করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সারাবিশ্বে বিজ্ঞানীরা যে নিদানগুলি দিয়েছেন বারে বারে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া আর অ্যালকোহল আছে এমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাতে লাগানো তার মধ্যে অন্যতম। বড়দের সাথে সাথে ছোটদেরও বাবা-মারা এই অভ্যাস করানোর চেষ্টা করছেন। বড়দের তুলনায় ছোটদের হাতের চামড়া নরম ও সংবেদনশীল হওয়ার কারণে তাদের চামড়ায় বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শুধু তাই না এই লক ডাউনের বাজারে বাড়ির কাজে সাহায্য করার মানুষরা প্রায় কেউই আমাদের বাড়িতে আসতে পারছেন না। কাজেই নিরুপায় হয়েই অনভ্যস্ত হাতে আমাদেরই করতে হচ্ছে বাসন মাজা, কাপড় কাচা বা ঘর মোছার মত সব কাজগুলো। আর প্রত্যেক বারই হাত আসছে সাবানের সংস্পর্শে। আর পাঁচটা দিনের চেয়ে পরিবারে সাবানের ব্যবহার বেড়ে গেছে অনেকগুণ বেশি।
কেন হাত ধোয়ার নিদান?
করোনা ভাইরাসের বাইরের আবরণে দুটি ফ্যাটের আস্তরণ থাকে। সেই আস্তরণগুলির মাধ্যমে এগুলি আমাদের হাতে বা শরীরে চিটে বসে থাকে। সাবান যেমন এই চামড়া আর ভাইরাসের মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি করে শরীর থেকে নির্গত করতে সাহায্য করে, আবার অন্য দিকে ওই ভাইরাসের বাইরে থাকা ফ্যাটের আস্তরণগুলোকে সাবান গলিয়ে দিয়ে ভাইরাসটাকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে। ৬০-৮০ শতাংশ অ্যালকোহলও ভাইরাসের বাইরে থাকা ফ্যা্টের আস্তরণকে দ্রবীভূত করে ভাইরাসকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে। ভাইরাসকে মারার সরাসরি ওষুধ যেহেতু কিছু নেই, তাই এই ভাবে শরীরে প্রবেশে বাধা দেওয়া ছাড়া আমাদের কাছে উপায়ই বা কি আছে?
হাতের চামড়ায় কি কি সমস্যা হতে পারে?
১) ছোটদের হাতের চামড়া এমনিতেই খুব নরম হয়। বারবার ক্ষার জাতীয় পদার্থের সংস্পর্শে হাত এলে, হাতের চামড়া শুকিয়ে যেতে পারে। অত্যধিক শুষ্ক হয়ে যাওয়ার ফলে হাতের চামড়া ফেটে যেতে পারে আর পরবর্তীকালে ওই ফাটলগুলি দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করে ইনফেকশন তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে হাত ফুলে ব্যথা হতে পারে, রস পড়তে পারে।
২) ছোট-বড় সবারই যাদের আগের থেকে হাতের চামড়ার বিভিন্ন সমস্যা ছিল, যেমন কেউ ভুগতেন হাতের চামড়ার শুষ্কতায়, কেউ বা পম্ফলিক্স নামে এক রোগে যাতে কিনা আঙুলের পাশগুলোতে ঘামাচির মত ছোট ছোট দানা বেরোয় আর খুব চুলকোয়, এমন সব রোগ কিন্তু বার বার সাবানের সংস্পর্শে এলে বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
৩) সাবানে থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে রোগটি হয় তাকে ইরিট্যান্ট কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস বলে। এই ইরিট্যান্ট কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসে হাতের চামড়া লাল হয়ে চুলকাতে থাকে, চামড়া উঠে যেতে থাকে, ব্যথা করে, কখনও কখনও ঢুলিও তৈরি হয়ে যায়। অনেক দিন এই সমস্যা চলতে থাকলে হাতের চামড়া মোটা হয়ে যেতে পারে।
৪) বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ফলে হাতের উপরের পাতলা চামড়ার আস্তরণটা যখন উঠে যায় বা হাতের চামড়া ফেটে যায় তখন অ্যালকোহল হাতে নিলে হাত জ্বালা করতে পারে।
৫) কিছু স্বাস্থ্যকর্মী-ডাক্তারদের সাথেসাথেই এখন অন্য অনেক মানুষকেই বাইরে কাজ করার সময় অনেককেই রাবার গ্লাভস পরতে দেখা যাচ্ছে। তাদের হতেও কিন্তু এমন সব লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
অনেকেরই কিন্তু ল্যাটেক্স অ্যালার্জি থাকে। এই গ্লাভস গুলো ল্যাটেক্স দিয়েই তৈরি হয়। অ্যালার্জি থেকে হওয়া এই জাতীয় রোগগুলিকে ‘অ্যালার্জিক কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস’ বলে।সেক্ষেত্রে সাবানের ঘাড়ে সব দোষ না দেওয়াই ভাল।
কেন হয় এই সব সমস্যা?
“হাতের তালুর সব চেয়ে উপরের স্তরটির নাম স্ট্রাটাম কর্নিয়াম। এই মোটা স্তরের মধ্যে কোষগুলি নিজেদের মধ্যে খুব শক্ত ভাবে লেগে থাকে। বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ফলে এই স্তরের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয় আর ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় স্তরটি। তখনই দেখা যায় যত বিপত্তি”–বললেন একটি শিশু হসপিটালের চর্ম বিভাগের প্রধান ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নীলেন্দু শর্মা।
সমাধানের উপায়
করোনা থেকে বাঁচতে হাত তো আমাদের ধুতেই হবে বারে বারে। নাহলে এই করোনা যুদ্ধে আমরা পরাজিত হয়ে যাব। যেটা সাথে করা যায় কাজ কর্ম শেষ হয়ে গেলে হাতগুলোতে ভাল করে লোশন বা ক্রিম মেখে ফেলা যেতে পারে। একবার খাওয়া দাওয়ার পরে দুপুর বেলা আর একবার রাতে শুতে যাবার আগে। ডাক্তার শর্মার মতে ,”শুষ্কতার তীব্রতা অনুযায়ী প্রয়োজনে আরও দু বারের থেকে আরো বেশি বার ময়েশ্চারাইজার লাগানো যেতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে এটাই সবচাইতে বড় দাওয়াই।” খুব কম ক্ষেত্রেই, যেখানে চুলকানি, জ্বালা খুব বেশি থাকে সেখানে ময়েশ্চারাইজারের সাথে সাথে ডাক্তার বাবুদের পরামর্শ অনুযায়ী হয়ত টপিক্যাল কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খুব সংক্ষিপ্ত সমযয়ের জন্য বা অন্য কোন ওষুধের প্রয়োজন পড়তে পারে। আর ল্যাটেক্স অ্যালার্জি থাকলে ওই অ্যালার্জি তৈরিকারী জিনিসটি হাতের সংস্পর্শে আসতে না দেওয়াই ভাল।