ডেকার্স লেনের চিত্তদা’র দোকানের সামনে বেঞ্চের ওপর ব্যাগটা রেখে বসলেন ভদ্রলোক। আশ পাশে দু’ চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। এখন দুপুর দুটো বাজে। শম্ভু সামনে এসে দাঁড়াতে তিনি কিছু বললেন।
কেউ চায়ে চুমুক দিচ্ছে তো কেউ কড়া টোষ্টের সাথে ফিস ফ্রাই বা চিকেন পকোড়া খাচ্ছে। তাঁর প্রিয় খাদ্য অবশ্য চিকেন স্টু আর স্যাঁকা রুটি। সবসময় যে সেটাই তিনি নেন তেমন নয়। এক প্লেট ঘুগনি এবং রুটিতেও তার দিব্যি চলে যায়।
প্রিয় ক্যামেরাটা কাঁধ থেকে ঝুলছে । অনেক পুরোনো দিনের সাথী। গতবার যখন তিনি সুশীলের কাছে সারাতে দিয়েছিলেন। সে বলেছিল,- তনুদা এবার এটাকে ছাড়ুন। একটা ডি এস এল আর নিন। ডিজিটাল যুগ আসছে এখন এইসব পুরোনো জিনিস সারাতে গেলে সব পার্টস মেলে না। আর রোল ও তো কোডাক কোম্পানী কয়েকদিন বাদে বন্ধ করে দেবে। প্রিন্টিং খরচাও তো অনেক বেশি।
– এটা বিক্রি হবে সুশীল ?
– কি যে আপনি বলেন না! আশিতে কেনা নিকন এফ থ্রি। চল্লিশ বছর পরে কেউ কিনবে ? তায় আবার ছাল চামড়া উঠে এক শা’ ।
-একথা বলো না সুশীল, তোমার মনে আছে সে কথা ?টেলিগ্রাফে আমার প্রথম ছবিটা ফ্রন্ট পেজে একটা বড় ক্যাপশান দিয়ে ছাপা হলো। তখনও এটা কেনা আমার স্বপ্ন ছিল ।
– সে আর মনে নেই। একটা সাদা-কালো অসম্ভব সুন্দর ছবি তুলেছিলেন ।
– শক্তিদা ক্যাপশানটা দিয়েছিলেন । সেটা ইংরাজি করেছিল ডেস্কের অন্য একটা অ্যাপ্রেনটিস ছেলে, বিভাস না কি যেন নাম।
– একটা বটের পাতা, দুটো ফল,আর একটা বর্ষা ফলকের মতো কচিপাতার মোড়ক ।
– দা ড্রপ। সবাই হৈ হৈ করে প্রশংসা করতে লেগেছিলো।
শম্ভু কখন দু পিস স্যাঁকা পাঁউরুটি আর এক প্লেট ঘুগনি এনে সামনে ধরেছে খেয়াল করেন নি। – বাবু নিন। ঠান্ডা হয়ে যাবে।
এই শম্ভুর ছবিও একবার কলকাতার কড়চায় ছাপা হয়েছিলো। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, এক মুখ হাসি। হাতের প্লেটে টোস্ট আর ফিস ফ্রাই। মেহনতি শ্রমিকের মুখে কাজের মধ্যেও অনাবিল হাসি। সে ছবিও বেশ কদর পেয়েছিলো। তবে প্রথম ছবি যেটা তাকে ফোটোগ্রাফার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলো সেটা ঐ বটপাতা ও ফলের একটা স্তবক। ছিঁড়ে পড়ে ছিল গাছ থেকে ট্রাম ডিপোর কাছে রাস্তায় পুলিশ পোষ্টের পাশে ।
গত দেড় মাসে তিনি কোন ছবি তুলতে পারেননি। শরীরটা ঠিক নেই। একটা চোখের ছানি অপারেশন হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে। একেবারে নিঁখুত হয় নি। আসলে একটু বেশি পেকে গেছিলো, দোষ তাদের নয় ।
এখন শাটার চাপতে গেলে হাতটা কেঁপে যায়। পি জি হাসপাতালের নিউরোলজিতে একবার দেখিয়েছিলেন। তারা বলেছে পারকিন্সনিজম। এটা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। ওষুধ পত্র কিছু লেখেনি।
খালি প্লেটটা ফেরৎ নিয়ে শম্ভু চায়ের কাপটা পেয়ালা সমেত ধরিয়ে দিল। – গরম আছে, আস্তে আস্তে খান।
চা টা হাতে ধরে চুমুক দিয়ে গিয়ে একটু চলকে পড়লো। তিনি আর শম্ভু ছাড়া কেউ ব্যাপারটা নজর করেনি। সপ্তাহে তিনি অন্ততঃ তিনদিন টালা থেকে এদিকে আসেন। মিছিলের দিকে তাকান। খেলার মাঠের দিকে যান। বাবুঘাটে বা মল্লিকবাজার ঘাটের ফুলের বাজারে যান। ছবি তোলেন।অন্ততঃ তোলার চেষ্টা করেন। পুলিশের লোক তাকে রাস্তা ছেড়ে দেয়। তারা তাঁর বিবর্ণ হয়ে যাওয়া বেঙ্গল প্রেস ক্লাবের আইডেন্টিটি কার্ডটা এখন আর দেখতে চায় না। শেষ কবে কোথায় দেখাতে হয়েছে তারও খেয়াল নেই।
পয়সা মিটিয়ে চিত্তদার দোকান থেকে চলে আসেন। কাঁধের ব্যাগটাকে বেশ ভারী মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম ডিপোর কাছে চলে আসেন। সেই বট গাছটা অনেকটা বড় হয়ে গেছে। ঝাঁকড়া হয়ে গেছে।
সেদিনের কথাটা মনে আছে। একটা পেনট্যাক্স কে থাউজ্যান্ড ক্যামেরা, সাধারণ মানের অবশ্যই। এটাতেই শখের ছবি তোলেন। আর ঘুরে বেড়ান কলকাতার অলিতে গলিতে ছবির সন্ধানে । ডালহৌসি, বাবুঘাট, ভিক্টোরিয়া চত্ত্বর,গড়ের মাঠ, কুমোরটুলি। কত জায়গায়। ছবি তোলেন আর প্রিন্ট করে রেখে দেন নিজের কাছে।
তার টিউশনি নির্ভর জীবনে, অবসর যাপনে এই ক্যামেরাটা বড় সঙ্গী। একজনের কাছ থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড কেনা। একটু ফাঙ্গাস ছিলো লেন্সে। অল্প দৈর্ঘ্যের জুম লেন্স। অনুকূল ক্যামেরা হাউজের সুশীল ঘোষদা’ই পরিষ্কার করে দিয়েছিলো।
সেদিন শুক্রবার ছিলো, মনে আছে । কোন কারণে আদিবাসীদের একটা মিছিল ও জমায়েত ছিল এসপ্ল্যানেড ইস্টের সিধু কানু ডহরের কাছে। বাঁকুড়া,পুরুলিয়া ও আশে পাশের জায়গার বেশ কিছু লোকজন এসে এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল ধর্মতলায়। তার মধ্যে কয়েকজনের পরিচ্ছদে তাদের সংস্কৃতির পোশাকও পরা ছিলো।
তাঁর নিজের আদি বাড়ি বাঁকুড়ায়,তাই তাদের মধ্যে একটা ছেলের সাথে আলাপ করছিলেন । ছেলেটা একজন আদিবাসী পুরুষের পোশাক পরেছিল। মাথায় একটা রঙীন ফেট্টি আর সেখানে একটা পাখির পালক গোঁজা ছিলো। কাঁধে একটা ধনুক। মুখটা অসম্ভব সরলতায় ভরা। কথার মাঝে দু হাত আকাশের দিকে করে সে কিছু আপন ভাষায় বোঝাতে চাইছিল।
তার একটা ছবি নেওয়ার ইচ্ছা মনের কোণে চলে এলো। তিনি ক্যামেরাটা তাক করে শাটার টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওপর থেকে পাখির ঠোকরে হোক বা কাঠবিড়ালির দাঁতের কামড়ে হোক দুটো বট ফল পাতা সমেত খসে পড়ার সময় ছবির মাঝখানে এসে পড়ে। ওটা যে ছবিতে ধরা পড়েছে সেটা নজরে পড়লো প্রিন্ট নেয়ার সময়। যেখানে তিনি ছবি প্রিন্ট করান সেই ‘বোর্ন এন্ড শেফার্ড’- এর এস্ এন্ ব্যানার্জি রোডে দোকানের পাশে মেট্রোপলিটন ফোটোগ্রাফি-তে, তাদের বোধহয় কোন কারণে ভালো লেগেছিল ছবিটা।
তারাই উদ্যোগ নিয়ে একটা ঠিকানা দিয়েছিল। প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার স্ট্রিটের, একটা প্রকাশনা সংস্থার। তিনি গেছিলেন এবং ছবিটা জমা দিয়েছিলেন।
তারা বসতে বলেছিল এবং তারও কিছুক্ষণ বাদে তাকে ডেকে বলা হয়, – আপনার ছবি কাল কিম্বা পরশু ছাপা হবে প্রাত্যহিক ইংরেজি সংবাদপত্রে। আপনাকে কিছু কাগজ-পত্রে সই করতে হবে।
পরদিনই কাগজের প্রথম পাতায় সাদা কালোতে ছাপা হলো ছবিটা। ক্যাপশান সমেত। এই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর কাজে তিনি যে একজন ভালো ফোটোগ্রাফার সেটা আস্তে আস্তে প্রমাণিত হলো।
কলকাতার কড়চা, জেলার খবর, খেলার মাঠের সংবাদ বিভিন্ন বিভাগে বেশ কিছু ছবি ছাপা হলো। নাম করা বাংলা,ইংরাজি বা অনামী অল্প নামী সব ধরনের কাগজে এবং পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হতে থাকলো।
বছরের শেষে তার প্রাপ্তির ঘরে এলো দুটো জিনিস । এক নম্বর,নিউজ ফটোগ্রাফার হিসাবে তিনি রাজ্যে বর্ষসেরা নির্বাচিত হলেন। আর দ্বিতীয় প্রাপ্তিটা তাঁর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানো ব্যাপার । জন্ম শিক্ষা বাসস্থানের নথিপত্র আর একটা চরিত্র ও কর্মের শংসা পত্র জমা পড়লো এইচ আর ডিপার্টমেন্টে, একটা বড় পাবলিকেশন হাউজে। ইন্টারভিউতে তাঁকে নানারকম প্রশ্ন করা হলো এবং শেষ অবধি তাঁকে শিক্ষানবিশ ফোটোগ্রাফার হিসাবে কাজে যোগদান করতে বলা হলো। এটা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা অবশ্যই।
ছবি দেখার চোখ, ভালো ছবি করার ইচ্ছা তাঁর মধ্যে ছিলই। এখন চাকরির একটা নিরাপত্তা পাওয়াতে তাঁর ছবি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ইচ্ছা হলো এবং কম বেশি সফলও হলেন। তাঁর ছবি এবং ফোটোগ্রাফি বিষয়ে পড়াশুনার ইচ্ছা ছিলো। সেটা হলো আর দু’চারটা হাতে কলমে শিক্ষার কোর্স করে নিলেন।
তাঁর দিন কাল এভাবেই বেশ চলছিল। কাজের দায়িত্ব বাড়ে, জুনিয়ার ছেলে মেয়ে কাজে জয়েন করে তাদের কাজ বোঝানো,ওয়ার্কশপ করানো। সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে পর্যালোচনার মিটিং বসানো। এসব নিয়ে অনেকটা বছর পেরিয়ে গেলো ।
মাঝে মাঝে অন্য হাউজ থেকে চাকরির অফার আসে। কিন্তু তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখান করেন। অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি মানে যারা বিজ্ঞাপনের ছবি বানায় তারা ডাকে। কিন্তু তিনি শুধু একটা পরিবর্তনই করেছেন কর্মক্ষেত্রে আর কর্মজীবনে। একটা নতুন নিকন ক্যমেরা জোগাড় করেছেন বিদেশ ফেরৎ এক বন্ধুর থেকে। তাঁর প্রিয় নিকন এফ থ্রি ক্যামেরা ।
আরো একটা ক্যামেরা তাঁকে আকর্ষণ করে ক্যানন এ ওয়ান। আর্থিক সাচ্ছন্দ্য আসাতে তিনি খিদিরপুরের ফাইভ স্টার মার্কেট থেকে সেটাও কেনেন কিন্তু খুব বেশি ব্যবহার করা হয়নি।
তাঁর জীবনের ভালোমন্দ সবই এই প্রকাশনা সংস্থার সাথে জড়িয়ে। তবে ফ্রি -ল্যান্সার হিসাবে তাঁর যে নাম ছবির নীচে আগে ছাপা হতো এখন আর সেটা থাকে না।সেখানে স্টাফ ফোটোগ্রাফার এই গোষ্ঠী নামের আড়ালে সব চাপা পড়ে যায়। শিল্পকর্ম তারিফ পেলেও আলাদা করে শিল্পীকে চিহ্নিত করা যায় না।
সেদিন বারাসাতে একটা নিমন্ত্রণ বাড়িতে গেছিলেন। স্ত্রীর তরফের কোন আত্মীয়ের বিয়ে ছিল।
পরিচিত একজন ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করলেন, – তনুদা এখন আর ছবি তোলেন না ? আমরা কতো গর্ব বোধ করতাম আপনার নাম কাগজে ছাপা হলে। কলেজ ক্যান্টিনে আলোচনা করতাম।
– না, মানে এখনও ছবি ছাপা হয় তবে ঐ স্টাফ ফটোগ্রাফার হিসাবে।
– ওঃ, চাকরি ? আমরা ভেবেছিলাম আপনি লড়াইটা চালিয়ে যাবেন। হয়তো রঘু রাই বা নিমাই ঘোষের সাথে আপনার নাম উচ্চারিত হবে।
একটা কোথাও আঘাত লাগলো কি? নিশ্চিন্ত জীবনের ছত্রছায়া পেয়ে তিনি কি শিল্পীর কঠিন লড়াই আর উদ্ভাবনী প্রতিভাকে দূরে নিক্ষেপ করেছেন। লড়াই শব্দটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো।
– কি গো চলো, দেরি হয়ে যাবে তো। অনেকটা দূরে যেতে হবে।
তিনি কাজের সুবিধা আর ছেলের পড়াশুনার জন্য টালা পার্কের কাছাকাছি একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনেছেন। ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা কাছাকাছি। তাই সে আসেনি।
ঐ মন্ডপেই আরো একজন আত্মীয় একই কথা শোনালেন, – বাব্বাঃ , তুমি কি সুন্দর ছবি তুলতে। কি করে হারিয়ে গেলে?
মধ্যমগ্রাম পেরিয়ে সোদপুরের দিকে ভাড়া গাড়িটা মোড় নিতেই তিনি চোখটা বুজিয়ে মাথাটা হেলিয়ে দিলেন পিছনের সিটে।
– কি গো শরীর খারাপ লাগছে ? কিছুই তো খেলে না। মাথা ব্যথা করছে?
– না তা নয়। আমি ভাবছি অন্য কথা। ছেলের এখনো দু বছর লাগবে কোন টেকনিক্যাল কোর্সে ঢুকতে। সেটা তো ঠিক?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন? তুমি তো কোনদিনই এ ব্যাপারটা দেখো না। হঠাৎ করে কেন নজর দিচ্ছো ?
– না নজর দিচ্ছি না। আপাততঃ আমি দু বছর যেখানে আছি সেখানেই থাকবো ছেলের পরীক্ষা অবধি। তারপর আমি আগাম অবসর নেব, আমার কুড়ি বছর চাকরি হয়ে গেছে।
– তুমি কি পাগল হয়ে গেছো ? ছেলের পড়া, ফ্ল্যাটের ই এম আই, কত খরচা কোন আইডিয়া আছে? এখন চাকরি ছাড়বো বললেই হয়। কে দেবে চাকরির নিরাপত্তা?
– আমি ফ্রি ল্যান্সিং করবো। ভালো ছবি তুলবো।
– তাতে আমার লাভ? আমাকে সংসার চালাতে হয়। তুমি কবে সংসার দেখেছো?
– তাই বলে আমি আমার কাজ করতে পারবো না?
– দেখো আমি একজন বড় পাবলিশিং হাউজের চাকরিজীবীকে বিয়ে করেছিলাম। ফ্রিল্যান্সারকে নয়। আমার চাহিদারও তো একটা মূল্য আছে। তোমার শখের জন্য আমরা সাফার করবো সেটা তো হতে পারে না।
তনুবাবু বুঝলেন স্ত্রীর যুক্তি অকাট্য । আবার মনে হল নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার কি কোন মূল্য নেই? আর বিশেষ কোন কথা হলো না দুজনের, শুধু বোঝা গেল একটা দূর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি হচ্ছে তাদের বোঝাপড়ার মধ্যে। আত্মসমর্পণ করলেন তনু সেন। মেনে নিলেন তাঁর বর্তমান কাজের জায়গাটাকে। জলাঞ্জলি দিলেন রঘু রাই কিম্বা নিমাই ঘোঘ হওয়ার বাসনা ও স্বপ্নকে।
বছর দুয়েক পেরিয়ে গেল। ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সুযোগ পেল মাঝারি মানের একটা সরকারি কলেজে। অতি অবশ্যই অনেকটা পাওনা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে। সে হোস্টেলে চলে গেল, তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে ।
এই সময়ে শুরু হলো বিশ্বজুড়ে রিসেশনের কোপ। তার ঢেউ এসে পড়লো তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে। বড় বাজারের ফুটপাতে ঝুঁড়ির মধ্যে শোয়া অলস মুটের ছবি বেরোলো আর্থিক অধোগতির ক্যাপশান দিয়ে। সেটা তনু সেনের ছবি। এটাও সাদা-কালোতে তোলা এবং নিকন ক্যমেরায়। সেটাই যে তাঁর অত্যন্ত প্রিয় গ্যাজেট। এদিকে অফিসে লে-অফ, ওভার-টাইমের কাট ছাট, টিএ ডিএ বিলের পেন্ডিং স্ট্যাটাস নিয়ে স্টাফদের মধ্যে কানাঘুষো শুরু হলো।
দিন সাতেক বাদে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের এস্টাবলিশমেন্ট সেকশনের হালদার বাবু ফোন করে ডেকে নিলেন তাঁকে।
আশঙ্কা আর আশা দুটোই দোদুল্যমান। নিস্তার কি পাবেন এবার চাকরি থেকে? ছেলের পড়ার খরচ, হোস্টেলের খরচা, ফ্ল্যাটের লোন সেটাই বা মেটাবেন কি করে?
হালদার বাবু সরল মানুষ কিন্তু কঠিন একটা পদে বসলেও তার কাজে কর্মে কথায় বার্তায় প্যাঁচ-ঘোঁজ কম। – তনু বাবু। বলতে খুবই খারাপ লাগছে কিন্তু ম্যানেজমেন্ট যে ফায়ার লিষ্টটা বানিয়েছে, তাতে আপনার নামটা আছে। বুঝতে পারছেন, কি বলতে চাইছি?
– সমীরবাবু, আমি কেন কিছু মনে করবো বরং আপনি আমাকে শৃঙ্খল মুক্ত করলেন। এবার আমি মনের সুখে ফ্রিল্যান্সিং করবো, ক্রিয়েটিভ ফোটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করবো। আমার যা যা অফিসিয়াল ফর্মালিটিজ আছে সেরে ফেলুন। আগাম আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
– আপনার পেমেন্ট পেপার রেডি হয়ে যাবে। এ মাসের শেষে আপনি রিলিজ অর্ডার পেয়ে যাবেন।
বাড়িতে এসে বলাতে প্রথমে একটু থমথমে পরিবেশ তৈরি হলেও তাঁর স্ত্রী মনোরমা ব্যাপারটা স্পোর্টিঙ্গলি নিলেন। ছেলে এখন হোস্টেলে থাকে। তাকে পরে জানাতে হবে।
ফেয়ারওয়েলের একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান হলো। সব মিলিয়ে বারো জনকে বিদায় সম্বর্ধনা দেয়া হলো। সবাইকে বলার সুযোগ দেয়া হলো। তিনি বললেন,
– এই গোষ্ঠী আমাকে বাঁচতে সাহায্য করেছে। এই গোষ্ঠীর জন্য আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। আবার এই গোষ্ঠীই আমাকে নতুন করে সুযোগ করে দিলো স্বাধীন ভাবে কাজ করার।
বাকি সবাই হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়াতে একটু বিমর্ষই ছিলো। তাদের কাছে এই ছাঁটাইটা একদমই সুখকর হয়নি।। কিন্তু মন্দার বাজারে কতৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায়ন্তর ছিলো না।
প্রাপ্য সবাইকে দেয়া হলো কড়ায় গন্ডায়।
এর পরের অংশটা যদি দ্বিতীয় অধ্যায় হয় জীবনের তবে সেটা কম যুদ্ধের নয়। নিশ্চিত চাকরির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে ফ্রিল্যান্সের হাজার তরুণ, শিক্ষিত এবং সত্যিকারের টেকনিক্যালি দক্ষ প্রতিযোগিদের সাথে মাঠে নামতে হলো। শুধু মাত্র শিল্পের এবং নিজের সুপ্ত ইচ্ছা বহিঃপ্রকাশের জন্য কঠিন প্রতিযোগিতায় নামতে হলো।
অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতায় এক দু’ মাস মসৃণভাবে গেল। ছাপা হলো কয়েকটা ছবি নিজের পুরোনো সংস্থা এবং আরো দু একটা পত্রিকায়। একদিন পত্রিকার অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। একটা ছবি জমা দিয়েছেন। তার খবর জানার জন্য অপেক্ষা করছেন। একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে এসে বসলো পাশে।
– কাকু, আপনি তো সুনন্দর বাবা, না ?
– হ্যাঁ, তুমি?
– আমরা এক ক্লাসে পড়তাম। এখন ছবি তোলার চেষ্টা করি। বাবার একটা স্টুডিও ছিলো। বাবা মারা যাওয়াতে বন্ধ হয়ে গেলো। আমার রেজাল্ট ভালো হয়নি। তাই দোকানটা খুলি। টালাতেই থাকি রেল লাইনের দিকটাতে। মাঝে মাঝে নেচারের ছবি ট্রাই করি।
– এখানে?
– একটা ছবির প্রিন্ট জমা দিয়েছি। ওরা বলেছে অপেক্ষা করতে।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে ভিতর থেকে একটা সুবেশ তরুণী বেরিয়ে এল, – আরে তনুদা আপনি বসে আছেন কেন? আপনার ছবিটাই নেয়া হয়েছে। চা খাবেন ? ওঃ সরি ভাই, তুমি আরো চেষ্টা করো। হোপ ফর দা নেক্স্ট ।
– কাকু কনগ্রাচুলেশনস্। চলি,আবার দেখা হবে। সুনন্দর সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। চলি।
করুণ মুখ করে হতাশ ছেলেটা কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তনু সেন চা পানের কেন উৎসাহ পেলেন না। কোন রকমে ঠান্ডা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বেন্টিংক স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে গেলেন। কাঁধের ব্যাগটা বড্ড বেশি ভারী মনে হচ্ছে। কিছুটা হেঁটে গিয়ে মেট্রো সিনেমার লাগোয়া একটা কফির দোকানে কোণের দিকে একটা টেবিলে চুপ করে বসলেন।
তনু সেনের মনে হলো দুটোই যুদ্ধ। একটা বাঁচার জন্য যুদ্ধ আর একটা শখ মেটানোর যুদ্ধ। দ্বিতীয়টা ছিলো তাঁর তরুণ বয়সে। সেখানে হেরে গেলেও অন্য কোন পেশায় তিনি চলে যেতে পারতেন। এই ছেলেটার তো কোন পথ নেই। বাঁচার লড়াইটাই সামনে পড়ে আছে। কফিতে এক চুমুক দিয়ে সরিয়ে রাখলেন ।
বাইরে পেরিয়ে আরো এক দু’ ঘন্টা লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরলেন কিন্তু কাজে মনঃ সংযোগ করতে পারলেন না।
বাড়িতে এসে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়লেন। মনোরমা জিজ্ঞাসা করাতে বললেন খেয়ে এসেছি।
বিকেলে খালি হাতে আবার বেরোলেন। জনবহুল ধর্মতলা পেরিয়ে এসপ্ল্যানেড ইস্টে। শম্ভুর কাছে চা খেলেন। ব্যস্ততার মধ্যে শম্ভু শুধু একবার বলল, – ব্যাগ কই?
হাঁটতে হাঁটতে রাজভবন, রেড রোড, আকাশবাণী ভবন, ইডেন গার্ডেন্স পেরিয়ে বাবুঘাট। রেল লাইনটা টপকে ওপাশে চলে গেলেন। বটতলার চায়ের দোকান পেরিয়ে রবি-ঠেক। দেখলেন একটা বাচ্ছা ছেলে সুনন্দর বয়েসিই হবে। সূর্যাস্তের ছবি তুলছে। তার কাছাকাছি দাঁড়ালেন। কি নিঁখুত ভঙ্গি, হাতে দামি ক্যামেরা।
এরাই ফোটোগ্রাফির ভবিষ্যৎ। আধুনিক শিক্ষিত ও নিবেদিত প্রাণ। বেশ ভালো লাগলো। আলাপ করতে ইচ্ছে হলো।
– দারুণ হবে ছবিটা। একটু বাঁদিকে ঘোরাও। একটু নীচে নামাও। ব্যাস্ ব্যাস্, কত এক্সপোজার দিয়েছো? শাটার স্পীড, আই এস ও? ও কে ওকে তুমি অটো মোডে দিয়েছো? বেশ বেশ।
ওকে ওর কাজ করতে দিয়ে আরো একটু এগিয়ে গেলেন। দ্বিতীয় হুগলী সেতু গোধূলির লাল রঙের প্রেক্ষাপটে একটা স্যিলুটের মতো তৈরি হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর।
কুড়ি বছর চাকরি হয়েছিলো। অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছেন এই শহরের, রাজ্যের, দেশের এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিকও । এখন তো সরে দাঁড়ানোরই সময়। তবে কেন ইনসিকিউরড বোধ করছেন? এতোদিন যা কিছু রপ্ত করেছেন শিখেছেন সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে বলে? খেলার মাঠে নবীনদের তো জায়গা দিতেই হবে।
এই তো সেদিন টার্মিনেশনের নোটিশ পাওয়ার পর সবাই মিলে ঠিক করা হলো একটা ফোরাম গড়া হবে ছবি-তুলিয়েদের । তিনি হ্যাঁ না কিছু বলেন নি। সেখানে নানা প্রোগ্রাম হবে। ট্রেনিং অর্গানাইজড করা হবে,ওয়ার্কশপ হবে,প্রদর্শনী হবে, ফোটোগ্রাফির বইয়ের প্রকল্প থাকবে।
প্রবীরই এর উদ্যোক্তা। আঁধার নেমে আসছে ডিঙি নৌকাগুলোর মধ্যে টিম টিমে কুপির আলো জ্বলে উঠছে।দূরে হাওড়া ব্রিজের কয়কটা আলো জ্বলে উঠলো। খুদে বোতাম টেপা নোকিয়া ফোনটা পকেট থেকে বার করলেন।
– হ্যালো, প্রবীর তনুদা বলছি।
– আরে তনুদা আপনি? কোথায় শুট করছেন। কিছু ভালো শট হলো আজ।
– তোরা কোথায়?
– আবার কোথায়? শম্ভুর থানে। সবে একটা ফিস ফ্রাই আর চা নিয়ে বসেছি।
– তোরা বোস, কথা আছে আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
ফাঁকা ট্যাক্সি পেয়ে গেলেন একটা। – ডেকার্স লেন।
জ্যাম আছে তবে এইটুকু পথ যেতে সময় লাগবে না। পকেটে লবঙ্গের কৌটো থেকে দুটো নিয়ে মুখে দিলেন। মাথার ভিতরে কয়েকটা শব্দ ঘুর পাক খাচ্ছে, ফোরাম, ফোটোগ্রাফিক ফোরাম, প্রদশর্নী, ওয়ার্কশপ । যেখানে সিনিয়ররা শেখাবেন জুনিয়রদের, নতুনদের। প্রদশর্নের ব্যবস্থা থাকবে। ওয়ার্কশপ হবে।
কাঁধটা খালি খালি লাগছে। রাগ করে ব্যাগটা আনা হয়নি। প্রবীর তার রাইভাল, প্রতিদ্বন্দ্বী তবু এই প্রকল্পটা মন্দ ভাবেনি প্রবীর।
(শেষ)