🩸🩸🩸 রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাস: মেডিসিন না মার্ডার? শেষ পর্ব

লম্বকর্ণ ক্যাপ্টেন স্পক (Star Trek) এর রক্তের রং সবুজ। আরশোলার রক্ত সাদা। কিন্তু নীল রক্ত কাদের? প্রথমেই মনে আসতে পারে রাজা উজিরদের কথা। কিন্তু একটা সময় অধিকাংশ সাদা মানুষজনও তাই মনে করতেন। চামড়ার নিচে নীল শিরা না দেখা গেলে তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়তেন না। তাই বলে ব্লাড ব্যাঙ্কেও বর্ণবৈষম্য! হ্যাঁ ঠিক তাই।

উনিশশো চল্লিশের দশকে আমেরিকার ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোতে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরী হয়। ওদেশের রেড ক্রশ সোসাইটি চিকিৎসার স্বার্থে আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের রক্ত নিতে অস্বীকার করে। যুদ্ধক্ষেত্রে পর্যন্ত সৈনিকেরা দাতার গায়ের রং জানতে চান। কালো মানুষের রক্ত শরীরে নেওয়ার বদলে নাকি মরে যাওয়াও শ্রেয়। দু’ দশক ধরে চলে এই রক্ত-রেস (blood race) বিতর্ক। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে।

“কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবার সমান রাঙা…..”
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি ভিতরে সবার সমান রাঙা হলেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ কিছু তফাৎ আছে। সব মানুষের রক্ত অভিন্ন নয়। সেখানে আছে বিভিন্ন গ্রুপ।

মানব শরীরে প্রথম সফল মনুষ্যরক্ত সঞ্চালনের (1818) পর আট খানা দশক পেরিয়ে গেছে রক্তের গ্রুপ চিনতে। 1901-এ অষ্ট্রিয়ার প্যাথোলজিস্ট চিকিৎসক কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার (1868-1943) তাঁর ল্যাবেরই বাইশ জন সহকর্মীর রক্ত নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে দেখলেন কিছু কিছু সময় একজনের রক্ত আর একজনের রক্তকে জমাট বেঁধে দিচ্ছে। অর্থাৎ সবার রক্ত একই ধরণের নয়। আবিস্কৃত হলো রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ। এক ধাপে রক্ত সঞ্চালন হয়ে উঠলো অনেকখানি নিরাপদ। শুরুতে ল্যান্ডস্টাইনার বলেছিলেন তিনটি গ্রুপের কথা- A, B এবং C, পরের বছর জানা গেলো AB গ্রুপের কথা। C গ্রুপটি পরে নতুন নাম পায় O-গ্রুপ হিসেবে। জার্মান ‘Ohne’ (without) থেকেই O-এর নামকরণ। বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি বিস্ময়কর আবিষ্কারই আমাদের জীবনের মান বাড়িয়েছে কিন্তু ল্যান্ডস্টাইনারের যুগান্তকারী কাজ সরাসরি অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচালো। রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারের জন্য নোবেল প্রাইজ পেলেন 1930 সালে।

রক্তের গ্রুপ লিখতে গেলেই দেখবেন প্লাস বা মাইনাস লিখতে হয়। এটি আমাদের রীসাস (Rhesus) গ্রুপ। 1940-এ ছাত্র ওয়াইনার (Weiner) এর সাথে একজোটে ল্যান্ডস্টাইনার আবার দেখালেন রীসাস মাঙ্কির রক্তে থাকা বিশেষ প্রোটিন (Antigens) অধিকাংশ মানুষেও থাকে। তখন থেকে আমরা শুরু করলাম A, B, O এবং AB লেখার পরে রীসাস অ্যান্টিজেন থাকলে প্লাস আর না থাকলে মাইনাস লিখতে।

আগেই বলেছি সংগ্রহের সামান্য সময় পর থেকেই রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। তাকে আটকানো একটা বড় চ্যালেন্জ। ফরাসি চিকিৎসক অ্যালেক্সিস ক্যারেল দেখালেন দাতার ধমণীর সাথে গ্রহীতার শিরার সরাসরি সংযোগ স্থাপনের (anastomosis) পদ্ধতি। তাতে শরীরের বাইরে না আসায় রক্ত জমাট বাঁধার প্রশ্নও আসে না। ক্যারেল নোবেল প্রাইজও পেলেন 1912 সালে। কিন্তু প্রতিটি সঞ্চালনের আগে এত কাটাকাটির ঝক্কি কে নেয়! তার সাথে উভয়েরই শরীরে সংক্রমনের আশঙ্কা। কতটা রক্ত দেওয়া হল তার মাপও পাওয়া যায় না। অতএব বেশিদিন টিকলো না এই দাতা-গ্রহীতার মধ্যে anastomosis পদ্ধতি। শুরু হলো বিভিন্ন রাসায়নিকের প্রয়োগ। প্রথমে সোডিয়াম ফসফেট, তারপর সিট্রেট এবং তারও পরে ডেক্সট্রোজ ইত্যাদি যোগ হতে থাকলো। সঞ্চালনের আগে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার চ্যালেন্জ মোকাবিলা করা গেলো।

আজকাল রক্ত সঞ্চালন যে যথাসম্ভব নিরাপদ হয়েছে তার জন্য বড় কৃতিত্ব প্রাপ্য আধুনিক ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির। প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে ব্রিটিশ রেড ক্রস সোসাইটির তত্বাবধানে। সে ছিল 1921 সাল। বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতেও তখন বিজ্ঞানচর্চা তুঙ্গে। 1932 এ তারা প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক গড়ে তোলে লেনিনগ্রাদ হাসপাতালে । ঘটনাচক্রে কয়েক বছরের মধ্যেই লেগে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রয়োজন হয় অসংখ্য রক্ত দাতার। স্বভাবতই UK, USA সহ বিভিন্ন দেশে বাড়তে থাকে ব্লাড ব্যাঙ্কের সংখ্যা।

এখন হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজনীয়তা কমেছে কিন্তু বিভিন্ন জটিল অপারেশন তথা জীবনদায়ী আধুনিক চিকিৎসায় রক্তের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। রক্ত সঞ্চালন নিয়ে গবেষণা অবশ্যই চলছে এবং চলবেও। আজকাল আর সংগৃহীত রক্ত (whole blood) রোগীকে সেই অবস্থাতেই দেওয়ার চল্ খুব কমে গেছে। আধুনিক গবেষণা আমাদের শিখিয়েছে রক্তের বিভিন্ন উপাদান আলাদা আলাদা ভাবে আরো কার্যকরী উপায়ে কিভাবে চিকিৎসার কাজে লাগানো যায়। এখন এক ইউনিট ব্লাড মাত্র একজনেরই কাজে লাগে তা নয়। বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন গ্রহীতার উপকারে লাগে।

রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাস যেমন সুদীর্ঘ তেমনই নাটকীয়। সংক্ষেপে তিনটি পর্বে কিছুটা বলার চেষ্টা করলাম। ভালো লাগলে জানাবেন। না লাগলে আরো বেশী করে জানাবেন। ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্র:
1. British Journal of Hematolog: The History of Blood Transfusion, Dec 2001
2. NHS, UK information on history of blood transfusion

চিত্রসূত্র:
1. Karl Landsteiner: রক্তের বিভিন্ন গ্রুপের আবিস্কর্তা
2. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে স্বেচ্ছায় রক্তদানের আবেদন