষ হবার মুখে, আর এখন বিয়ে? তাঁর স্বপ্নের শশ্মানে বসে বিয়ে করবেন তিনি? জাহান্নামে যাক বিয়ে।
উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন বান্টিঙ। একদিকে তাঁর তৈরি আইলেটিনের ব্যর্থতা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, সর্বোপরি কলিপের সাফল্য- ঝড়ের রাতে দিকভ্রান্ত মাঝির মতো দশা তাঁর। উত্তরণের কোনও দিশাই আর দেখতে পাচ্ছেন না তিনি, ধীরে ধীরে হারিয়েই ফেলছেন সমস্ত উৎসাহ। ক্রমেই মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করলেন বান্টিঙ। এবার একটু বেশিই ভেঙ্গে পড়লেন যেন। মদ্যপানে আগাগোড়াই অভ্যস্থ ছিলেন তিনি। তবে এবার যেন মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে চলল অ্যালকোহল সেবনের মাত্রা। অস্বাভাবিক মাদকাসক্ত হয়ে পড়লেন বান্টিঙ। প্রবন্ধের শুরুতেই, আমরা দেখেছি মদ বরাদ্দ নিয়ে গোটা অন্টারিয় প্রদেশে একটু কড়া নিয়মই ছিল সেই সময়। ইচ্ছা মতো মদ পাওয়া যেত না তখন। এদিকে মদের নেশায় চূড় বান্টিঙের তখন প্রয়োজন আরও মদ। কিন্তু কোথায় মদ পাবেন তিনি? মদের প্রেসক্রিপশন লিখেই একদিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন তিনি, আজ তাঁর মদের প্রেসক্রিপশন লিখবেন কোন ডাক্তার? কোথাও মদ না পেয়ে, শেষ পর্যন্ত, নিজের ল্যাবের জন্য বরাদ্দ করা অ্যালকোহল থেকে চুরি করে নেশা করতেন তিনি। যেহেতু ল্যাবে অ্যালকোহল বরাদ্দের নির্দিষ্ট কোটা থাকত, সেই হিসেবে প্রায়ই ঘাটতি ধরা পড়তো। বান্টিঙই যে এই অ্যালকোহল সরাচ্ছেন তা বুঝতে অসুবিধা হলো না কারও। একদিন এতটাই নেশা করলেন তিনি যে কোনও সাড়ই পাওয়া গেল না তাঁর। বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন বান্টিঙ। ডাকাডাকি করেও কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না তাঁর। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন তিনি।
গত ডিসেম্বর মাসেই সফল ভাবে ইনসুলিন পরিশোধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন কলিপ। কাজ করার সময় সমগ্র পরিশোধন প্রক্রিয়াটা কোনও নোট বইয়ে গুছিয়ে লিখে রাখতেন না কলিপ। সবটাই মুখস্থ থাকতো তাঁর। স্মৃতিতে সাজানো থাকত পদ্ধতির ধাপগুলো। স্মৃতিতে সাজানো সেই ধাপগুলো ঠিক ঠিক ভাবে প্রয়োগ করেই এতদিন ধরে ইনসুলিন পরিশোধন করে এসেছেন তিনি। ১৯২২ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে জানা গেল কলিপের পরিশোধিত ইনসুলিন প্রয়োগ করে তেমন আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না আর। কেন? কলিপের পরিশোধিত ইনসুলিন আজ আর ঠিক মতো কাজ করছে না কেন? এতদিন তো ঠিকঠাক ভাবেই কাজ করে আসছিল কলিপের পরিশোধিত ইনসুলিন? তাহলে আজ আর তা কাজ করছে না কেন? জানা গেল, ইনসুলিন পরিশোধনের পর্যায়গুলো এখন আর ঠিক মতো স্মরণ করতে পারছেন না কলিপ। পরিশোধনে ব্যবহৃত রাসায়নিকের পরিমাপ, তাপমাত্রা ঠিক মতো আর মেলাতে পারছেন না তিনি। পুরো পদ্ধতিটাই ঘেঁটে গেছে। তাই ইদানীং যে পদ্ধতিতে ইনসুলিন পরিশোধন করছেন তিনি, তা প্রয়োগ করে বিশেষ সাফল্য আসছে না আর। বিষয়টা জানাজানি হতেই, মাথায় হাত ম্যাক্লাউডের। সর্বনাশ! এসব কি শুনছেন তিনি? পরিশোধন পদ্ধতির কোনও নোট নেই কলিপের কাছে? এ কেমন গবেষণা! যদিও কলিপ মনে করেন, এটা সাময়িক বিস্মৃতি। চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব শীঘ্রই পরিশোধিত ইনসুলিন নিষ্কাশনে সক্ষম হবেন তিনি।
‘খুব শীঘ্রই’? ‘খুব শীঘ্রই’ মানে কি? -ক্ষুব্ধ ম্যাক্লাউড প্রশ্ন করেন কলিপকে। তিনি বলে চলেন, ‘হাসপাতালে রোগীর ভিড় বাড়ছে প্রতিদিন। প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে ইনসুলিনের চাহিদা। আর কলিপ এখন বলছেন ‘খুব শীঘ্রই’! আজ, এখনই, ইনসুলিন প্রয়োজন তাঁর। ইনসুলিন না পেলে কি জবাব দেবেন তিনি রোগীদের?’ না, না, না, এভাবে চলতে পারে না কোনও গবেষণা। পরিশোধনের জন্য কলিপের উপর আর ভরসা করতে পারছেন না ম্যাক্লাউড। এবার বিকল্প ভাবতে হচ্ছে তাঁকে। বিকল্পের কথা ভাবতে শুরু করল ‘কনট ল্যাব’ও। কলিপ তাঁর চেষ্টা জারি রাখুন, কিন্তু কলিপের পাশাপাশি আরও এক দলকে ইনসুলিন পরিশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হলো। রসায়ন বিজ্ঞানে গবেষণা রত ছাত্র মলোনি[৩২] কে তলব করা হলো। ইনসুলিন পরিশোধনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো তাঁর হাতে। কি কি করা হয়েছে এই পর্যন্ত আর কি কি করা বাকি আছে এখনও, বিস্তারিত ভাবে তা বুঝিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। সহকারী হিসেবে ডন এম. ফিন্ডলেকে, জুড়ে দেওয়া হলো মলোনির সাথে। বলা প্রয়োজন, দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বিশুদ্ধ ইনসুলিন উৎপাদনে সফল হলেন মলোনি এবং ফিন্ডলে।
ম্যাক্লাউডের তৈরি করা তথাকথিত ‘টরন্টো টিম’এর সদস্য ছিলেন না মলোনি। তাই মলোনি এবং ফিন্ডলের সাফল্যের খবর তেমন কেউই জানতেন না। ইনসুলিন পরিশোধনের বছর দেড়েক পর, ১৯২৩ সালের শেষের দিকে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পিএইচডি লাভ করেন মলোনি। এই সময়ে, ‘অন দ্য পিউরিফিকেশন অব ইনসুলিন’ শীর্ষক নিজের পিএইচডি পেপার জমা দেন মলোনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট মহলের বাইরে অবশ্য এই নিবন্ধের খবর কেউ জানতেন না। তবে জানলেন, কয়েক সপ্তাহ পর জানলেন সবাই। ৫ই জানুয়ারি ১৯২৪ সালে, টরন্টো স্টার পত্রিকায়, ছবি সহ ইনসুলিন পরিশোধনে মলোনির সাফল্যের খবর পরিবেশন করা হলো। সেদিনের পত্রিকার প্রথম পাতার হেডলাইনসে লেখা হয় ‘ইনসুলিন পরিশোধনে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত’। সাবহেডিংএ লেখা হয়: আরও শুদ্ধ এবং আরও সস্তার হোক নির্যাস- ব্যবহার প্রশস্ত হোক’। সংবাদে লেখা হয়, “এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ধৈর্য্য ও শ্রমসাপেক্ষ গবেষণার পর, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক দুই রসায়নবিদ, পি.জে. মলোনি এবং ডি.এম. ফিন্ডলে, পরিশোধন পদ্ধতি নির্ণয়ে সফল হয়েছেন, …”।
পিটার মলোনি, পরিণত বয়সে |
কি ছিল মলোনির সাফল্যের চাবিকাঠি? নিজের পিএইচডি পেপারেই তা ফাঁস করেছেন মলোনি। কলিপ বা অন্যান্য গবেষকদের অনুসৃত পদ্ধতি মতো[৩৩], সংগৃহীত প্যানক্রিয়াস নির্যাসকে প্রাথমিক ভাবে একবার পরিশোধন করে নিয়েছিলেন মলোনি। কিন্তু সেই পরিশ্রুত দ্রবণে তখনও মিশে ছিল রাসায়নিক অপদ্রব্য। প্রাথমিক ভাবে পরিশ্রুত এই দ্রবণে বেঞ্জোয়িক অ্যাসিড যোগ করেন মলোনি। পরিষ্কার করে ধোয়া সক্রিয় চারকোল গুঁড়ো প্রস্তুত রেখে ছিলেন মলোনি। অ্যাসিড মিশ্রিত সেই দ্রবণে এবার সক্রিয় চারকোল গুঁড়ো যোগ করলেন তিনি। এই মিশ্রণকে মাঝে মাঝে মৃদু ঝাঁকাতে থাকেন তিনি। দ্রবণ থেকে কেবল মাত্র ইনসুলিন শোষণ করতে শুরু করে এই সক্রিয় চারকোল গুঁড়ো। কিছু সময় পর, ফিল্টার করে দ্রবণ থেকে চারকোল গুঁড়োগুলোকে ছেঁকে নেন মলোনি। এই চারকোল গুঁড়োর মধ্যেই রয়ে গেছে বিশুদ্ধ ইনসুলিন। ছেঁকে নেওয়া এই চারকোল গুঁড়োর সাথে অ্যালকোহল মিশিয়ে, চাপ বা তাপ প্রয়োগ করলেই চারকোল থেকে বের হয়ে আসবে বিশুদ্ধ ইনসুলিন। মলোনির এই পদ্ধতি ‘ফ্রাকশ্যানাল এবসরবসন’ নামে পরিচিত।
বস্তুত মলোনির এই ‘ফ্রাকশ্যানাল এবসরবসন’ই ছিল সেই সময়ের ইনসুলিন পরিশোধনের সর্বোত্তম পদ্ধতি। প্রকৃতপক্ষে, মলোনি পরিশোধিত ইনসুলিন ব্যবহার করেই সাফল্যর চূড়ায় উঠে আসে ইনসুলিন বৃত্তান্ত। কিন্তু অন্তরালে রয়ে যান পিটার মলোনি। আশ্চর্যের বিষয় এই যে ইনসুলিন সংক্রান্ত কোনও আলোচনাতেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না মলোনির নাম। ইনসুলিন পরিবারে চিরকাল ব্রাত্যই রয়ে গেলেন মলোনি এবং ফিন্ডলে।
মলোনি তখনও ইনসুলিন পরিশোধনে ব্যস্ত। কলিপ তাঁর পরিশোধন পদ্ধতি ভুলে গেছেন। এই মুহূর্তে বাজারে কোনও ইনসুলিনই নেই। এখনই তো সুযোগ নিজেকে প্রমাণ করার। আর এই চরম মুহূর্তে বান্টিঙ কিনা নেশা করে দিন কাটাচ্ছেন! বান্টিঙের এই চরম হতাশার দিনে হাল ধরলেন তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী চার্লস বেস্ট। ৩১শে মার্চ ১৯২২, রাত ১০.৩০ নাগাদ বান্টিঙের বাড়ি উপস্থিত হলেন বেস্ট। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন। জানালেন, নতুন করে আর ইনসুলিন পরিশোধন করতে পারছেন না কলিপ। মলোনি তখনও ব্যস্ত ইনসুলিন পরিশোধন করতে। সুযোগ আছে, এখনও সুযোগ আছে আমাদের কাছে। কেন না আমরা আমাদের গবেষণা জারি রেখে, আরেক আবার আইলেটিন পরিশোধন করে দেখি। নেশাতুর বান্টিঙ চুপ করে সব শুনলেন তখন। না জানি কি বুঝলেন, পেয়ালায় ঢেলে রাখা মদটা শেষবারে মতো গলায় ঢেলে দিলেন তিনি। পরে বান্টিঙ লিখেছেন, “সেটাই ছিল আমার শেষ পেয়ালা যা কোনও ডায়াবিটিক শিরায় ইনসুলিন দৌড়বার আগে গ্রহণ করেছিলাম আমি”।
পরদিন সকাল ৯টা, চনমনে বান্টিঙ হাজির কনট ল্যাবে। নেশা আর হতাশা কাটিয়ে আবার নতুন করে ইনসুলিন প্রস্তুত করতে মনস্থির করে ফেলেছেন তিনি। সৌজন্য, চার্লস বেস্ট। দুজনে মিলে আবার শুরু করলেন তাঁদের সাধের ইনসুলিন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রস্তুত করলেন তাঁদের স্বপ্নের আইলেটিন। বান্টিঙ ও বেস্ট মিলে পরিশোধনও করলেন সেই ইনসুলিন। ইনসুলিনের ইতিহাসে এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ। শুধু বান্টিঙ বা বেস্টই নন, এই একই সময়ে টরন্টোয় বসে ইনসুলিন পরিশোধন করে চলেছেন বারট্রাম কলিপ, ইনসুলিন পরিশোধনে মগ্ন পিটার মলোনি। এঁরা ছাড়াও ইউএস-কানাডার একাধিক গবেষক একান্তে পরিশোধন করে চলেছেন ইনসুলিন। যে কোনও মুহূর্তে আসতে পারে চরম সাফল্য। কে হবেন সেই ভাগ্যবান আবিষ্কারক?
(চলবে)
[৩২] অন্টারিয় প্রদেশেরর পেনেট্যাঙ্গুইসিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন পিটার জোসেফ মলোনি (১৮৯১-১৯৮৯)। ১৯১২ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ১৯১৫ সালে এমএ পাশ করেন মলোনি। ১৯১৯ সালে ‘কনট মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিস্’এ চাকরি পান। চাকরির পাশাপাশি রসায়নে পিএইচডি করতে থাকেন তিনি। ১৯২৩ সালে পিএইচডি অর্জন করেন মলোনি। ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কনট ল্যাবের ‘এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর’ পদে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৬৪ সালে বান্টিঙ মেডেল এবং ১৯৭১ সালে চার্লস বেস্ট মেডেল দিয়ে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। ইনসুলিন ছাড়াও ডিপথেরিয়া প্রতিষধক, পেনিসিলিন প্রভৃতি নিয়েও গবেষণা করেছেন মলোনি।
[৩৩] ৩০শে ডিসেম্বর ১৯২১, ন্যু হাভেনের সভায় ইনসুলিনের গবেষণা পদ্ধতির উপর আলোকপাত করেছিলেন ম্যাক্লাউড। সেই ঘোষণার পর, ইনসুলিন নিষ্কাশন ও পরিশোধনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ইউএসএ এবং কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। অন্তত ১০-১২টা দল ইনসুলিন পরিশোধনে বেশ খানিকটা অগ্রসরও হয়েছিলেন। এই সমস্ত গবেষকদের ছোটোখাট সাফল্য দেখেই, ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে নিজেদের আবিষ্কার পেটেন্ট করিয়ে নিয়েছিলেন ম্যাক্লাউড। এই সমস্ত গবেষক দলের মধ্যে, বেশ কয়েকটা দলের পরিশোধন প্রক্রিয়ার খোঁজখবর রাখতেন মলোনিও।