এই মুহূর্তে মানব সভ্যতার অগ্রগতির পথে অন্যতম অন্তরায় হল নভেল করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস যে শুধু শারীরিক সমস্যা তৈরি করে তা তো নয়, তার সাথে সাথে এ মহামারী আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভাইরাসের আতঙ্ক, কোয়ারান্টিন ও আইসোলেশন ভীতি, লক ডাউনের জন্য বাড়ির বাইরে বের হতে না পারা, রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়া, কাজ হারানোর আশঙ্কা, বাড়ির সদস্যদের খাবার ও অন্যান্য চাহিদা পূরণের সাংসারিক চাপ, বাজারে জিনিসপত্রের সাময়িক অভাব ও অনেক ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি, ইত্যাদি বিষয়গুলি ব্যক্তি, পরিবার, রাজ্য, দেশ নির্বিশেষে আমাদের মনোজগতে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে সবসময় সুসম্পর্ক থাকে না। কিন্তু লক- ডাউনের জন্য সবাই একসাথে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বাড়ির মহিলাদের ওপর সংসার সামলানোর চাপ যেমন বাড়ছে, তেমনি আবার বাড়ির উপার্জনকারীদের ওপর রোজগার এবং রসদ জোগানোর চাপও বাড়ছে। অন্য সময়ে পারিবারিক নানান অপ্রীতিকর পরিস্থিতি কাটানোর সহজ উপায় ছিল বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দেওয়া, বেড়িয়ে আসা, খেলাধুলা করা, সিনেমা-নাটক দেখা ইত্যাদি। কিন্তু এই মুহূর্তে সেসব ভুলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে এবং ক্রমশ বোধগম্য হচ্ছে যে ছুটি কাটানো আর লক -ডাউন এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।
তাই এই পরিস্থিতিতে সকলেরই মন -মেজাজ খারাপ থাকার জন্য নিতান্ত তুচ্ছ কারণেও পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। যুক্তির বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে আদিম প্রবৃত্তিগুলো আর সাথে সাথে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনাও। তাই অনেকক্ষেত্রেই বাড়ির মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুরাও নানান শারীরিক, মানসিক ও যৌন উৎপীড়নের মুখোমুখি হতে পারেন।
এই পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বারবার নিয়ম মেনে হাত ধোয়া, মাস্কের উপযুক্ত ব্যবহারের যেমন প্রয়োজন, তেমনি সাথে সাথে সারাদিন ধরে করোনা ভাইরাসের খবর না দেখাই ভাল। সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া গুজব,অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাপদ্ধতি, ইত্যাদি থেকেও দূরে থাকতে হবে।
সারাদিনে কিছুক্ষণ যেমন সবাই একসাথে থাকা দরকার, তেমনি কিছুক্ষণ নিজের মত করে সময় কাটানোরও প্রয়োজন আছে। মনে রাখুন প্রত্যেকের নিজের নিজের ভাল লাগা-মন্দ লাগা আছে। তাই কোনকিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। সাধারণ পরিস্থিতিতে পরিবারের লোকজন যেমন আচরণ করেন এই আতঙ্কের পরিস্থিতিতে সেই রকমের আচরণ প্রত্যাশা না করাই ভাল। নানান ধরনের অসুবিধা সকলেরই হচ্ছে।মনে রাখুন এই মুহূর্তে ছো্টো-খাটো বিষয়ে অহেতুক রাগ দেখানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
এতদিন অনেকেই তো বিভিন্ন কারণে বা কাজের তাগিদে বাড়িতে সময় দিতে পারতেন না। গৃহবন্দি অবস্থায় হাতে তো অনেক সময়। তাই এই সময় গৃহবন্দি অবস্থাটাকে শাস্তি হিসেবে না দেখে বরং নিজের ও পরিবারের যত্ন নিন। যে সমস্ত আত্মীয়- স্বজন দূরে থাকেন তাঁদের সাথে ,বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে টেলিফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখুন।
অনেকের কাছেই সারাদিন ঘরে বসে সময় কাটানো একটা সমস্যা। প্রয়োজনে নিজের মত করে সারাদিনের একটা রুটিন বানিয়ে ফেলুন। তাই আপনার পুরানো অভ্যাসগুলোকে ফিরিয়ে আনুন। গল্পের বই পড়া, গান শোনা বা করা, রান্না করা, লেখা-লেখি, ছবি আঁকার মাধ্যমে অনেকটা সময় কাটানো যেতে পারে। এছাড়া এখন সহজেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানান সিনেমা, সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ, ইত্যাদি দেখে সহজেই সময় কাটানো সম্ভব। তবে অবশ্যই মাথায় রাখুন যাতে মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার যেন নেশার পর্যায়ে চলে না যায়।
প্রত্যেকদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যাওয়া ও একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করা, ঘুমের জন্য আলো ও শব্দ মুক্ত আরামদায়ক বিছানা, ঘুমোতে যাবার চার থেকে ছয় ঘন্টা আগের সময়ে চা, কফি, কোল্ড ড্রিংকস, চকোলেট, সিগারেট, মদ না খাওয়া, বিছানা শুধুমাত্র ঘুমোনোর জন্যই ব্যবহার করা, দিনের বেলা না ঘুমোনো বা এক ঘন্টার কম সময়ের জন্য ঘুমোনো, ঘুম না এলেও ঘড়িতে সময় না দেখা, ঘুমোনোর আগে গান শোনা, ইত্যাদি ভাল ঘুম হবার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এগুলি মেনে চললে ঘুমের সমস্যা সহজেই এড়ানো যেতে পারে।
এই সময় জিমে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বিভিন্ন ফিসিক্যাল এক্সারসাইজ, রিলাক্সেশান টেকনিক, ডিপ ব্রিথিং, প্রাণায়াম, ইত্যাদি আপনি ঘরে বসেই করতে পারেন। এতে সময় যেমন কাটবে, তেমনি শরীর ও মন ভাল থাকবে।
অবশ্যই মাথায় রাখুন লক ডাউন বিষয়টি তো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয়, এটা করা হয়েছে আপনার-আমার সবার ভালোর জন্য। তাই এই ব্যাপারে আমাদের সকলকেই সহযোগিতা করতে হবে।বিশ্বাস রাখুন খুব তাড়াতাড়ি এই দুঃসময় আমরা কাটিয়ে উঠব।