টিভিতে ব্রেকিং নিউজ টা দেখেই মহিমবাবু স্ত্রীকে ডাকলেন। –“নিচের ঘরে ভাড়া নেওয়া ওই নার্সকে এখনই ঘর ছেড়ে দিতে বলো। ওনার হাসপাতালে করোনা ধরা পড়েছে।”
–“কিন্তু উনি তো এখন ডিউটিতে গেছেন।”
মহিমবাবুর ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা আছে। টিভিতে দেখেছেন যাদের এসব রোগ আছে, তাদেরই মৃত্যুহার বেশি। তাই কোনো রিস্ক নিতে চান না তিনি। ঘরে ঢোকার আগেই ওনাকে পত্রপাঠ বিদায় করবেন ঠিক করলেন।
সন্ধ্যে প্রায় অতিক্রান্ত, বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে একজন অল্প বয়সী নার্স মহিমবাবুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তখনও কাকুতি মিনতি করে চলেছেন। বেশিদিন হয়নি তিনি এখানে এসেছেন। তাই ভালো করে সবকিছু চেনেনও না। হঠাৎ করেই এভাবে বাড়ি ছাড়তে বললে, তাঁর একার পক্ষে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ তিনি যেদিন প্রথম এসেছিলেন, ওনারাই সেদিন নিজের মেয়ের মত করেই দেখবেন বলেছিলেন। সত্যি… করোনা এসে সবার মুখোশ খুলে দিল! আরও একবার কাতর আর্জি জানালেন তিনি, “দয়া করে আমার জিনিসগুলো অন্তত নিতে দিন!”
কিন্তু সে আওয়াজের কোনো প্রত্যুত্তর মিললো না। আশেপাশের বাড়ির ব্যালকনিতে কৌতূহলী চোখ গুলোও নির্বিকারই রইলো। যেন তিনি এপাড়া থেকে বিদায় নিলে সবাই শান্তিতে ঘুমাতে পারবে! তাঁকে আগে কখনোই এরকম অপমানিত হতে হয়নি। যে মানুষগুলোকে সেবা করার জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের ঘৃণাভরা চোখেই আজ তিনি অপরাধী!
আজ বেশ খোশ মেজাজেই আছেন মহিমবাবু, একমাত্র মেয়ে বাড়ি ফিরছে।
লকডাউনে দিল্লিতে আটকে পড়ায় মেয়েকে নিয়ে কয়েকটা মাস খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি।
ওনার মেয়ের ছোট থেকেই অ্যাজমার সমস্যা, ইনহেলার নিতে হয়। সিজন চেঞ্জের সময় একটু আধটু ভোগায়। তাই হালকা শ্বাসকষ্ট কাশি থাকলেও অতটা কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্টটা খুব বেড়ে গেল। পরিচিত চিকিৎসক যত দ্রুত সম্ভব ভর্তির পরামর্শ দিলেন। মহিমবাবু নামিদামি সব বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরলেন, কিন্তু শ্বাসকষ্টের সাথে জ্বর থাকায় করোনা টেস্ট না করিয়ে কেউ ভর্তি নিতে চাইলো না। এদিকে ওনার মেয়ে ক্রমশ যেন নেতিয়ে পড়ছে। শেষে সরকারি হাসপাতালেই নিয়ে যাবেন ঠিক করলেন। কিন্তু তখনও অনেকটা পথ বাকি…এরমধ্যেই ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে পড়ল অ্যাম্বুল্যান্স। মহিমবাবু হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে গিয়ে কাতর আবেদন করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সিগন্যাল সবুজ হতেই ফিরে এসে দেখেন…একজন মহিলা ওনার মেয়েকে চিৎ করে শুইয়ে বুকের ওপর দুহাত দিয়ে চাপ দিচ্ছেন আর মুখে মুখ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছেন। পিছন থেকে দেখে মহিলাকে চেনা মনে হলেও কোথায় দেখেছেন ঠিক মনে করতে পারলেন না তিনি। মাথাটাও এখন ঠিকমত কাজ করছে না তাঁর। তিনি কিছু বলার আগেই ড্রাইভার বলে উঠলো, “পাশের গাড়ি থেকে উনি আপনাকে দেখতে পেয়ে নিজে থেকেই চলে এসেছেন। আর যা করছেন ওটা এখন খুবই জরুরী।” মহিমবাবু কি করবেন কিছু বুঝতে না পেরে সামনের সিটে বসে চোখবন্ধ করে শুধু ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলেন।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর হাসপাতালের চিকিৎসক মহিমবাবুকে জানালেন, ওনার মেয়ে এখন একটু সুস্থ হয়েছেন। তবে ঠিক সময়ে সি.পি.আর না দিলে ওনার মেয়েকে বাঁচানো যেত না।
অ্যাম্বুল্যান্সে এসে যেভাবে নিজের মাস্ক খুলে মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছেন ওই মহিলা, তাতে ওনাকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। মহিমবাবু ড্রাইভারের কাছে ওই মহিলার খোঁজ করে জানলেন উনি এই হাসপাতালেরই নার্স। কিন্তু ওনাকে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে, তাই দেখা করা সম্ভব না। মহিম বাবু ওনার নাম জানতে চাইলেন। ড্রাইভার বললো, “নাম তো বলেননি…তবে উনি নাকি আপনার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন..”
কথাটা শুনে চমকে উঠলেন মহিমবাবু… কয়েকদিন আগেই করোনা ভয়ে তিনি যাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, আজ তিনিই করোনা ভয় উপেক্ষা করে তাঁকে এত বড় ‘কৃতজ্ঞতা’ জানিয়ে গেলেন!
অসাধারন।
আপনি আমাকে আপনার ফোন নাম্বার টা দিয়েছেন email এ। কৃতজ্ঞ রইলাম।