১
ক্যাসাব্লাঙ্কা ছুটছে — মুখে ফেনা তুলে ছুটছে। ঠিক চার কদম পিছনে, ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে মুনলাইট। আর কয়েক পা পিছিয়ে আছে অন্যরা — গোল্ড কুইন, রকস্টার, স্যান্ড ডিউন-রা — জানে ক্যাসাব্লাঙ্কা। একটু ঢিলে দিলেই এগিয়ে যাবে ওরা। ছাড়িয়ে যাবে তাকে।
পিঠের উপর জনি আরো খানিকটা ঝুঁকে বসে আরো টান করে ধরেছে লাগাম — চোখ ঠেলে আসছে ক্যাসাব্লাঙ্কার।
ও-ই যে দেখা যাচ্ছে ফিনিশিং পোস্ট। আর একটু — আর একটু জোরে —
না না, একটুও জমি ছাড়া যাবে না, ক্লান্তিতে দুমড়োনো যাবে না পা-দুটো। আর তো একটুখানি মোটে —
ছুটছে, ছুটছে, ছুটে চলেছে ক্যাসাব্লাঙ্কা!
২
ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে বুম্বার। দেওয়াল ঘড়ি বলছে রাত আড়াইটে। পড়ার টেবিলে স্তূপীকৃত বইখাতা।
জানলার পর্দাটা উড়ছে হাল্কা হাওয়ায়। নিভাঁজ বিছানাটা ডাকছে –”আয়, ঘুমোবি আয়। আয় না রে!”
ভীষণ লোভ হচ্ছে বুম্বার। ভীষণ।
চেয়ার সরিয়ে উঠতে যাবে, দরজার পর্দাটা নড়ে উঠল। মা। হাতে একটা কাপ। ধোঁয়া উঠছে।
”এ মা, তুমি কি ব্যাড বয় নাকি? পুরো রিভিশন না করে কেউ ঘুমোতে যায়, সোনা? তাহলে আবার সোহম ফার্স্ট হয়ে যাবে যে! এই তো, কালকের এক্সামটা হয়ে গেলেই তো শেষ—-”,
বুম্বা চুলের মধ্যে একটা কঙ্কালের হাড়সর্বস্ব হাতের বিলি কাটা টের পায়। একটু শিউরে ওঠে সে।
হরলিক্সের কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে ভাবতে থাকে — এই তো, আজ রাত্তিরটা! আর একটুখানি পড়া তো মোটে বাকি! তার পরেই তো কাল আসবে। কাল! তার পর? তারপরেই ছুটি —-
৩
দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা গিলে নেবার চেষ্টা করছিল সুমিতা। শিরদাঁড়ায় ইনজেকশন দিলে এত লাগে? এর আগে কতবার তো এই ধাতব টেবিলটায় শুয়েছে সে। তার নারীত্বের গভীর গোপন গুহা থেকে নৈর্ব্যক্তিক নির্লিপ্ত যন্ত্রেরা টেনে টেনে বের করেছে অজাত প্রাণ — মাংসের টুকরো বৈ তো নয়! তখন কোনো অবশ করার ওষুধ দেয়নি তো কেউ। মেয়ে ভ্রূণ আবার মানুষ?
এবার বড় যত্ন হয়েছে তার। শ্বশুরঘরে। জিওল মাছের মতো জিইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। পেটে যে তার সোনার ডিম।
অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে, স্বামী নামিয়ে এনেছিল মুখটা, তার মুখের কাছে। গলায় সোনার মাদুলি, হাতে তিনটে আংটি — পোখরাজ, মুক্তো আর চুনী।
ফিসফিসিয়ে বলেছিল–”অনেক কষ্ট করেছ তুমি, অনেক! আর একটু সহ্য করো — এই তো, আর একটু পরেই ডাক্তার ওটিতে নিয়ে যেতে বলবে, তারপরেই আমাদের ছেলেটা আসবে ঘর আলো করে! আর একটু ধৈর্য ধরো সুমিতা, আর একটু — প্লিইইজ—–”
৪
গতবারেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল প্রশান্ত, আর নয় — এভাবে আর নয়। খেলাটা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সরকারি অফিস। সরকারি কনটিনজেন্সির টাকা নিজের বেনামা অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতে গিয়ে আর কত ভুয়ো কোম্পানি খুলবে সে? ভুয়ো লেনদেন, ভুয়ো কাগজপত্রের হিসেব রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে। তাছাড়া ভাগীদারও বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে– হাওড়া কোঅপারেটিভের রজত, আন্দুলের ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার তিওয়ারি, ডিসবার্সমেন্ট সেকশনের অশোকবাবু — এত পার্টনারে কি আর মন্ত্রগুপ্তি থাকে?
গতকাল বাড়ি ফিরে রুমির থমথমে মুখটা চোখে পড়েছিল ওর।
অনেক সাধ্যসাধনার পর রাত্রে বিছানায় অন্তরঙ্গ হয়েছিল সুন্দরী বউ। তারপরেই ঘোষণা করেছিল –”দিদি জামাইবাবু এবার পুজোয় মরিশাস যাচ্ছে! জামাইবাবু গত বছর হোন্ডা সিটি কেনার পরে, তুমি যখন অলটো কিনে জাঁক দেখাচ্ছিলে দিদির বাড়ি গিয়ে, লজ্জায় যেন আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল! মুরোদ কত! আমি কিছু জানি না, দিদিরা মরিশাস যাচ্ছে, আমিও এবার পুজোয় সিঙ্গাপুর যাব, যাব, যাবই!”
ফলস ভাউচারগুলো তৈরি করতে করতে প্রশান্ত-র মনে হচ্ছিল, সে যেন একটা জালের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে — তার নিজের তৈরি করা জাল! দম নিতে যেন একটু একটু কষ্ট হচ্ছিল তার। রিমোট টিপে এসির টেম্পারেচার আরো খানিকটা কমাতে কমাতে সে ভাবতে থাকে — শেষবার, এটাই শেষবার।
আর নয়। আর কক্ষণো নয়। এই তো, এবারেরটা হয়ে গেলেই ——
৫
শীতের মাঝামাঝি। উত্তর অতলান্তিকের শান্ত সমুদ্র। তবু ঠিক শান্ত নয়। জলের নীচে ঝাঁক বেঁধে পুবমুখো যাত্রা করেছে কয়েকটি প্রাণী। অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছিল পথ চলা। কিন্তু তীরে না পৌঁছনো পর্যন্ত ক্লান্ত হওয়া যাবে না তো।
মাথার উপর সূর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে জীবনের তাপ। সামুদ্রিক হাওয়ায় কেমন মনকেমনের গন্ধ। তবু তারা ছুটে চলেছে সাগরতটে। বেলাভূমিতে।
নীল আকাশে সঞ্চরমান সি-গালদের সাক্ষী রেখে নীল তিমিরা ছুটে চলেছে তীরের দিকে। ওখানে জীবন নেই। আছে মৃত্যুর হাতছানি। তারা জানে। তবু —
ওই তো সোনালি বালির বেলা দেখা যায়! আরো একটু তাড়াতাড়ি চলো সবাই, আর তো একটুখানি পথ! তার পর, তারপর —
তার আর সত্যিই কোনো পর নেই।