টাটা কোম্পানীর এসএমএস প্যাক থেকে এসমেস করেছিলামঃ কিরে কেমন আছিস?
পাক্কা তিন মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড এর মাথায় উত্তর আসেঃ ব্লাড গ্রুপ আর দু চারটে বাল্যের বন্ধু ছাড়া সব কিছুই নেগেটিভ।
বুঝলাম মালটা ছন্দে আছে। ফোন করলাম। সেসময় ফোন করতে মিনিটে একটাকা লাগতো। তবুও।
কিরে খুব ফর্মে দেখছি।
অন্তু সেকথার উত্তর না দিয়ে বল্ল। নেক্সট শনিবার আসবি?
বুঝলাম কিছু প্ল্যান ফেঁদেছে বন্ধুবর। তবু দাম বাড়াই। দেখি..।
খট করে কেটে দেয় অন্তু। এক মিনিট দু সেকেন্ডে। শালা দু সেকেন্ডের জন্য পুরো মিনিটটা গেল। তাই পঞ্চাশ টা এসএমএস এর থেকে চুয়াল্লিশ নম্বরটা খরচ করি। কিরে মহাকেশ, ফোনের টাকাটা কি তোর পিতৃদেব দেয়? যে খপাত করে কাটলি।
উত্তর আসে ভাট না বোকে শনিবার চলে আসিস। ভালো একটা ব্যাপার আছে।
ব্যাপারটা কি মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি বিদেশী সিগারেট কিংবা প্লে বয়-এর অরিজিনাল ধার করা কপি। আমাদের কয়েকটা উপোসী হাড় হাভাতে অতিবদ পাব্লিক-এর জন্যে সে এসব যত্ন টত্ন করে রেখে দেয়। আমরাও দেখি । উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে ইসস কি অবস্থা ইসস কি অবস্থা বলি। তারপর সবটা শেষ হলে তাচ্ছিল্যে ফেলে, অচ্ছুত হবার অভিনয়ও করি। যেন অন্তুর জন্যই আমাদের স্বযত্নে লালিত এযাবৎ ভালোথাকা গুড ইমেজ গুলি একে একে উৎখাত হয়ে যাচ্ছে।
অন্তু খিঁচিয়ে ওঠে এসব ক্ষেত্রে। শালা যোগ্য জিনিসের দাম দিতে শেখ। তোমাদের দৌড় তো বট তলার চটি কিংবা ক্যালকাটা টাইমস।
আমরা এসব এঞ্জয় করি। অন্তু খিস্তি দেয়। সহ্য করি। কারণ চোখে খেলে কানে সয়। অতএব। কাজে কাজেই।
ফার্মার আইটেমটা আইঢাই উগরে দিয়ে চটপট পাঁচটা বরোর শান্তিপুর ধরি। সাড়ে সাতটার মফস্বলের স্টেশনে তখন সন্ধ্যা নিবুনিবু। ভীড় খুব একটা নেই। দু একটা দোকানদার চা বিক্রি করছে। সারাদিনের বেচা কেনার হিসেব করছে ধীর স্থির হকার। তার বিড়ির গন্ধ, চা গরম করার পাম্প স্টোভের হু স স্..আলো আঁধারিতে ঘটিগরমে-এর মায়াবী ধোঁয়ায় সে এক ঘোর ঘোর অস্ফুট বাড়ি ফিরে আসা। এমনিতে এমন কিছুই নয়। শনিবার ফিরলে রবিবার সকালটা অন্তু, পিকু, সৈকতদের সাথে ভাট হবে। খুচরো আড্ডার পরই হু স্ স্ করে বিকেল। আবার সাত টা দশের কৃষ্ণনগর ধরে হোস্টেল। তবুও আসতাম। প্রথম প্রথম বইও আনতাম সাথে। একদিন গুছিয়ে দিতে দিতে বাবা বল্ল, মানে বলেই ফেল্লঃ ব্যাগ ভারী করে এসব আনলে ঘাড়ে ব্যথা হবে বাবা। ওগুলো তুমি হোস্টেলেই রেখে এসো। নিতান্ত ঘাড়ের কাছে এক্সাম টেকজাম নিশ্বাস না ফেললে সেই থেকে পিতৃ বচন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। মাক্কালি।
কিন্তু কেন আসতাম? হোস্টেল মানে অবাধ স্বাধীনতা। হুল্লোড়। আড্ডাবাজ লোকের অভাব সেখানেও নেই। তবুও পাঁচদিনের কলকাতা জীবনে কেমন একটা পালাই পালাই লাগতো শনিবার এলেই। বাড়িতে ছিলনা কিছুই। ধ্যাড়ধ্যারে গ্রাম, আর সন্ধ্যে সন্ধ্যে বাড়ি ফেরার হুকুম, এইসব নিয়ম, সন্ধ্যার নির্জনতায় সাইকেল দাঁড় করিয়ে শেষ ফোঁটা আড্ডা চেখে নেওয়া অন্তুদের সাথে, এইসব লোভ ডেকে আনত সপ্তাহান্তে। রাত্রি বেলা হেঁটে যেতে যেতে কথা হত পরিচিত কারোও সাথে। পথ চলতি। খুচরো খাচড়া। তুমি মাস্টারের পুলা না?
তা তুমার বিষয়ডা কি? মানে কি নিয়া পড়তাছো?
তাদেরকে এম বি বি এস-এর বিষয় বোঝানো মুস্কিল। তবুও কথা হত। টর্চ জ্বেলে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিত কেউ। এইসব জড়ানো মরানো বিরক্তি ভালোবাসা, অন্ধকার, বৃষ্টি রাত্রির ঝিঁঝি ডাক সম্মোহনের মত ডাকতো। শনিবার এলেই।
কয়েকদিন আগের কথা। লক ডাউনের প্রথম সপ্তাহ কেটে গেছে। টিভিতে টিভিতে নিউজ চ্যানেলে করোনা গুষ্টি বিশ্লেষণ চলছে চড়বরিয়ে। মানুষ জন ভয়ে ভয়ে আছে। আবার বাইরে বেরিয়ে পুলিশের গুঁতোটুতোও খাচ্ছে। চেম্বার শেষ করে বাইকের চাবি খুঁজছি অ্যাপ্রনের পকেটে পকেটে। তখনই দেখা পুলিশ অফিসার অশোকবাবুর সাথে। তিনিই শোনালেন এক পরিযায়ী শ্রমিকের গল্প।
না ঠিক গল্প নয়। এক্কেবারে সত্যি একটা ঘটনা। একজন শ্রমিক মেদিনীপুর থেকে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে যাচ্ছিল বাড়ি। মালদায়। বীরনগর অবধি এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মেদিনীপুরে তার ঘুরে ঘুরে হকারি। দীর্ঘদিন। সেখানেও নিশ্চই কিছুটা পরিচিতি আছেই। তবু কেন তার ঘরে ফেরার তাড়া! কেনও এত ঝুঁকি। সেকি শুধুই করোনার আতঙ্ক, খিদের জ্বালা কিংবা প্রিয়জনের পিছুটান? খিদে তো বাড়িতেও আছে। এ ফেরা তো অন্যবারের মত নয়। ….ব্যাগ হাতে হাসতে হাসতে নামা বাসষ্ট্যান্ডে। …দরদাম না করেই সরবতি লেবু, কয়েকটা বেদনা কিনে আনা।… নিকোনো উঠানে হঠাৎ করে বাবা এসেছে বাবা এসেছে ।… এবারের ফেরা তো সে রকম কিছু নয়। কিছুই তো স্থির ছিল না দুদিন আগেও। সস্তার স্মার্ট ফোনে কদিন আগেও বায়না করেছে পুঁচকেটা। ইবার কিন্তু আমার রিমোট গাড়ি আইনবে। আইনবে কিন্তুক। রাত গভীর হলে খুনসুটি করেছে পুঁচকের মা। সক্কলের জৈন্যই তো আইনছো। আমার কুথা তুমার মনেও থাইক্যে না। ফোনের ও প্রান্তে শুয়ে তেলচিটে বালিশটা জড়িয়ে ধরে সেও বলেছিল: কেনে.. তুমার জইন্যে তো আমিই আইসবো। কিন্তু হঠাৎ করে পাল্টে গেছে পৃথিবীর নিয়ম। সে এসেছে। নিঃস্ব। কোনও সম্বল নেই। সে হাঁটছে। মানুষের দয়া, ভিক্ষা এসবের ভরসা সে করেনি। এসব তার উপুরী পাওনা। সে আসলে হেঁটে চলেছে তার বাড়ি, ক্ষুদে ক্ষুদে বাবা এসেছে ..প্রতিবেশীর সান্নিধ্য, উঠোনের বাতাবি গাছ এসবের লোভে। ঘাড়ের পাশে এসে পড়া মহামারীর সামনে প্রিয় মানুষদের নিয়ে জড়াই মরাই বেঁচে থাকার লোভে। পরিচিত পৃথিবীর নিশ্চিন্ত টুকুর লোভে। হোক না সে ছোট্ট, অপাঙতেয় । তবু ।পরিচিত পৃথিবী টা টানে। বিশেষত বিপদের দিনে। হোস্টেলে জ্বর হলে যেমন কলকাতা ছেড়ে ছুটে চলে আসতাম বাড়ি। ডাক্তার শুন্য ধ্যার ধ্যেরে গ্রামে। পরম নিশিন্তে।
বন্ধুদের অনেকেই এখন ভিনদেশী। বাড়ি আসলে আড্ডা হয়। গল্প হয়। করোনা সময়ে তাদের ঠিক নেই আসার। আজকাল ভিডিও কলে দূরত্ব অনেক কম। কিন্তু কাজের বাইরে এসএমএস লাস্ট কবে করেছি মনে নেই।
হসপিটালে নাইট ডিউটির ফাঁকে হটাৎ ই অন্তুর ফোনঃ কিরে কেমন আছিস!
‘ব্লাড গ্রুপ আর বাল্যের বন্ধুরা ছাড়া সব কিছু নেগেটিভ..’
আর করোনা..? অন্তুর সপ্রতিভ প্রতিপ্রশ্নের সামনে অনর্থক চুপ করে থাকি। পরিযায়ী শ্রমিকদের মত হাঁটতে থাকি… বাড়ি ফেরার রাস্তায়…
এ্যাতো পরিণত লেখা কমই পড়তে পাই । ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু । ভালো থাকুন ।
ভালো লেখা।