মিনিয়াপোলিসের ওরফিল্ড ল্যাবরেটরি। মাইক্রোসফ্টের অ্যন-ইকোইক চেম্বার। যেখানে শব্দমাত্রা শূন্যেরও নিচে। -20 ডেসিবেল। অর্থাৎ শব্দহীন স্থান। এ আমার আপনার দুঃস্বপ্নেরও বাইরে। হ্যাঁ, আমি দুঃস্বপ্ন কথাটা খুব ভেবেচিন্তেই লিখলাম।
আমি নিজে নিঃশব্দ পিয়াসী। শহরের শব্দদূষণ আমার সহ্যাতীত। কেবলমাত্র দুটি পয়সার লোভে এখানে পড়ে আছি- যেখানে ভোর চারটের সময় লোহার খড়ম পরে’ ট্রামগাড়ি চলতে শুরু করে। রাত দুটো অবধি চলে রিকশার ঠুনঠুন, গাড়ির ঘড়ঘড় ভ্যাঁপোঁ, আর মানুষের চিৎকার। তবু মিনিয়াপোলিসের নৈঃশব্দ আমার দুঃস্বপ্ন।
ওখানে ঢুকলে আপনি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটা ড্রাম পেটানোর আওয়াজ পেতে শুরু করবেন। ওটা আপনার হার্টবিট অর্থাৎ হৃদস্পন্দনের শব্দ। প্রফেসর শঙ্কুর মরুরহস্য পড়েছেন? গ্রীক জীববিজ্ঞানী হেক্টর ডিমিট্রিয়াস একটা ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন। যেটাতে একজন মানুষ বড় হতেই থাকে। মরুভূমিতে গিয়ে এই ওষুধ উনি প্রয়োগ করেছিলেন। বাড়তে বাড়তে উনি এ্যাতো বড়ো হয়ে গেছিলেন যে ওনার নাকের মাপ হয়ে গেছিলো পিরামিডের সমান। তখন ওনার হৃদস্পন্দন বহুদূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। সেই রকম, এক্ষেত্রে আপনি আপনার হৃদস্পন্দন ড্রামের শব্দের মতো শুনতে পাবেন।
মনে রাখবেন আপনি ফিসফিস করে কথা বললেও সেটার পরিমাপ প্রায় তিরিশ ডেসিবেল। সুতরাং পরের শব্দ হচ্ছে আপনার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ- সেটা মনে হবে আদ্যিকালের স্টিম ইঞ্জিন চলছে। তারপর আসবে আপনার পেটের কলকল শব্দ- বহতা নদীর মতো ধীর, গম্ভীর। এরপর আসবে ঝর্ণার শব্দ- সেটা আপনার ধমনীতে রক্তপ্রবাহ।নড়লেন নাকি? ঐ শুনুন আপনার হাড়ে হাড়ে ঘর্ষণের আওয়াজ। মাইক্রোসফ্টের আহ্বানে এ পর্যন্ত একজন সব থেকে বেশী পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঐ ঘরে থাকতে পেরেছিলো। কিন্তু সে ততক্ষণে ভুলভাল কথা বলছে এবং অপ্রাকৃতিক বস্তু দেখতে পাচ্ছে (hallucination)।
তাহলে সাধারণ সময়ে এই শব্দগুলো কোথায় থাকে?
সবই থাকে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের কিছু কিছু জায়গা ওদের অন্য শব্দের থেকে পরিশ্রুত করে দ্যায়। এটাকে বলে অডিটারি সেন্সরি গেটিং(ASG)। তাহলে এবার জানা যাক কারা এই অডিটারি সেন্সরি গেটিংএর কাজ করে এবং হিয়ারিং এইডের সঙ্গে এইসব অপ্রাসঙ্গিক কথার যোগাযোগ কোথায়?
আমাদের মস্তিষ্কের থ্যালামাস, অডিটারি কর্টেক্স, আর অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম একযোগে এই কাজটা করে।
ধরুন আপনি সিনেমা দেখছেন- পাশের দম্পতি বাদাম খাচ্ছেন, ফ্যানের ঘোরার শব্দ হচ্ছে, চেয়ারে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হচ্ছে। এখন থ্যালামাস আপনি কি দেখছেন সেটা অনুয়ায়ী শব্দকে অডিটারি কর্টেক্সে যেতে দ্যায়। অর্থাৎ সিনেমা মন দিয়ে দেখলে আর বাকি শব্দ ঢুকবে না। ঠিক তেমনই আপনি উত্তেজিত থাকলে সিম্প্যাথেটিক নার্ভগুলো উত্তেজিত থাকবে। এরা আবার থ্যালামাসের এই কর্তৃত্ব নষ্ট করে দেয়। ফলে প্রতিটা শব্দই মাথায় আঘাত করবে এবং আপনি এগুলো নিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠবেন।
তেমনই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহু শব্দ ফিল্টার হয়ে যায়। রেস্তোরাঁয় ঢুকলে ক্রমশঃ অন্যদের কাঁটাচামচের শব্দ, কচরমচর চিবোনোর শব্দ, হাহাহিহির শব্দ মিলিয়ে আসে। নিজেদের কথায় এবং খাওয়ায় মন দিতে পারেন।
যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে কম শোনেন তাঁরা এই সব শব্দগুলো শুনতেই পান না সুতরাং থ্যালামাস এই কাজ করার ওভ্যেসটাই হারিয়ে ফেলেছে। যেই মুহূর্তে হিয়ারিং এইড লাগালেন সেই মুহূর্ত থেকে সমস্ত শব্দ আপনার মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে যেতে লাগলো। অডিটারি সেন্সরি গেটিং ব্যাপারটাই থ্যালামাস ভুলে গেছে। যিনি হিয়ারিং এইড লাগিয়েছেন তাঁর কানে জুতো মশমশ, চামচের টুংটাং, টেবিলে খাওয়ার পাত্র টানা সব শব্দই অত্যন্ত তীব্র হয়ে ঢুকবে। হয়তো রাস্তার গাড়ির হর্ন, ফেরিওয়ালার চিৎকারও ওনাকে পাগল করে দেবে। উনি ‘দূর্হোগ্গে’ বলে টান মেরে যন্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। বলা যায় না চিৎকার চ্যাঁচামেচিও করতে পারেন।
ওনাকে ঘটনাটা বোঝাতে হবে। অডিটারি সেন্সরি গেটিং তৈরি হতে অন্ততঃ চারমাস সময় লাগবে, সুতরাং হে ভ্রাতুষ্পুত্র/ভ্রাতুষ্পুত্রী চারটে মাস ধৈর্য ধরতে হবেই। তারপর অবাঞ্ছিত শব্দরা বিলীন হয়ে আসবে। তখন আবার স্বাভাবিক শ্রবণ। এবং উত্তেজনা করলে এই অটোনমিক নার্ভগুলো বেয়াক্কেলে ব্যবহার করে পরিস্থিতি আরও ঘোরঘোরালো করে দেবে। শান্ত থাকুন। ধৈর্য ধরুন। যতটা সম্ভব বেশীক্ষণ হিয়ারিং এইড পরে’ থাকুন।
(মনে রাখবেন পন্ডিত যে কাজে ভয় পায়, মূর্খ সেই কাজে অবলীলায় নেমে পড়ে। আমার অবস্থাও সেইরূপ। নির্জ্ঞান, নির্বোধ তাই সব কিছুতেই খগরাজ সম অতুল নাসিকা গলিয়ে ফেলি। ক্ষমাপ্রার্থী দীপঙ্কর)