আগের পর্বে ভারতের পশ্চিম প্রান্তের একটি হাসপাতালে আমার কর্মজীবনের কথা বলেছিলাম। এটিও সেই হাসপাতালেরই ঘটনা।
ওই ডিভিশনের একটি বিশেষ ইউনিয়নের সম্পাদক দোর্দণ্ড প্রতাপ এক মহামহিম নেতা ছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি আমার হাসপাতালেরই অফিস কর্মী। ইউনিয়নের নেতা হলে, কোন কাজ করতে হয় না এ কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু সমস্যা ছিলো যে অফিসে কর্মীর সংখ্যা অতি অল্প আর কাজের চাপ খুব কম নয়। সেই সঙ্গে শূন্য পদের সমস্যাও ছিলো। তাই নিতান্তই নিরুপায় হয়ে ওই মহামহিমকে কখনও অতি সামান্য কাজ দিলে প্রথমে উনি মুখে কিছু বলতেন না। কিন্তু তার দুএক দিনের মধ্যে বেশ কিছু সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে আমার আদ্যশ্রাদ্ধ করতেন। চেয়ার ওল্টানো, ফাইল, কাগজপত্র ছোঁড়া ইত্যাদি নানাবিধ ব্যায়ামের কসরতও দেখতে হতো। ওই ভদ্রলোকের একজন অনুচর ছিলেন যিনি বিশেষ বাক্যবিন্যাসে পারঙ্গম। আমার হিন্দি ভাষার কুশলতা অতুলনীয়। আমার দুই মেয়েই আমার মুখের হিন্দি শুনে হেসে গড়াগড়ি দেয়। এহেন হিন্দি ভাষাবিদ আমি, এই ধরণের অনুষ্ঠানে ওই অনুচর ভদ্রলোকের কাছ থেকে অনেক হিন্দি গালি সংগ্রহ করেছিলাম। দুর্ভাগ্য আমার, এখন প্রয়োজনীয় চর্চার অভাবে বিস্মৃত হচ্ছি।
আমার ডিভিশনে দশটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ছিলো। প্রায় প্রতিটিই বহুদূরে দূরে অবস্থিত। ওদের পরিদর্শনে প্রায়ই চারশ পাঁচশ কি.মি. পথ পাড়ি দিতে হতো। ওখানে ট্রেন পরিষেবা খুবই সীমিত। কিন্তু রাস্তাঘাট বেশ ভালো, তাই এই পরিদর্শনগুলি গাড়িতেই করতাম। একবার এরকমই এক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলাম ডিভিশনের প্রবন্ধক মহোদয়ার সঙ্গে। ফেরার পথে সন্ধ্যা নেমেছে, হঠাৎ করে ওই অনুচর ভদ্রলোকের ফোন এল, নাম দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো, উনিতো আমায় কোন আনন্দসংবাদ দানে আপ্যায়িত করবেন না। ফোন ধরলাম, দুঃসংবাদ আশঙ্কা করেছিলাম, ঠিক তাই। ওই মহামহিম নেতার পদস্খলন ঘটেছে আর কাঁধে ভীষণ চোট লেগেছে। ওনাকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। আমি রেডিওগ্রাফারকে ফোন করলাম দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য। আপৎকালীন বিভাগের ডাক্তারকেও খবর দিলাম।
মহামহিম হাসপাতালে এলে তাঁকে এক্স-রে করতে নেওয়া হলো। আমি সব শুনে রেডিওগ্রাফারকে নির্দেশ দিলাম কি এক্স-রে করতে হবে। দ্রুত এক্স-রের ছবি ফোনে আমার কাছে পৌঁছলো, দেখলাম ভদ্রলোকের ডানদিকের কাঁধে হিউমেরাস হাড়টির মাথা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি টুকরো হয়েছে। ডিভিশনাল প্রবন্ধক মহোদয়াও খুবই চিন্তায় ছিলেন। কারণ এই সব নেতাদের উপদ্রব মূল্য খুবই বেশি। কোন ঝামেলা হলে তাঁর দায় ওনাকেই শেষমেশ পোহাতে হবে। ওনাকে নেতার চোটের অবস্থা বর্ণনা করলাম। উনি প্রশ্ন করলেন, ‘কি করবেন?’ ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে খন্ড মুহূর্তে সময় স্তব্ধ হয়ে গেল। একটি নিমেষ সরণি জুড়ে শুধু অনুরাগে কেন দাঁড়াবে? তীব্র বীতরাগেও তো কখনও দাঁড়াতে পারে, তাই না? আমার মনে হলো, আমাকে আমার নিজের সামনে দাঁড়ানো দরকার।
এমনিতে এই ধরনের হাড়ের চোটের অপারেশন আমার হাসপাতালে কখনও হয়নি। সবসময়ই সাতশ কি.মি. দূরে মুম্বাইয়ের প্রধান হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার ওপর আবার মহামহিমের অপারেশন। আমি ওনাকে জানালাম আমার হাসপাতালেই অপারেশন করবো। হাসপাতালে প্রায় প্রতিনিয়ত আমার লাঞ্ছনার কথা উনি জানতেন। আমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, ‘ঠিক আছে।’
গাড়িতে যেতে যেতে আমি স্থানীয় যে সরবরাহকারী আমার হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে তাঁকে ফোন করলাম। হিউমেরাসের মাথার ফ্র্যাকচারের অপারেশনের জন্যে বিশেষ ধরনের প্লেট এবং স্ক্রু প্রয়োজন, উনি সেগুলি দ্রুত সরবরাহ করতে পারবেন কি না? উনি বললেন যে আগামীকাল দুপুরে দিতে পারবেন। আমি কিঞ্চিৎ আশস্ত হলাম। অস্থিশল্যচিকিৎসা পুরোপু্রি যন্ত্রপাতি নির্ভর। চিকিৎসকের ভূমিকা কিছুটা গৌণ। সঠিক যন্ত্রপাতি পেলে আমার মত অতি অখাদ্য শল্যচিকিৎসকও সফল অপারেশন করতে সক্ষম। যন্ত্রপাতির ব্যাপারে আমি কিছুটা খুঁতখুঁতে। আমার আগের হাসপাতালে আমাদের কিছু সুইজারল্যান্ডে তৈরী বহু পুরনো যন্ত্রপাতি ছিল। এগুলির কার্যকারিতা ছিল অসাধারণ। আমার খুবই প্রিয় এই যন্ত্রগুলি বহু অসম যুদ্ধে আমায় বাঁচিয়েছে। অপারেশন থিয়েটারে কাজ না থাকলে কখনও আমি এদের ঢিলা হয়ে যাওয়া স্ক্রু টাইট করেছি,ঊখো ঘসে ধার দিতে বসেছি বা সস্নেহে এদের গায়ে হাত বুলিয়েছি (আমার নিজের মাথার স্ক্রু একটু ঢিলে, এটা আমার বন্ধুরা সকলেই অবগত আছেন, যাঁরা জানেন না তাঁদের কাছে এই ফাঁকে আত্মপ্রকাশ করে নেওয়া গেল)। আমার এই হাসপাতালে অস্থিশল্যচিকিৎসার প্রায় কোন যন্ত্রপাতিই ছিল না। আমি এসে সেগুলি কেনার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। কিছু পেয়েছিলাম, কিছু পাইনি। সবই স্থানীয় যন্ত্রপাতি, সুইজারল্যান্ডের তৈরী যন্ত্রের মতো কার্যকারী নয়। কিন্তু ভিখারির তো আর পছন্দের অবকাশ থাকে না।
সেই দিন ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল, ঘরে ফেরার আগে একবার হাসপাতালে গেলাম নেতা মহোদয়কে দেখতে। দেখি ভদ্রলোক বেশ ম্রিয়মাণ হয়ে আছেন। আমি বললাম, ‘যে কোন ভয় নেই, যা করার এখানেই সব করা হবে’। আমি সিস্টারকে প্রয়োজনীয় সব নির্দেশ দিয়ে বিদায় নিলাম। পরদিন অপারেশনের পূর্ববর্তী সব পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে গেল। অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্লেট ও স্ক্রুর বাক্সও এসে গেল। তাদের জীবাণুমুক্ত করতে দেওয়া হল। রোগীর সঙ্গে আর একবার কথা বলতে গেলাম। উনি বললেন যে অপারেশনের সময় একজন বেসরকারী অস্থিশল্যচিকিৎসককে উনি উপস্থিত রাখতে চান। মহামহিম নেতার আবদার! আমি বললাম, কোন আপত্তি নেই কিন্তু তাঁকে আমার সহকারী হিসেবে থাকতে হবে। কারণ আমার মনে হয়েছিল, যদি আমাকে দাঁড়াতেই হয়, তাহলে শক্ত পায়েই দাঁড়াবো আর স্থির হয়েই দাঁড়াবো। পরদিন সকালে অপারেশন। আমি হাসপাতালে পৌঁছে দেখি প্রায় শখানেক লোক বাইরে অপেক্ষমান। মহামহিমের সেই অনুচর সকলের সামনে দাঁড়িয়ে। উনি বললেন, ‘ ডাক্তারবাবু, নেতাজি নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবেন, নইলে ..’। বাক্যটি অনুক্তই রইল। নইলে যে কি হবে তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। ম্লান হেসে ও.টি.তে ঢুকলাম।
রোগীকে নিয়ে আসা হল। অ্যানাস্থেটিস্ট অবশ করার ইনজেকশন দিলেন। রোগীকে টেবিলে শুইয়ে পোজিশান করা হলো। ইতিমধ্যে সেই বেসরকারি অস্থিশল্যচিকিৎসকও এসে গেছেন, দেখলাম ভদ্রলোক আমার চেয়ে নবীন আর আমার সহকারী হতে কোনো আপত্তি নেই। অপারেশন শুরু করা হল। দেখলাম হিউমেরাসের মাথাটি বেশ কয়েকটি টুকরো হয়ে গেছে। সবকটি টুকরোগুলিকে সঠিক জায়গায় এনে প্লেট দিয়ে জোড়া হল। পেছনের দিকে চলে যাওয়া একটি টুকরোকে ঠিক জায়গায় আনতে বেশ কষ্ট করতে হল। শেষমেশ বিশেষ প্লেট ও স্ক্রু দিয়ে ফ্যাকচারটিকে বাঁধা হলো, তারপর ড্রেন দিয়ে অপারেশনের ক্ষতটি সেলাই করে দিলাম। ব্যান্ডেজ করে প্লাস্টারও করা হলো। রোগীকে বিছানায় স্থানান্তরিত করা হলো। ও.টি. থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমান জনতাকে কিঞ্চিৎ আশস্ত করে বিদায় নিলাম। এরমধ্যে খবর পেয়েছি যে অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত নার্স ও কর্মচারীদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া হয়েছে অপারেশন এই অধমই করেছে কিনা।
পরদিন এক্স-রে করে মহামহিম নেতাকে দেখালাম যে হাড়ের টুকরোগুলো ঠিকঠাকই বসাতে পেরেছি। উনি নাক দিয়ে একটি ঘুৎকার করে আমায় জবাব দিলেন। আস্তে আস্তে ক্ষতস্থান শুকিয়ে গেলে সেলাই কেটে দিলাম। ফিজিওথেরাপি এর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এরপর প্লাস্টারও খুলে দিলাম, হাতের সম্পূর্ণ ফিজিওথেরাপি শুরু করা গেল। যথা সময়ে ভাঙ্গা হাড় ভালোভাবে জুড়ে গেল। কাঁধের ও হাতের নাড়াচাড়াও পুরো স্বাভাবিক হয়ে গেল। উনি কাজের যোগ দিলেন। চেয়ার ওল্টানো, ফাইল, কাগজপত্র ছোঁড়াও অব্যাহত রইল। অপারেশনের পর যে হাত পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে এগুলি তার সঠিক সাক্ষ্য দিয়েছিল।
এই হাসপাতালটির উন্নতির জন্যে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। এখানে কোন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিল না, অনেক চেষ্টা চরিত্র করার পর একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এখানে যোগ দিয়েছিলেন। চক্ষু বিভাগে কোন যন্ত্রপাতি ছিল না, অনেক কষ্টে রিফ্রাক্টোমিটার ইত্যাদি যন্ত্রপাতি আনা গিয়েছিল। একটি মাইক্রোস্কোপেরও ব্যবস্থা হয়েছিল। প্যাথলজি বিভাগের জন্যে অটোঅ্যানালাইজারের ব্যবস্থাও করা গেল। আর আমার অস্থিশল্যচিকিৎসা বিভাগের কথাতো আগেই বলেছি। মহিলা কর্মচারীদের কোন ওয়াশরুম ছিল না, নতুন করে তৈরী করাতে পেরেছিলাম। কিন্তু প্রতি নিয়ত ইউনিয়নের এই লাঞ্ছনা আর সহ্য হচ্ছিল না। প্রতি পদে মনুষ্যত্বের এত অবমাননা আর নিতে পারছিলাম না। আমি আমার স্থানান্তরের জন্য আবেদন করেছিলাম। অবশেষে তা মঞ্জুর হয়েছিল।
ওখান থেকে চলে আসার আগের দিন আনুষ্ঠানিক বিদায় নেবার পর অফিসে বসে আছি, এমন সময় ওই মহামহিম নেতা এলেন। অন্য দিন সপার্ষদ আসেন, আজ একা। নমস্কার বিনিময় ও দুচার কথার পর উনি বললেন, ‘স্যার, একটা কথা বলবো?’ আমি বললাম ‘নিশ্চয়ই, বলুন।‘ উনি বললেন, ‘বোধহয় আমার হাত ভাঙ্গবে বলে আপনি এখানে এসেছিলেন’। আমি ম্লান হেসে বললাম, ‘বোধহয়।‘ উনি বিদায় নিলেন।
আমি শেষ বারের মতো আমার অফিস থেকে সামনের চত্বরে নেমে এলাম। বেলা পড়ে এসেছে, সামনে ছড়িয়ে আছে আশ্চর্য আলো। বিরাট রেইন ট্রি গাছের নীচে হলুদ পাতার স্তুপ। দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হলো চুল। উড়িয়ে নিল একমুঠো রঙিন ধুলো আর হলুদ পাতার স্তুপ। ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে, ..তোমারি মতো আমারও উত্তরী, আগুন রঙে দিও রঙিন করি, অস্ত রবি লাগাক পরশমণি, প্রাণের মম শেষের সম্বলে।
সুন্দর উপস্থাপন, ভালো থাকবেন স্যার
অনেক ধন্যবাদ, খুব ভালো থাকবেন।