বিশু চলে গেল আজ। ডাক্তার বিশ্বজিত বন্দোপাধ্যায়, আমার মেডিক্যাল কলেজের ব্যাচমেট। একই ক্লাসে পাঁচ বছরের পড়াশুনো এবং তার পরবর্তীতে ইন্টার্ন এবং হাউসস্টাফশিপ। তারপর আমাদের সবার ছড়িয়ে পড়া নিজেদের পছন্দের বিবিধ রকম ডাক্তারি ট্রেনিং এবং প্র্যাকটিসে।
এরপর যা হয়। পেশাগত জীবনের দৈনন্দিন চাপের ফলে দেখা হয়না এক সময়কার বন্ধুবান্ধবদের সাথে। পাশাপাশি এক বেঞ্চিতে বসা প্রাণপ্রিয় সখার সাথে কথা হয় না অন্যের। দূর থেকে শুনেছিলাম, সে ততদিনে কলকাতা শহরের একজন নামি ইন্টার-ভেনশনাল পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট। কিন্তু দেখা হয়নি কখনো ওর সাথে আমার। কাজের প্রয়োজনেও নয়। তারপর কখন যেন ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে যায়, খেয়াল থাকে না কারো। ধীরে ধীরে বয়স বেড়ে যায় সকলের। সাফল্যের সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক কারো জীবনে মেলে,কারো মেলেনা।সময়ের কাঁটা ছেঁড়ায় ক্ষতবিক্ষত হয় জীবন। বয়সের ছাপ পড়ে শরীরের সঙ্গে মনের উপর।
বিগত দু তিন বছরে উৎসাহী এবং কর্মদক্ষ কয়েকজন ক্লাসমেটের আগ্রহে আবার দেখা হতে থাকে ফেলে আসা যৌবনের সেই সব বন্ধুবান্ধব দের সাথে। মাঝেমধ্যেই শহরের এখানে সেখানে বসে যায় ছোট বড় সব রি- ইউনিয়ন। ছবিতে ছবিতে ভরে যায় আমাদের ক্লাসের ছোট্ট হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের পাতা। কলকাকলীতে মুখর হয়ে ওঠে এতদিনের স্তব্ধতা। ‘বন্ধু কি খবর বল?কতদিন দেখা হয় নি! ‘নিরুচ্চারে বলি আমরা সকলে। সোস্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাছাকাছি চলে আসতে থাকে দূরে সরে যাওয়া সব বন্ধুরা।
আর কতদিন পরে দেখা হলে যা হয়, আনন্দ আর উচ্ছ্বাস বাঁধ মানে না কারোরই। আড্ডা,আলোচনা,গান আর খুনসুটিতে সবাই ফিরে যেতে চায় তারুণ্যের দাপিয়ে বেড়ানো দিনগুলোতে। সবার কলেজ জীবনের সেই একচিলতে মেজদার ক্যান্টিনের টেবিলটার চার পাশে। সময়ের ধুলো সরে গিয়ে এক লহমায় সব যেন ফিটফাট।
এরকম করেই দিন কেটে যাচ্ছিল বেশ। নিজের পেশাদার দুনিয়ার টানাপোড়েনকে খানিকটা দূরে রাখার চেষ্টা। হাসি, গল্প, কবিতা আর ছবি আঁকা। ছুঁতে চাওয়া ফেলে আসা সময়টাকে। কিন্তু কোভিড এসে গোলমাল করে দিল সব অঙ্ক। ভাইরাস, কে ডাক্তার আর কে রোগী তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় না। বয়স আর কোমর্বিডিটিকে লক্ষ্য করে শানায় তার আক্রমণ।
বয়সের সাথে সাথে আমার বন্ধু বিশুর কিছু শারীরিক অসুবিধা তৈরী হয়েছিল। অনেকেরই যেমন হয়। ইদানীং তাতে বাগড়া দিল কোভিড। পজিটিভ হয়ে ভর্তি হতে হল বন্ধুকে বেসরকারি হাসপাতালে। বাড়িতে ফিরে আসার পর আবার শরীর খারাপ। আবার হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু এবার তিন দিনের লড়াইয়ের পর সব শেষ। ভেন্টিলেটর, জীবনদায়ী ওষুধ কোন কিছুতেই শেষ রক্ষা হলো না।
মানুষ নশ্বর। মৃত্যু ছাড়া তার জীবনে সবকিছুই অনিত্য। আর আমরা চিকিৎসক মাত্রই জানি মরা আর বাঁচার মধ্যে ফারাক ঠিক কতটুকু। এক লহমায় কি ভাবে মানুষকে চলে যেতে হয়। কিন্তু এই খারাপ সময়ে এইভাবে চিকিৎসকদের চলে যাওয়া এই মুহূর্তে দেশের উপর অভিশাপের মতো। বিশুদের মতো হাইলি স্কিলড ডাক্তারের প্রাণ তো সেই অর্থে অমূল্য।
তাই আজ শেষ বিদায়ে বন্ধুকে এগিয়ে দিতে যাওয়ার সময় কত কিছুই যে মনে পড়ে যাচ্ছিল। খুব আচ্ছন্ন লাগছিল নিজের।
ভেসে উঠছিল মেডিক্যাল কলেজের ছবি। ক্ষুদিরাম হোস্টেলের সেই ঘরগুলোয় বসে আড্ডা আর ক্যারম খেলা। শেষ রিইউনিয়নের হুলুস্থুল।
বন্ধুদের সাথে কাটানো সেই আনন্দের দিনগুলোই স্মৃতি হয়ে থাক আমার জীবনে। ভবিষ্যতে চলার পাথেয় হয়ে। যতদিন বেঁচে থাকবো, বুঁদ হয়ে থাকবো সেই নস্টালজিয়ায়।
ভালো থাকিস বন্ধু। আবার দেখা হবে। অন্য কোন দিন।
কিছু বলার ভাষা নেই…??