আবার টরন্টো শহরে এলেন বান্টিঙ। এবার লক্ষ্য ডাক্তারি পড়া। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই গ্লাউস্টার স্ট্রিটে, ও’নিল পরিবারের একটা ঘর ভাড়া নিলেন বান্টিঙ। সপ্তাহের ভাড়া ৫ কানাডিয়ন ডলার। ইরি হ্রদের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত সিমকো গ্রাম থেকে পড়তে আসা গণিত বিভাগের ছাত্র স্যাম গ্রাহাম হলেন তাঁর রুমমেট[১৩]। বান্টিঙ প্রসঙ্গে গ্রাহাম পরে বলেছেন, বান্টিঙ খুব পরিশ্রমী ছিলেন। অনেক রাত পর্যন্ত পড়তেন বান্টিঙ। বরং তিনিই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তেন।
গ্রাহাম বলেছেন, মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে চার্চ স্ট্রিটে জনৈক ক্লার্কের বাড়ি চলে যেতেন বান্টিঙ। গ্রাহাম তখনও জানতেন না যে ক্লার্কের ভাগ্নি, এডিথ রোচ তখন ক্লার্কের কাছেই থাকতেন। অ্যালিস্টন থেকে রোচ তখন এসে উঠেছেন টরন্টো শহরে, মামার বাড়িতে। ভিক্টোরিয়া কলেজে ভাষা বিজ্ঞান পড়ছেন এখন রোচ। রোচের টানেই মাঝে মাঝে চার্চ স্ট্রিট মুখো হতেন বান্টিঙ।
ডাক্তারি পড়াটা ছিল তরুণ বান্টিঙের এক আবেগ তাড়িত স্বপ্ন। বাস্তব চিত্রটা যে ছিল একেবারেই ভিন্ন রকমের, সেটা বোধহয় প্রথমে বুঝতে পারেন নি বান্টিঙ। একেই মোটা মোটা বই পড়া ধাতে নেই বান্টিঙের। তার উপরে খেলাধূলা, গান বাজনা, হৈচৈতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। কলেজের হয়ে নিয়মিত রাগবি খেলতেন তিনি। করতেন স্কেটিং, চলতো গান বাজনা, শুধু পাঠ্য বই নিয়ে বসায় কোনো আগ্রহ ছিল না তাঁর। যথারীতি ঠিক পরীক্ষার আগে বসতেন বই নিয়ে। অনেকটা রাত পর্যন্ত পড়তেন। তবে ঠিক ততটুকুই, যতটুকু না পড়লেই নয়। পরীক্ষার ফলও তাই তেমনই হলো। নিতান্তই সাধারণ মানের নম্বর পেলেন বান্টিঙ। কোনো রকমে টেনেটুনে পাশ করলেন তিনি। ডাক্তারি পড়া নিয়ে তাঁর স্বপ্ন, তাঁর আবেগ, তাঁর আগ্রহ- মোটেও প্রতিফলিত হয় নি তাঁর পরীক্ষার ফলে। আর এটা কোনো এক বছরের গল্প নয়। ডাক্তারি কোর্সের প্রতি বছরই ধারাবাহিক ভাবে খারাপ ফল করে যাচ্ছেন বান্টিঙ। আর ফল যত খারাপ হচ্ছে, পড়াশুনায় অনীহা ততই বেড়ে যাচ্ছে তাঁর।
ধুস্স্ এই ডাক্তারি পড়তে মোটেও ভালো লাগছে না তাঁর। এ যেন আরেক যন্ত্রণা। মুক্তি চান তিনি এই যন্ত্রণা থেকে। আর তখনই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠে ছোটোবেলার সেই স্বপ্ন। ডাক্তার হয়ে আর্তের শুশ্রূষা করার স্বপ্ন। না, না, তাঁর সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটুক, এটা কিছুতেই চান না তিনি। অন্তর থেকে আর্ত মানুষের সেবা করতে চান তিনি। চান আহতদের শুশ্রূষা করতে। কিন্তু তার জন্য এত বই পড়তে হবে কেন? মনের তাগিদই কি শেষ কথা নয়? বড় বিরক্তিকর এই পড়াশুনা! অথচ তিনি এটাও ভালো করেই জানেন যে, ডাক্তারি পাশ না করলে তাঁর স্বপ্ন কোনোদিনও বাস্তবায়িত হবে না। নিরুপায় বান্টিঙ মেনে নেন, পড়শুনা চালিয়ে যেতে হবে তাঁকে। জীবনে দ্বিতীয় বারের জন্য, ‘পড়বো? না, পড়া ছেড়ে দেবো?’ গোছের মানসিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হলেন বান্টিঙ।
বাঁদিক থেকে: বান্টিঙ, রোচ, এলা নাইট (গ্রাহামের বান্ধবী), স্যাম গ্রাহাম। অ্যালিস্টন ১৯১৫। |
পড়া না-পড়ার এই মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যখন অতিবাহিত হচ্ছিল তাঁর দিন, ঠিক তখনই বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) দামামা। এই যুদ্ধই তাঁর জীবনকে দাঁড় করালো বড় এক বাঁকের মুখে। সেই ছোটোবেলা থেকেই আহতদের শুশ্রূষা করার স্বপ্ন লালন করে এসেছেন তিনি। আহতের সেবাই তাঁর ধ্যান জ্ঞান স্বপ্ন। বান্টিঙের মনে হলো, যুদ্ধই হলো আহতের সেবা করার সেরা মঞ্চ। যুদ্ধাহতদের শুশ্রূষা করতে চান তিনি। যুদ্ধাহতদের শুশ্রূষা করার মধ্যে দিয়েই তাঁর স্বপ্ন সাকার করতে চান। প্রায় সারা দিন ধরেই এই সব চিন্তা তোলপাড় করে চলেছে তাঁর মাথায়। আর যত এই সব ভাবছেন ভিতরে ভিতরে তত অস্থির হয়ে উঠছেন বান্টিঙ। অবশেষে তিনি স্থির করে ফেললেন, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধাহতদের শুশ্রূষা করার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। অতএব, সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন তিনি। এ নিয়ে আর কোনো দ্বিধা নেই তাঁর মনের মধ্যে। তাহলে ডাক্তারি পড়ার কী হবে? ধুত্তোর, পড়াশোনা। এই সব মোটা মোটা বই পড়ার থেকে যুদ্ধে যাওয়া ঢের ভালো।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। কানাডার সেনাবাহিনীতে তখন নেওয়া হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের। এক মুহূর্ত দেরি না করে, বান্টিঙ চললেন সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে। ৫ই অগস্ট ১৯১৪, বান্টিঙ গেলেন সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার পরীক্ষা দিতে। কিন্তু বিধি বাম। সব কিছুতে ঠিকঠাক ভাবে উতরে গিয়েও শেষ পর্যন্ত দূর্বল দৃষ্টিশক্তির কারণে আটকে গেলেন তিনি। চোখে চশমা থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অনুপযুক্ত বিবেচিত হলেন বান্টিঙ।
সেনাবাহিনীতে আর যোগ দেওয়া হলো না তাঁর। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে না পারাটা, নিজের ব্যর্থতা বলেই মনে করছেন বান্টিঙ। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে না পারার ব্যর্থতায় মানসিক ভাবে বেশ খানিকটা মুষড়েও পড়লেন তিনি। বিষন্ন মনে ফিরলেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে, চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ শেষ করতে। কিন্তু মন মানে না। আহতদের সেবা করার এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হলো তাঁর! আফসোস যেন রয়েই যাচ্ছে মনের ভিতরে।
বিধি বোধহয় বামে ছিলেন না বান্টিঙের। মাস দুয়েক বাদেই জানতে পারলেন, নতুন পর্যায়ে আবার লোক নেওয়া হচ্ছে সেনাবাহিনীতে। সুযোগ! আবার সুযোগ এসেছে তাঁর সামনে। আবার চেষ্টা করবেন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য। অক্টোবর ১৯১৪, আবার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরীক্ষা দিতে গেলেন বান্টিঙ। এবারও সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন তিনি। কিন্তু হায়! এবারও সেই একই ফল জুটল তাঁর কপালে। দূর্বল দৃষ্টিশক্তির কারণে আবারও বাতিল বলে গণ্য হলেন তিনি। দু দু’বার পরীক্ষায় পাশ করেও শেষ মুহূর্তে এসে আটকে গেলেন তিনি। এ যেন তীরে এসে তরি ডুবল তাঁর।
একরাশ ব্যর্থতা আর বিষন্নতা নিয়ে ফের পড়াশুনার জগতে ফিরলেন বান্টিঙ। নিজের ব্যর্থতায় কান্না পাচ্ছে এখন তাঁর। ভেজা দু’চোখে তখনও প্রবল জেদ। সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেনই তিনি। তাঁর স্বপ্নকে কিছুতেই এভাবে ধূলিস্যাৎ হতে দেবেন না তিনি। আর সত্যি সত্যি, আবার সুযোগও এলো তাঁর কাছে। মাস পাঁচেক পর, ১৯১৫ সালের বসন্ত কালে খবর পেলেন, আবার সেনা নিয়োগ চলছে। দেরি করলেন না বান্টিঙ। দ্রুত যোগাযোগ করলেন তিনি। কী আশ্চর্য, সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবার কিন্তু তিনি নির্বাচিত হলেন সেনাবাহিনীতে। নির্বাচিত হলেন সেনাবাহিনীর শিক্ষানবিশ ‘প্রাইভেট’ হিসেবে। খুব খুশি আজ বান্টিঙ। আহতদের শুশ্রূষা করার স্বপ্ন সফল হতে চলেছে তাঁর। কয়েক মাস পর, গ্রীষ্মের ছুটিতে, ‘নায়াগ্রা ফলস’এর ধারে এক প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিতে বলা হলো তাঁকে। এক বুক উদ্দীপনা নিয়ে সেই সেনা শিবিরে যোগ দিলেন বান্টিঙ। প্রশিক্ষণ অন্তে তাঁকে সার্জেন্ট পদ দেওয়া হলো। দেওয়া হলো সেনার পোষাকও। খুব, খুব, খুব খুশি হয়েছেন বান্টিঙ। তাঁর স্বপ্ন যেন পূরণ হলো এবার।
খুশিতেই আছেন বান্টিঙ। সেনার পোষাক পড়ে আজ বেশ গর্বিত তিনি। বেশির ভাগ সময়েই এখন সেনাবাহিনীর পোষাক পড়েই থাকেন তিনি। রোচের সাথে দেখাও করেন এই পোষাক পরেই। উপরের চিত্রই তার নিদর্শন। এই পোষাক পড়লে, গায়ে যেন একটা শিহরণ খেলে যায়। গর্বে যে বুকটা ভরে যায় তাঁর। গর্ব করার মতো আরো ঘটনা ঘটলো তাঁর জীবনে। ইওরোপ থেকে যুদ্ধ ফেরৎ আহত সেনাদের চিকিৎসার জন্য ডাক পড়ল তাঁর। টরন্টোর এক আর্মি হাসপাতালে ডিউটি পড়ল বান্টিঙের। সকালে কলেজ করে রাতে ‘নাইট ডিউটি’ দিতেন বান্টিঙ। এই অতিরিক্ত কাজের চাপে এতটুকু ক্লান্তি বোধ করতেন না তিনি। বরং তিনি খুশিই আজ। খুশি এই কারণে, তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা আহত সেনাদের সুস্থ করতে পেরেছেন তিনি। হাসপাতাল থেকে ‘রিলিজ’ করা হয়েছে সেই সমস্ত সুস্থ হয়ে উঠা সেনাদের। আহত সেনাদের শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলার স্বপ্ন অবশেষ সাকার হলো তাঁর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, সামরিক পোষাকে। মুখে তৃপ্তির হাসি। |
মেডিক্যালের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র হিসেবে এবার আউটডোর ডিউটি পড়ল বান্টিঙের। ‘হসপিটাল ফর সিক চিলড্রেন’এ ডা. ক্লারেন্স লেসলি স্টারের অধীনে আউটডোরও সামলাচ্ছেন এখন বান্টিঙ। ১৯১৬ সালের গ্রীষ্মকাল, পঞ্চম বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রদের জন্য এক বিশেষ পাঠ্যক্রম ঘোষণা করলো টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগ। এবার আর যুদ্ধ ফেরৎ সেনাদের চিকিৎসা নয়, একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে ডিউটি দেওয়ার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে নতুন পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে। তার মানে এবার সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে শুশ্রূষা করা! এ তো আরো ভালো খবর। এমন একটা সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন বান্টিঙ। তাহলে আর দেরি কেন? উৎফুল্ল মনে সেই কোর্সের জন্য নিজের নাম লিখিয়ে এলেন তিনি।
অক্টোবর ১৯১৬, ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন বান্টিঙ। ৯ই ডিসেম্বর ১৯১৬, সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না হলেও অকৃতকার্য হন নি তিনি। সম্মানের সাথেই পাশ করেছেন ডাক্তারি শাস্ত্র। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এম.বি. ডিগ্রি লাভ করলেন বান্টিঙ। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যথা নেই তাঁর। রেজাল্ট যা হওয়ার, হয়েছে। ওটা নিয়ে অতো ভাবছেন না তিনি। তিনি খুশি অন্য কারণে। পরদিন, ১০ই ডিসেম্বর, সকালেই, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন তিনি। লেফটেন্যান্ট পদে নির্বাচন করা হয়েছে তাঁকে। ভীষণ, ভীষণ খুশি আজ বান্টিঙ। সর্বতো ভাবে সাফল্যের দিন আজ তাঁর। আজই তিনি ডাক্তারি ডিগ্রী অর্জন করলেন আর আজই তাঁর স্বপ্নের শিবিরে যোগ দেওয়ার নির্দেশও পেলেন তিনি। আর আজ তাঁর পাশে আছেন প্রেমিকা রোচ। তাঁর সমস্ত স্বপ্ন যেন সত্যি হলো আজ। আজ তিনি পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষদের এক জন। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়লেন বান্টিঙ। মনে মনে ভাবছেন, শল্যবিদ্যাটা [সার্জারি] ভালো করে একবার ঝালিয়ে নিতে হবে তাঁকে। ওইটাই বেশি কাজে লাগবে যুদ্ধক্ষেত্রে।
(চলবে)
[১৩] প্রসঙ্গত ডাক্তারি পড়ার সময়ে, বান্টিঙের ক্লাসমেট ছিলেন নর্মান বেথুন (১৮৯০-১৯৩৯)।