🩸🩸রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাস: মেডিসিন না মার্ডার? পর্ব ২

রক্তই নাকি আত্মার প্রকৃত আশ্রয়স্থল (Old Testament) । দ্বিতীয় শতকে ধারণা হলো আত্মা থাকে লিভারে (Galen)। পরবর্তীতে শোনা গেল আত্মা বসত করে ব্রেনে (Descartes)। ব্রেনের একেবারে গভীরে হয়তো যেখানে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড থাকে। আবার কেউ কেউ বললেন ব্রেনের যে ফাঁকা জায়গায় জল ভরা থাকে সেখানে অর্থাৎ ভেন্ট্রিকলে। কিন্তু আত্মা কি সাকার না নিরাকার? প্রাণীদেরও কি আত্মা আছে। প্রাণীর রক্ত মনুষ্য শরীরে প্রবেশ করালে আত্মা কলুষিত হবে না তো! বা এক শরীরে দুই আত্মা?! এইসব প্রশ্ন ধাওয়া করে বেড়াচ্ছিল বিজ্ঞানীদের। তবে ক্রিস্টোফার রেন, রিচার্ড লোয়ার, টিমোথি ক্লার্ক, রবার্ট হুক, রবার্ট বয়েল এর মতো তরুণ গবেষকরা তাতে দমে না গিয়ে চালিয়ে গেলেন তাঁদের পরীক্ষা নিরীক্ষা। বদলাতে থাকলো ধারণা।

আগের পর্বে বলেছিলাম প্রাণী সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ইংল্যান্ডের সাফল্যে ফ্রান্স তখন ঈর্ষান্বীত। তারাও বসে থাকার পাত্র নয়। 1666 সালে অক্সফোর্ডে প্রফেসর রিচার্ড লোয়ার দেখিয়েছিলেন দুটি কুকুরের মধ্যে সফল রক্ত সঞ্চালন। ইংরেজরা কুকুর থেকে কুকুরে সফল সঞ্চালন করতে না করতেই ফরাসি চিকিৎসক জাঁ ব্যাপটিস্ট ডেনি (Jean Baptiste Denis) সেরে ফেললেন বিড়াল থেকে কুকুরে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষণমূলক গবেষণা। দুটি প্রাণীই নাকি জীবিত ছিল। বলে রাখা ভালো “দাতা” হিসেবে সে সময় বিজ্ঞানীদের প্রথম পছন্দ ছিল প্রাণীকূলের সদস্যবৃন্দ। কারণ তারা আবেগহীন(!), মদ্যপান করে না এবং অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করে। ফলে তাদের রক্ত ছিল অধিকতর খাঁটি।

সমালোচকদের চোখে “কপিক্যাট” ডেনি এবার বন্ধুত্ব পাতালেন সার্জেন Paul Emmerez এর সাথে। উদ্যেশ্য মানুষের শরীরে সঞ্চালন। এমারেজ আসলে ছিলেন একজন নাপিত। সেকালে নাপিতরা শুধু ছোটখাটো কাটাকাটি করতেন বললে ভুল হবে। কখনও কখনও তাঁরা পাগলামির চিকিৎসাও করতেন। সে আমলে ধারণা ছিল মস্তিস্কে পাথর জন্মালেই মানুষ পাগলামি করে। মাথার খুলি ছ্যাঁদা করে সেই পাথর বের করতেন দক্ষ নাপিতরা। বড় বড় সার্জারি করলেও তাঁদের নামের আগে Doctor উপাধি বসতো না। তাঁদের বলা হতো Barber surgeon। তাঁরা Mister ই থেকে যেতেন। সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে! এখনও FRCS পাশ করেই বিলেতে সার্জেনরা Dr উপাধি ঝেড়ে ফেলে আবার সসম্মানে Mr লিখতে শুরু করেন।

গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে এবার আসি মানুষের শরীরে প্রথম সঞ্চালনের গল্পে। 1667 সাল। স্থান ফ্রান্স। বছর পনের ষোলোর একটি ছেলের জ্বর কিছুতেই ছাড়ে না। বেঘোরে ভুল বকছে। ডেনির মনে হল ছোকরার মাথাটাও বিগড়েছে। ভুল বকছে। ওকে ঠান্ডা করা দরকার। চঞ্চলমতি বালকের মাথা ঠান্ডা করার জন্য শান্তশিষ্ট ভেঁড়ার রক্তের চেয়ে ভালো দাওয়াই আর কী হতে পারে। রাজিও করিয়ে ফেললেন তার পরিবারকে। পয়সাকড়ি দিতে হয়েছিল কিনা সঠিক জানা নেই। ভোর ভোর তার বাড়ি পৌঁছে গেলেন ডেনি-এমারেজ। রক্তদাতা কচি ভেড়াটির সাথে তাকে ব্লীড করানোর জন্য এক কসাই। ঘুম থেকে উঠে গেলে ছোকরার রক্ত আরও গরম হয়ে যেতে পারে বলেই এরকম সময় নির্বাচন।

প্রায় ন’ আউন্স (ধরে নিন হাফ পাঁইট) রক্ত নেওয়া হলো প্রাণীটির গলার ধমণী থেকে। একটি ধাতব টিউব দিয়ে সে রক্ত চলে গেল সরাসরি ছেলেটির হাতের শিরায়। প্রথম দিকে হাত বেয়ে গরম কিছু উঠছে মনে হলেও শীগগির তার শরীর ঠাণ্ডা হলো এবং ডেনির ভাষায় “peace overcame him.” রাতারাতি নাকি ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থও হয়ে উঠেছিল। অন্ততপক্ষে ডেনি সেরকমটাই দাবি করলেন। তার আগে দুমাস ধরে ছেলেটাকে ব্লীড করানো হয়েছে। শিরা কেটে নয়। দফায় দফায় কুড়ি বার ওর গায়ে জোঁক বসিয়েও কোনো লাভ হয় নি।

দ্বিতীয় পেশেন্ট পেতেও দেরি হলো না ডেনির। কিছু পয়সার বিনিময়ে রাজি হয়ে গেলেন স্থানীয় এক কসাই। শোনা যায় ওই ছেলেটির ওপর প্রথম রক্ত সঞ্চালনের সময় ইনিই ডেনিকে সাহায্য করেছিলেন। পেশাগত কারণে তাঁর রক্ত আদান প্রদানে ভয়ডর কমই থাকার কথা। ভদ্রলোক রক্ত নিলেন এবং লাফিয়ে উঠে সদ্য মরা ভেড়াটিকে বগলদাবা করে বাড়ি চলে গেলেন। কসাই ভদ্রলোককে ঠিক কি কারণে ব্লাড দিতে হয়েছিল জানা নেই তবে কচি কাঁচাদের রক্তপান করে রোগ নিরাময় বা যৌবন পুনরুদ্ধারের গল্প শোনা গেছে। যেমন ধরুন Pope Innocent VIII (1492) এর সেই কাহিনী। চিকিৎসকের পরামর্শে তিন তিনটি দশমবর্ষীয় বালকের রক্তপান করে সুস্থ হবার চেষ্টা করলেন। বাচ্চাগুলো তো মারা গেলই নিজেও প্রাণে বাঁচলেন না। Innocent পোপই ই বটে!

ডেনি যখন ভেড়ার রক্ত চালিয়ে জ্বর সারানোর জোরালো দাবি রাখছেন সেই সময় ইংল্যান্ডের চিকিৎসকেরা একই ভাবে রক্ত দিয়ে পাগলামি সারতে পারে বলে দাবি করলেন। উদ্যোগী পুরুষ ডেনিও ফ্রান্সে এই একই এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলেন মহ’য়া (Mauroy) নামে এক পাগলের ওপর।

মহ’য়া বেশ বাজে রকমের পাগলামি করছিল। রক্ত গরম হয়ে গেলে নাকি মানুষ ওরকমই করে। তাই তাকে ঠান্ডা করতে পরিকল্পনা মাফিক দেওয়া হলো ভেঁড়ার রক্ত। প্রথম দিন তার সহ্য হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিনও সে কোনোরকমে মানিয়ে নিল। ডাক্তারবাবুরা দাবি করলেন মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। পাগলামিও কমেছে। কিন্তু ক’দিন পরেই উপসর্গ আবার ফিরে আসায় তৃতীয় দফা সঞ্চালনের ব্যবস্থা করতে হলো। কিন্তু সে দিন আর রক্ষে হলো না। প্রথমত হাতে বা পায়ে কোনো শিরা থেকেই আর রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। সবগুলোই শুকিয়ে কাঠ। কোনো রকমে খুঁজে পেতে সামান্য রক্ত বের করতে না করতেই মহ’য়ার প্রবল খিঁচুনি শুরু হল। পর দিনই সে মারা গেল। মহ’য়ার স্ত্রী পেরিন (Perrine) বেজায় চটলেন। ডেনি ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা ময়না তদন্তে উদ্যত হলে পেরিন তাঁদের পত্রপাঠ বিদায় দিলেন এবং তড়িঘড়ি মৃত স্বামীকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। মহ’য়া মরলেও গল্পের নচে গাছটি এখানে মুড়লো না। পুরো গল্পটা শুনলে যে কেউ হয়তো বলবেন মার্ডার কেস। কিন্তু কিভাবে?

সমকালীন চিকিৎসক সমাজ এমনিতেই ডেনির ওপর চটে ছিলেন তাঁর বেপরোয়া ভাব, অতিরিক্ত আত্মপ্রচার এবং ইংরেজদের কপিক্যাট হওয়া ইত্যাদির জন্য। স্থানীয় প্রশাসন খুনের মামলা আনলো। দীর্ঘ শুনানিতে বেশ কয়েকটা চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এল। পেরিন স্বীকার করে নিলেন যে প্রথম দুটি সঞ্চালনের পরও মহ’য়া বেশ কয়েকবার ক্যাবারেতে গেছেন। সেখানে “মাথাব্যথা ছাড়াতে” মদ্যপান করেছেন। শুধু তাই নয় বাড়িতে এই ক’দিনে পেরিনের সাথে চার চারবার বিছানাতেও গেছেন। ডাক্তারবাবুরা কিন্তু পই পই করে বলে দিয়েছিলেন শেষের এই কম্মোটি না করতে। কারণ ওতে রক্ত গরম হয়। আর পুরো চিকিৎসার উদ্দেশ্যই তো ছিল একজন উন্মাদের রক্ত ঠাণ্ডা করা! শুধু তাই নয়। পুলিশ এবং প্রতিবেশীদের তৎপরতায় পেরিনের বাড়ি থেকে কিছু সন্দেহজনক পাউডারও পাওয়া যায়। আসলে সেগুলো ছিল আর্সেনিক সমৃদ্ধ ইঁদুর মারা বিষ। পেরিন দিনের পর দিন তাঁর দীর্ঘদিনের অত্যাচারী স্বামীর পানীয়ে সে পাউডার মেশানোর কথা স্বীকার করে নেন। স্ত্রীর হাতে ইঁদুর মারা বিষ শুনেই যে সমস্ত পাঠক লাভ-র‍্যাট এর তল্লাশি চালাবেন তাঁদের জন্য গল্পে অন্য ট্যুইস্ট! পেরিনকে দিয়ে একাজ করিয়েছিলেন ডেনির প্রতিপক্ষ চিকিৎসকরা যাতে তাকে অপদস্থ করা যায়।

যাইহোক শুনানি শেষে প্যারিস আদালত Chatelet ডেনিকে সে যাত্রায় খুনের মামলা থেকে রেহাই দেয়। কিন্তু রক্ত সঞ্চালনসংক্রান্ত সবরকম গবেষণা সে দেশে নিষিদ্ধ করে দেয়। অতএব 1668 সালে থমকে গেল রক্ত সঞ্চালনের ধারাবাহিক ইতিহাস। শুধু ফ্রান্সে নয়। অজ্ঞাত কারণে গোটা ইউরোপে এবং ইংল্যান্ডেও বন্ধ হয়ে গেল এই গবেষণা।

এদিকে বৃটিশ রয়্যাল সোসাইটি বসে থাকার পাত্র নয়। হাজার হোক তাঁরাই ছিলেন রক্ত সঞ্চালন গবেষণার পথিকৃত। মানুষ থেকে মানুষে প্রথম সফল রক্ত সঞ্চালনের কৃতিত্ব হয়তো সে দেশেরই প্রাপ্য ছিল। আর ঠিক সেটাই ঘটলো। পাক্কা দেড়শো বছর পর 1818 সালে লন্ডনে প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞ জেমস ব্লানডেল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণরত এক সদ্যপ্রসবার (Post Pratum Haemorrhage) শরীরে তাঁর স্বামীর রক্ত দিলেন। নতুন ইতিহাস রচিত হলো। এ যাত্রায় সফল হলেও মনে রাখতে হবে তখনও কিন্তু দাতার শরীর থেকে বের করে রক্তকে কিভাব তরল রাখতে হয় তখনও জানা ছিল না। রক্তের গ্রুপও আবিস্কৃত হয় নি। এই স্বামী- স্ত্রীর ব্লাড গ্রুপ আলাদা হলে কিন্তু ফল হতে পারতো ভয়ানক।

অ্যান্টিবায়োটিক্সও আসেনি আমাদের হাতে।

একবার ভাবুনতো দেড়শ’ বছর ধরে গ্রুপ না জেনে, ক্রস ম্যাচ না করে রক্ত দিলে কত মানুষের প্রাণ যেত! সেদিক থেকে দেখতে গেলে প্যারিস আদালতের রায় যে কত লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই।

এক দু’বার সফল রক্ত সঞ্চালনের পরে পরেই সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ বোঝা গেল শরীরের বাইরে এনে রক্তকে তরল রাখা। জমাট প্রতিরোধী কোনো ওষুধ (anti coagulant) তখনও বেরোয় নি। অতএব খোঁজ শুরু হলো বাইরে জমাট বাঁধে না এরকম বিকল্পের যা রক্তের বদলে দেওয়া যাবে। সবচেয়ে জনপ্রিয় হল দুধ। গো-জাতি তথা গো-দুগ্ধপ্রীতি যে শুধুমাত্র নব্য সঙ্ঘীদের একচেটিয়া হক তা ভাবলে ভুল হবে। ঐতিহাসিকভাবে তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতেও গো-প্রীতির অভাব ছিল না। কানাডায় আবিস্কৃত হয়ে গণেশের দুধ খাওয়ার খবরের মতো বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লো এই প্র্যাকটিস। তবে প্রত্যাশা মতো বেশিদিন টিকলো না। প্রায় সব জায়গাতেই ভয়ানক পার্শ্ব প্রতিক্রিযার ঠেলায় বন্ধ হয়ে গেল। আমেরিকার কথা অবশ্য বলতে পারবো না। সে দেশে এখনো প্লাস্টিক সার্জেনরা গায়ে জোঁক লাগিয়ে দিলেও (Leech therapy) শুনেছি মেডিক্লেম পাওয়া যায়।

যাইহোক ইতিমধ্যে নর্ম্যাল স্যালাইনও হাতে এসে গেল।

আজ এখানেই থামতে হচ্ছে। পরের দিন নীল-সাদার গল্প শোনাবো। একটু মমতা দিয়ে শুনবেন।

সবশেষে সুখবর। পরের পর্বে শেষ।

চিত্রঋণ: গুগল

চিত্রসূত্র:
1. Jean Baptiste Denis (1635-1704): 1st transfusion from animal to human
2. James Blundell (1790-1878): 1st human to human transfusion

তথ্যসূত্র:
Holy Tucker: Blood Work- A Tale of Medicine or Murder in the Scientific Revolution

H. A. Oberman: Early History of Blood Substitutes, Transfusion of Milk

Wikipedia
Podcasts