ঘড়িতে তখন ঠিক দুপুর বারোটা। শেষ সিগারেটটা শেষ করার আগেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সিগারেটের খোঁজে। এই সব বিপদের সময়ে আমার মুস্কিল আসান আমার অর্থাৎ এসিস্টেন্ট চিফ মেডিক্যাল অফিসারের এপিডমিওলজিক্যাল স্কোয়াডের সদস্য হেল্থ এসিস্টেন্ট বা এইচএ স্বপন বাবুও সঙ্গে নেই সেদিন। একটা দোকানেও সিগারেট পাওয়া যায় না। এ কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা।
জায়গাটা এমনিতে খাসা। সামান্য উঁচু পাহাড়ের ওপর চা বাগানের পাশে বস্তি। নিচে ডায়না নদী। পাহাড়, জঙ্গল, নদী। টিপিক্যাল জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স। নামটা যদিও অদ্ভুত। “লাল ঝামেলা” বস্তি। কোন লাল কবে ঝামেলা পাকিয়ে ছিল কে জানে। আজ সিগারেট না পেলে এই আমি ঝামেলা পাকাবো সঙ্গে থাকা নাগরাকাটা ব্লকের ম্যালেরিয়া ইন্সপেক্টর বা এমআই অজিত বাবুর সঙ্গে। অজিত রায়।
সেই সকাল থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি অজিত বাবুর সঙ্গে। সারপ্রাইজ ভিজিট। ম্যালেরিয়া স্প্রে করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে গিয়ে দেখছি গতকাল কেমন কাজ হয়েছে। তার পরে দেখতে যাবো আজ যেখানে স্প্রে হচ্ছে। অজিত বাবু বিচক্ষণ লোক। বুঝেই গেছেন যে সিগারেট না পেলে স্যারের মেজাজ খারাপ হতে থাকবে। কপালে অশেষ দুঃখ। অতএব মাঠে নেমে দৌড় ঝাঁপ লাগলেন। দশ মিনিট বাদে খবর আনলেন। চমৎকার খবর। এখানে সিগারেট নামক ভীষণ দামী জিনিসটির কোনো নিয়মিত খদ্দের নেই বিক্রি হয় না তাই।
অগত্যা মুড খারাপ করেই শুরু হল। দ্বিতীয় দফার অভিযান। এই ফাঁকে একটু ছোট্ট করে দু একটা জিনিষ জানিয়ে রাখি। পাঠকদের অনেকের কাছে বিষয়টা অপরিচিত। এই এইচএ মেল বা এমআই, এঁরা সবাই আসলে মালটিপারপাস মেল হেল্থ ওয়ার্কার নামক একটি লুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী, সরকারি ভাষায় “ডাইং ক্যাডার”।
অথচ এঁদের গুটিকয় যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন তাঁদের সাহায্য নিয়ে স্বাস্থ্য দপ্তর কত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে তা বলার নয়। এঁরা মূলতঃ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কালা জ্বর এই সব নিয়ে কাজ করা ফিল্ড কর্মী। ম্যালেরিয়ার জন্য জ্বরের সার্ভালেন্স বা নজরদারির অংশ হিসেবে লোকের রক্ত টেনে স্লাইড তৈরি করা। ক্লোরোকুইন বড়ি খাওয়ানো, ডায়রিয়া হলে ওআরএস, হ্যালোজন বড়ি বিতরণ, বন্যার পরে ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের ডিসিনফেকশন ব্লিচিং পাউডার দিয়ে, জন্ম মৃত্যুর খবর আনা, কোনো রোগের আউটব্রেক বা প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে, যতই দুর্গম হোক, সেই অঞ্চলে মেডিক্যাল টিমের অংশ হিসেবে কাজ করা, কুষ্ঠ রোগের ওষুধ খাওয়ানো, তার পায়ের ঘায়ের পরিচর্যা করা এই সব কাজ এঁরা অনায়াসে, অক্লেশে করতেন, এখনও করেন। ব্লকে দ্বায়িত্বে থাকা ব্লক স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা এসবের সাথে ফুড লাইসেন্সেরও দেখভাল করতেন।
এঁদের পূর্বসূরী অর্থাৎ ইউনিপারপাস ফিল্ড ওয়ার্কারদের সাহায্যেই স্মল পক্স এই টিকাকরণ করে আমরা রোগটাকে নিশ্চিহ্ন করতে পেরেছিলাম। এক কথায় এঁদের ফিমেল কাউন্টার পার্ট এইচএ ফিমেল বা এ এন এম-রা তখন কাজ করতেন মূলতঃ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে। এই এইচএ মেল-দের সংখ্যা দ্রুত কমে আসায় ওইসব কাজও আজকাল এএনএম দের ঘাড়ে চেপেছে। অনেক দিন ধরেই চলছে এই ইতিহাস। আগের জামানা থেকেই। জানি না কোনোদিন বদলাবে কি না।
যাই হোক, গল্পে ফিরে আসি। সিগারেট বিহীন দ্বিতীয় পর্যায়ে এবার আমার লক্ষ্য স্প্রে গ্যাং এর কাজকর্ম। গ্যাং মানে পাঁচ জনের দল। ক্যাজুয়াল ওয়ার্কার। দিনমজুর না বলে বলা ভালো মরশুমি কর্মী। ম্যালেরিয়ার মরশুমে কয়েকদিন কাজ পায়। স্কিল্ড জব। ডিডিটি পাউডার বস্তা থেকে বের করে গুলে স্টিরাপ পাম্প এর সাহায্যে ঘরের ভেতর এর দেওয়ালে স্প্রে করা নিপুণ হাতে। আমাদের ভাষায় “ইনডোর রেসিডুয়াল স্প্রে”।
এদের সাজ সরঞ্জাম, উপকরণ ওইসব রাখার জন্য গ্রামের মধ্যে কোনো ঘর ঠিক করা হয় যেখানে এম আই গাড়ি করে গিয়ে ওইসব ডিডিটি এর বস্তা, পাম্প, জলের বালতি, পলিথিন সিট এই সব মজুত করে আসেন আগে ভাগে। তাকে বলে ক্যাম্প। সেই ক্যাম্প ওই স্প্রে গ্যাং এর অস্থায়ী আস্তানাও হয়। রাতে শোয়া, রান্না করে খাওয়া ইত্যাদি।
বেলা তিনটে নাগাদ শেষ হল আমার ভিজিট ও স্প্রে গ্যাং এর কাজ। গাড়ি মানে আমার ধ্যারধেরে ইউনিসেফের প্রাগৈতিহাসিক জিপ ঘুরিয়ে মালবাজার হাসপাতালের কোয়ার্টারে ফিরে আসার তোড়জোড় করছি এমন সময় আমার সদা হাস্যময় অজিত বাবুর সনির্বন্ধ অনুরোধ, “স্যার, সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া তো কিছুই হল না। কোয়ার্টার এ ফিরে একা একা কি খাবেন কখন খাবেন, তার চেয়ে ক্যাম্প এ চলুন আমাদের সাথে দুটি খেয়ে যাবেন”
অজিত বাবুর কথায় হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। গত কয়েক বছরে এত খিদে পায় নি। ছাত্রাবস্থায় না খেয়ে পয়সা বাঁচানোর জন্য আবিষ্কার করা মহৌষধ আসলে সেদিন প্রয়োগ করিনি যে। চা ও সিগারেট অগুনতি বার। অগত্যা অজিত বাবুর সঙ্গী।
বেলা চারটে এর সময় তৈরি হল খাবার। ডিমের ঝোল আর ভাত। উঁকি মেরে দেখলাম আমার ও আমার ড্রাইভারের পাতেই কেবল আস্ত ডিম। বাকিদের জন্য আধখানা। বুঝলাম সারপ্রাইজ ভিজিট এর নামে এসে কাদের খাবারে ভাগ বসিয়েছি। খাওয়া শেষ হল। অজিত বাবুর সদা হাসিভরা মুখ তখন ওই সামান্য আয়োজনে তার প্রিয় স্যারকে আপ্যায়িত করার ব্যর্থতায় কুন্ঠিত।
আবার বর্ষা নামছে। নামছে বৃষ্টি। ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচতে নামানো হচ্ছে স্প্রে গ্যাং। দেখভাল করার দায়িত্বে মাল্টিপারপাস হেল্থ ওয়ার্কার মেল নামের লুপ্তপ্রায় প্রজাতির কিছু স্বাস্থ্যকর্মী, যাদের অনেকেই চুক্তিবদ্ধ, বেতন বাড়েনি বহুদিন। তবুও তারা নামবে। তাদের সামান্য উপার্জনেই আবার রান্না হবে।
জীবনে বহু জায়গায় এর আগে বা এর পরেও নেমন্তন্ন খেয়েছি। কিন্তু আজও মুখে লেগে আছে সেই ডিমের ঝোলের স্বাদ। পাহাড়ে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নামে। গাড়ি ঘুরিয়ে যখন নেমে আসছি তখন অস্তগামী সূর্যের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকা অজিত বাবুর ক্লান্ত, ম্লান, ম্রিয়মাণ মুখের সেই ছবি চিরকাল বুকে আঁকা থাকবে।
অজিত বাবু অবসর নিয়েছেন, আমিও নাগরাকাটা থেকে বহুদূরে তাই নতুন করে রাঁধা ডিমের ঝোলে ভাগ বসাতে যাবো না আর। খালি প্রার্থনা করি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন আমার প্রিয় – “নাগরাকাটা গ্যাং”।