কোভিড-১৯, সারাবিশ্বে বর্তমানে সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে এই রোগটি। নভেল করোনা ভাইরাস বা SARS-CoV-2-জনিত এই রোগটি চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে আজ পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে, ইতিমধ্যে কেড়ে নিয়েছে দেড়লক্ষাধিক প্রাণ। বিশ্বের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রকার অপরিশোধিত তেলের দাম পৌঁছে গেছে শূন্যেরও নিচে। সারা পৃথিবী তাকিয়ে আছে কবে এই রোগের প্রতিষেধক আসবে। কিছু রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। কিন্তু কীভাবে তৈরী হবে সেই ভ্যাকসিন আর সেটা পেতে কতদিনই বা অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?
যখনই কোনো জীবাণু- হতে পারে সেটা ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়া- শরীরে প্রথমবারের মতো প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে, দেহের শ্বেতকণিকাগুলো তখনই সজাগ হয়ে উঠে। কিছু শ্বেতকণিকা আক্রান্ত কোষ এবং অনুপ্রবেশকারী জীবাণুগুলো ধ্বংস করে তাদের দেহাংশ চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। এই জীবাণু বা তাদের দেহাংশগুলো শরীরে ‘এন্টিজেন’ হিসেবে কাজ করে। যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই ‘এন্টিজেন’-গুলোর চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতে নতুন ধরণের কিছু ‘অস্ত্র’ তৈরী করে নিয়ে আসে আরেকদল শ্বেতকণিকা। এই নতুন অস্ত্রই হচ্ছে ‘এন্টিবডি’। লড়াই শেষে নির্দিষ্ট ঐ এন্টিজেন যখন শরীর থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তখন কিছু শ্বেতকণিকা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই রণকৌশল মনে রেখে সারা শরীরে পাহারা দিতে থাকে এবং পরবর্তীতে দেহে একই এন্টিজেনের উপস্থিতি টের পেলে সেই রণকৌশল কাজে লাগিয়ে তাদের ঠেকিয়ে দেয়।
গতানুগতিক ভাবে প্রতিষেধক তৈরিতে বহিরাগত জীবাণুর উপস্থিতিতে শরীরের এই প্রতিক্রিয়াকেই কাজে লাগানো হয়। হাম এবং জলবসন্ত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এসব রোগের জন্যে দায়ী ভাইরাসগুলোকেই সক্রিয় অবস্থায় কিন্তু দুর্বল করে সরাসরি শরীরে প্রবেশ করানো হয়। সক্ৰিয় জীবাণু থাকায় এইসব প্রতিষেধক কিছু ক্ষেত্রে উল্টো বিপদ বয়ে নিয়ে আসতে পারে, বিশেষ করে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষের জন্যে। তবে এই প্রক্রিয়ায় প্রতিষেধক তৈরী করে স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের মতো সাংঘাতিক রোগকে আমরা পৃথিবী থেকে চিরতরে নির্মূল করতে পেরেছি। পোলিও রোগের ইঞ্জেক্টেবল যে প্রতিষেধকটি আছে তা আবার নিষ্ক্রিয় বা মৃত পোলিওভাইরাস ব্যবহার করে তৈরী করা হয়। তুলনামূলক নিরাপদ এধরণের প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে সাধারণত কয়েকটি ডোজের প্রয়োজন হয়। কিছু প্রতিষেধক গোটা জীবাণুর পরিবর্তে তার দেহাংশ বা এন্টিজেন ব্যবহার করে তৈরী করা হয়। আমাদের দেশে শিশুদের যে DPT টিকা দেয়া হয়, তার ‘P’ অর্থাৎ Pertussis বা হুপিং কাশি-সংশ্লিষ্ট অংশটি যেমন এভাবেই তৈরী। যেহেতু জীবিত জীবাণুর বদলে শুধুমাত্র তাদের দেহাংশই এধরণের প্রতিষেধক তৈরীতে ব্যবহৃত হয়, তাই এগুলো সাধারণত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া মুক্ত থাকে। কিছু কিছু জীবাণু আবার শরীরে গিয়ে বিষাক্ত পদার্থ তৈরী করে। সেধরণের কিছু জীবাণুর প্রতিষেধক তৈরিতে সে বিষাক্ত পদার্থটিকেই অত্যন্ত স্বল্পমাত্রায় ব্যবহার করা হয়। DPT টিকার ডিপথেরিয়া- এবং টিটেনাস-সংশ্লিষ্ট অংশ দুইটি সেভাবেই তৈরী।
তবে এসব পদ্ধতিতে কোনো রোগের প্রতিষেধক তৈরী করতে সেই রোগের জীবাণু বা তার দেহাংশের প্রয়োজন হয় যা উৎপাদন করা বেশ সময়সাপেক্ষ এবং জটিল একটি প্রক্রিয়া। সাধারণত পরীক্ষাগারে জীবিত কোষ-কলার মাঝে বা নিষিক্ত মুরগির ডিমে জীবাণুগুলো উৎপাদন করা হয়। কিছু জীবাণুর ক্ষেত্রে এভাবে প্রতিষেধক তৈরী করা বেশ দুঃসাধ্যও বটে। তাছাড়া নতুন কোনো রোগের জন্যে এ প্রক্রিয়ায় প্রতিষেধক তৈরী করার পর সেটার কার্যক্ষমতা এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যাচাই করে, চুড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে সর্বসাধারণের জন্য বাজারে নিয়ে আসতে ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন চীনের Sinovac, এবং যুক্তরাষ্ট্রের Codagenix এই প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করে কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু চলমান এই মহামারীকে অতিদ্রুত ঠেকাতে সময়সাপেক্ষ এই পদ্ধতিগুলো কতটুকু কার্যকর হবে তা বলা মুশকিল।
প্রথাগত এসব পদ্ধতির বিকল্প হচ্ছে DNA- বা RNA-ভিত্তিক প্রতিষেধক। জীবদেহের প্রতিটি কোষ কিভাবে কাজ করবে তার যাবতীয় তথ্য ধারণ করে তার DNA। কোষের যখন কোনো নির্দিষ্ট প্রোটিনের প্রয়োজন হয় তখন RNA সেই প্রোটিন তৈরির ‘রেসিপি’টি DNA-র তথ্যভান্ডার থেকে ‘কপি’ করে এনে কোষকে সরবরাহ করে। কোষের রাইবোসোম নামের অংশটি তখন সেই রেসিপি কাজে লাগিয়ে প্রোটিনটি তৈরী করে। DNA- বা RNA-ভিত্তিক প্রতিষেধক তৈরিতে কোষের এই স্বাভাবিক কৌশলকেই কাজে লাগানো হয়। জীবাণুর কোনো নির্দিষ্ট দেহাংশ বা এন্টিজেন তৈরির ফর্মূলা যেখানে রয়েছে, DNA বা RNA গঠনের সে অংশটি ‘কেটে’ প্রথমে আলাদা করা হয়। এরপর কোনো বাহকের মাধ্যমে সে অংশটিকে জীবিত কোষে পাঠিয়ে দিলে কোষের রাইবোসোম তখন এই তথ্য ব্যবহার করে নিজেই এন্টিজেনগুলো তৈরী করতে পারে। অর্থাৎ আগে যেখানে এন্টিজেনগুলো পরীক্ষাগারে তৈরী করে এরপর শরীরে পাঠানো হতো, সেখানে এখন মানবশরীর নিজেই সেই এন্টিজেনগুলো তৈরী করবে।
প্রযুক্তির কল্যাণে যেকোনো জীবাণুর জয়ীনগত বিন্যাস এখন জানা যাচ্ছে খুব সহজেই। চীনের বিজ্ঞানীরা যেমন জানুয়ারির ১০ তারিখেই নভেল করোনা ভাইরাসের প্রায় ৩০ হাজার বেস দীর্ঘ RNA-র গঠন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। জিনগত গঠন জানার সুফল হচ্ছে যে এই বিন্যাসের যেকোনো অংশ কৃত্ৰিম উপায়েই তৈরী করা যায়। অর্থাৎ নভেল করোনা ভাইরাসের RNA-র যে অংশে তার S-প্রোটিন (ভাইরাসের গায়ে কাঁটার মতো দেখতে স্পাইক প্রোটিন) তৈরির ফর্মূলা রয়েছে, সেই অংশটি পরীক্ষাগারে কৃত্রিম উপায়ে সংশ্লেষ করা সম্ভব।
মূলতঃ করোনা ভাইরাসের S-প্রোটিন তৈরির ফর্মূলাটি মানবকোষে কীভাবে পৌঁছে দেয়া হবে তা নিয়েই কাজ করছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের Moderna নামে একটি প্রতিষ্ঠান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ S-প্রোটিন তৈরির ফর্মুলা সম্বলিত RNA-র অংশটি Chimpanzee adenovirus oxford (ChAdOx1) নামে দ্বিতীয় একটি বাহক ভাইরাসের DNA-তে প্রথমে প্রতিস্থাপন করেন। Chimpanzee adenovirus এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি মানবদেহে বংশবৃদ্ধি করতে পারে না, ফলে শরীরে সংক্রমণের আশংকাও থাকেনা। কিন্তু মানবদেহের বাইরে কিছু নির্দিষ্ট ধরণের কোষে (HEK293) এই ভাইরাস অত্যন্ত কার্যকরভাবে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। পরিবর্তিত এই ChAdOx1 মানবদেহে প্রবেশ করালে সেটি S-প্রোটিন তৈরির তথ্য মানবকোষে বয়ে নিয়ে যায়। ChAdOx1 নিজে সেখানে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে না পারলেও, তার বয়ে নিয়ে যাওয়া তথ্য ব্যবহার করে কোষের রাইবোসোম তখন S-প্রোটিন এন্টিজেনটি মানবশরীরে তৈরি করতে শুরু করে।
অন্যদিকে S-প্রোটিন তৈরির সেই একই তথ্য কোষে বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের Moderna ব্যবহার করছে mRNA -1273 নামে একটি বাহক বা messenger RNA। এই mRNA যাতে কোষে পৌঁছার আগেই ধ্বংস হয়ে না যায় সেজন্যে চর্বির একটি সুক্ষ স্তর দিয়ে একে মুড়ে দেয়া হয়। এরপর mRNAটি কোষে পৌঁছে গেলে, কোষ তখন সেই তথ্য ব্যবহার করে S-প্রোটিন তৈরী করতে থাকে। যেহেতু এই পদ্ধতিতে দেহের বাইরে কোনো জীবিত কোষে গোটা ভাইরাস বা তার দেহাংশ উৎপাদন করার প্রয়োজন পড়ে না, এতে করে প্রচুর সময় সাশ্রয় হয়। যেমন mRNA-1273 প্রতিষেধকটি প্রাথমিক ডিজাইন পর্যায় থেকে শুরু করে মানবদেহে পরীক্ষা বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত করতে সময় লেগেছে মাত্র ৪২ দিন।
তবে এই দুই পদ্ধতির সবচাইতে বড়ো সুবিধা হচ্ছে এই যে মানবকোষে এন্টিজেন-সংশ্লিষ্ট তথ্য বয়ে নিয়ে যাবার প্রক্রিয়াটি দুই ক্ষেত্রেই খুবই সুনির্দিষ্ট এবং সুগঠিত। ফলে শুধু নভেল করোনা ভাইরাসই নয়, অন্য যেকোনো জীবাণুর প্রতিষেধক তৈরীতে এই পদ্ধতিগুলো মোটামুটি একইরকম থাকবে। আর যেহেতু জিন-বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে এই প্রতিষেধক তৈরী করা হয়, মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন হলেও সে অনুসারে প্রতিষেধকটিকেও খুব দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। গত ২৩ এপ্রিল থেকে ChAdOx1 ব্যবহার করে তৈরী কোভিড-১৯ রোগের প্রতিষেধকটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাজ্য। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের Moderna মার্চের ১৬ তারিখেই তাদের mRNA-1273 নামে প্রতিষেধকটি প্রথম মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে। ChAdOx1 ব্যবহার করে ইতিমধ্যে কিছু রোগ যেমন MERS, টিবি এবং চিকুনগুনিয়ার প্রতিষেধক তৈরী করা হয়েছে, যার কিছু বেশ ভালো ফলও দিয়েছে। কিন্তু Moderna যে ধরণের প্রতিষেধক তৈরী করেছে, সে ধরণের কোনো কিছুই এর আগে মানবদেহে পরীক্ষা করা হয়নি।
দুই দলই যদিও আশা করছে যে খুব শীঘ্রই তারা কোভিড-১৯ রোগের প্রতিষেধক নিয়ে আসতে পারবে, কিন্তু আমাদের রোগ-প্রতিরোধ যন্ত্র এসব প্রতিষেধকে কতটুক সাড়া দেবে, বা সাড়া দিলেও তা কি করোনা ভাইরাসকে দেহ থেকে নির্মূল করতে যথেষ্ট কিনা, কতদিন পর্যন্তইবা প্রতিষেধকের প্রভাব শরীরে কার্যকর থাকবে- এসব প্রশ্ন থেকেই যায়। তাছাড়া কয়েকধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ছাড় পেতে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় একেবারে কম করে হলেও ছয় মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে কোভিড-১৯ রোগের প্রতিষেধক তৈরির জন্যে বিশ্বের প্রায় চল্লিশটি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে আলাদাভাবে কাজ করছে। এর মাঝে কেউ যদি কার্যকর প্রতিষেধক তৈরী করেই ফেলে, তা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনকভাবে উপায়ে উৎপাদন করা যাবে কিনা সেটাও ওষুধশিল্পের জন্য একটা বড়ো মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, এই প্রতিষেধক তৈরির গবেষণার পিছনে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে শুধুমাত্র এই আশায় যে কাংখিত প্রতিষেধকটি তৈরী করতে পারলে তা থেকে তারা হাজার কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারবে। কম খরচে এই প্রতিষেধক যদি উৎপাদন করা না যায়, তাহলে তার দাম সর্বসাধারণের, বিশেষ করে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে। আর সবার জন্য প্রতিষেধক যদি আমরা নিশ্চিত নাই করতে পারি তাহলে ধরে নিতে হবে আমাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ।
তবে ভালো কিছু আশা করতে দোষ নেই। তাই আশা করে আছি অচিরেই কোভিড-১৯ রোগের প্রতিষেধক তৈরী হয়ে পৌঁছে যাবে জনে-জনে – পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে কোভিড-১৯।
সুমিত মজুমদার, পিএইচডি গবেষক, এবং ড: তাপস মন্ডল, সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ পেডিয়াট্রিক্স। দুজনেই বর্তমানে কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত।
www.bdnews24.com- এ প্রথম প্রকাশিত।
Very lucid presentation. But please provide with english version also, if possible.
Thanks& regards.