মেডিক্যাল কলেজে তাদের “বেচু” বলা হত। পরে জেনেছি সব কলেজেই ডাক্তাররা, বিশেষত সদ্য পাশ করা ডাক্তাররা তাদের বেচু-ই বলতেন। এখনও বোধহয় বলেন। আমার কথাটা ভালো লাগত না। মনে হত এমনও তো হতে পারত মেডিক্যাল এনট্রান্স পরীক্ষায় আমি চান্স পাইনি? তাহলে তো আমি ডাক্তার হতাম না। হয়ত এমনই ব্যাগ বয়ে বয়ে দুপুর রোদে “আমার ওষুধটা লিখে দিন স্যার”, বলে ঘুরে বেড়াতাম। অবাক হয়ে ভাবতাম শু-দার নিজের ভাই মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। অন্যদের কী অবলীলাক্রমে তিনি বেচু বলে নিজের ভাইয়ের সম্বন্ধে বলার সময়ে নাম ধরে বলেন।
পরে যখন স্পেশালিস্ট হয়ে কনসালট্যান্ট হয়েছি, তখন আর একটু অসুবিধা হয়েছে। আমরা যখন ডাক্তারি পাশ করেছি, তখন ওষুধ কোম্পানির তরফ থেকে শুধুই একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ আসতেন, ওষুধ সম্বন্ধে বলতে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন অজস্র কোম্পানি, তাদের মধ্যে গলাকাটা কম্পিটিশন, সুতরাং এখন রিপ্রেজেন্টেটিভের ওপর এরিয়া ম্যানেজার, তার ওপরে জোন্যাল ম্যানেজার, ভাইস প্রেসিডেন্ট, জি. এম. মায় মালিক পর্যন্ত ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করে নিজের কোম্পানির ওষুধের জন্য অনুরোধ উপরোধ এমনকি নানারকম লোভ দেখিয়ে যান।
মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা ওষুধ সম্বন্ধে বলে চলে যায়, আর মাঝে মাঝে বাণী দিতে আসেন বড়ো সাহেবরা। যত বড়ো কোম্পানি, তত সাহেবদের সংখ্যা বেশি। কেউ কেউ সাইকিয়াট্রিস্ট পোষে। কেউ কেউ সায়েন্টিস্ট পাঠায়। কিন্তু উদ্দেশ্য সবার ওই একই – অন্য কোম্পানির চেয়ে আমার কোম্পানির ওষুধ বেশি লেখা হোক।
সেই উদ্দেশ্যে অনেক সময়ে নিজেরটাকে উত্তম প্রতিপন্ন করতে নানা কাহিনি সৃষ্টি করতে হয়। সেই কাহিনি এমনই মোড়কে মুড়ে দেওয়া হয় যে ডাক্তারের পক্ষে তার অসত্য উদ্ঘাটন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার কপাল ভালো যে আমি ডাক্তারি জীবনের শুরুতেই এরকম ধাক্কা খেয়ে ঠেকে শিখেছিলাম।
রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ডাক্তারিতে প্রধান অস্ত্র অ্যান্টিবায়োটিক নামের ওষুধ। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগের যুগে কিছুদিন কেমোথেরাপিউটিক জাতীয় ওষুধ ব্যবহার হত। কোট্রাইমোক্সাজোল ছিল এরকম ওষুধ (যা সেপট্রান বা ব্যাকট্রিম নামে তখন বাজারে চলত), আজ আর পাওয়া যায় কি না জানি না।
কোট্রাইমোক্সাজোল-এর ডোজ ছিল সকালে দুটো মোটা মোটা ট্যাবলেট আর রাত্রে আবার ওই দুটো মোটা মোটা ট্যাবলেট। অনেকেই খেতে পছন্দ করতেন না। তাই অনেক কোম্পানি ডবল স্ট্রেংথ বা ডি. এস. ট্যাবলেট তৈরি করেছিল, যাতে একটা করে সকালে রাতে খেলেই চলত।
একদিন, মেডিক্যাল কলেজের প্রাঙ্গণে দেখা হল এমন এক কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে যাদের ডি. এস. ট্যাবলেট নেই। তিনি একথা সেকথায় আমাকে খুব সরল মুখে বললেন, আজকাল অনেকেই ডি. এস. ট্যাবলেট লিখছেন, কিন্তু মুশকিল হল এই যে ডি. এস. ট্যাবলেট তৈরিই করা যায় না। আমরা কোট্রাইমোক্সাজোল-এর আবিষ্কারকর্তা। আমাদের ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে দেখা গেছে যে দুটো ট্যাবলেট-এর মূল ওষুধ এক করলে ওই সাইজ হয় না। অ্যা-অ্যা-অ্যাত্তবড়ো, ডিউস বলের সাইজ হয়ে যায়। সুতরাং যে সব রোগিরা ওই সব কোম্পানির ডি. এস. ট্যাবলেট খাচ্ছেন, তাদের যে কী হচ্ছে কে জানে।
আমি তখন সদ্য ডাক্তার। ডিউস বল সাইজের সম্পূর্ণ গুলটাই গিলে ফেলেছিলাম। মনে ভেবেছিলাম, বাবাগো, এই হল রিসার্চ। এই হল মালটিন্যাশনাল কোম্পানি। এবং তারপরে ওদের ছাড়া অন্য কোনও কোম্পানির কোট্রাইমোক্সাজোল লিখিনি – ভুল ভাঙা অবধি। আমার কপাল ভালো, এই কথা শোনার ২-৩ মাসের মধ্যে সেই কোম্পানিই কোট্রাইমোক্সাজোলের ডি. এস. ট্যাবলেট বিক্রি শুরু করেছিল। এবং তার সাইজ ক্রিকেট বল দূরে থাক, পিং পং বলের আকারও ধারণ করেনি। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম সেই রিপ্রেজেন্টেটিভকে জিজ্ঞেস করব, কী মন্ত্রবলে সেই জাদু সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু আমার কপাল খারাপ – তারপর আমি যখনই তাকে দেখেছি, সে তখন অনেক দূরে, এবং হনহন করে আরও দূরে চলে যাচ্ছে। ডাকলেও শুনতে পায়নি বেচারা।
অবশ্য এই ধরণের দাবি যদি কখনও কোনও রিপ্রেজেন্টেটিভ করে থাকে তবে সাধারণত তারা সেটা কোম্পানির শিক্ষাতেই করে। মেডিক্যাল কলেজে থাকাকালীন আমি কিছুদিন নিউরোলজিতে কাজ করেছিলাম। সেখানে রোগিদের নানারকম ভিটামিন খেতে দেওয়াটা দস্তুর ছিল। এমন একদিন, ওই রকম এক বিশাল বিদেশি কোম্পানির তখনকার রিপ্রেজেন্টেটিভ, বেশ বয়স্ক এক ভদ্রলোক এসে ক্যান্টিনে আমার অনুমতি নিয়ে আমার সামনে বসলেন। চা খেতে খেতে গল্প বললেন, কোম্পানি তাদের সকলকে নিয়ে গিয়েছিল ট্রেনিং-এর জন্য বোম্বাই। তিনদিনের ট্রেনিং হয়েছিল। সেখানে প্রথম দিন তাঁদের সবাইকে নিজের কোম্পানির ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স খেতে হয়। যাঁরা কখনও বি-কমপ্লেক্স খেয়েছেন, তাঁরা সকলেই জানেন, যে ওষুধ খাবার খানিক পরেই প্রস্রাব হলুদ হয়ে যায়। প্রথমদিন তাঁদের ঘড়ি ধরে বলা হয়, কতক্ষণে হলুদ হল তা দেখতে। পরবর্তী দুদিন, বিভিন্ন লোককে অন্যান্য বড়ো কোম্পানির বি-কমপ্লেক্স খাওয়ানো হয়, বলা হয় আবার, কতক্ষণে হলুদ হয় দেখুন।
“ডাঃ দেব”, ক্যান্টিনের বেঞ্চে বসে ঘটনাটা বলতে বলতে ভদ্রলোকের রোমাঞ্চ হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। “ভাবতে পারেন, আমাদের বি-কমপ্লেক্স অন্য যে কোনও বি-কমপ্লেক্সের অন্তত ৪৫ মিনিট আগে ইউরিন হলুদ করে দিল। এখন আমার নিজের মনে আর কোনও সন্দেহ নেই, আমাদের বি-কমপ্লেক্স বাজারের সেরা।”
আমি আবার গিললাম গল্পটা, এবার বাঁচালেন নিউরোলজির মেডিক্যাল অফিসার, সু-দা। সু-দা যেমন সাংঘাতিক ভালো ডাক্তার, ততই ভালো অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। কয়েক সপ্তাহ পরে ডাক পড়ল ওনার ঘরে।
“অনিরুদ্ধ, ওই ভিটামিন কোম্পানিটা কি তোকে টাকা দিয়েছে?”
আমি অবাক। কেন?
“তাহলে অন্য সব কোম্পানি ছেড়ে কেন শুধু ওদেরই ভিটামিন লিখছিস?”
আমি খুব উৎসাহের সঙ্গে সু-দাকে সবটা বললাম, শুনে সু-দা বললেন, “যা দেখ তো, লোকটা বোধহয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ডেকে আন।”
ভদ্রলোক এলেন, সু-দা খুব তাচ্ছিল্যের গলায় বললেন, “তোদের বি-কমপ্লেক্স-এ নাকি চোখের পাতা পড়তে না পড়তে হিসি হলদে যাচ্ছে?”
ভদ্রলোক শ্লেষটা বুঝতে না পেরে আনন্দের সঙ্গে সু-দাকে পুরো ঘটনাটা বললেন। সু-দা ঢুলুঢুলু চোখে সবটা শুনে বলল, “বাঃ বাঃ, চমৎকার। তা সঙ্গে বি-কমপ্লেক্সের স্যাম্পেল আছে নাকি? দে তো একটা।”
ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে এক পাতা বি-কমপ্লেক্স বের করে দিলেন। সু-দা ফয়েল থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে সেটাকে সামনের খাবার জলের গ্লাসে ডুবিয়ে ঘষে ঘষে হলুদ রঙটা তুলে সাদা হয়ে যাওয়া ট্যাবলেটটা আবার ওঁর হাতে দিয়ে বললেন, “নে, খা। খা, খা”, বলে প্রায় জোর করেই ট্যাবলেটটা গেলালেন। তারপর বললেন, “ঘড়িটা দেখ। এবার লক্ষ কর কতক্ষণে হিসি হলদে হয়। কাল বলে যাস।”
ভদ্রলোক পালিয়ে বাঁচলেন। সু-দা আমার দিকে ফিরে বললেন, “তোর মতো বুদ্ধিমান একটা ছেলে এইরকম বোকা বনবে আমি ভাবিনি। তুই একবারও ভাবলি না যে ওদের ট্যাবলেটটাই হলদে রঙের?”
বুদ্ধিমান কতটা জানিনা। কিন্তু সেদিন থেকে ঠিক করেছিলাম, যে কোনও ওষুধ কোম্পানির কোনও দাবি খতিয়ে না দেখে বিশ্বাস করব না। সেই জন্যই ওষুধ কোম্পানির লোকেদের মধ্যে আমার “পড়ুয়া” বলে নামডাক।
আমি তারপরে মেডিক্যাল কলেজে ছিলাম বহু মাস। কিন্তু ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তারপর আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাই, ছ’বছর পর ফিরে এসে একদিন হঠাৎ উল্টোডাঙার মোড়ে মুখোমুখি। দুজনেই পরস্পরকে চিনেছি। উনি ততদিনে রিটায়ার করেছেন। উল্টোডাঙার কাছে থাকেন। খানিক কুশল বিনিময়ের পরে চলে গেলাম। সাত-আট বছর আগে হিসি হলদে হতে কত সময় নিয়েছিল আর জানা হয়নি।