নদীর জলে শুধু জাহাজই ভাসে না, কচুরিপানাও ভেসে যায় ভাঁটার টানে। সাথে অনেকটা মন খারাপও।
আমাদের আশেপাশে পাহাড় নেই, জঙ্গল নেই, সমুদ্র নেই, মোহময় মেঠো পথ নেই। আছে শুধু বারবার খোঁড়া মধ্যমগ্রাম সোদপুর রোড নামে একটি সরকারি পরীক্ষামূলক খোঁড়া রাস্তা। সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের কোথাও পিচের রাস্তা তৈরি হলে সোদপুর রোডের কিছুটা পিচ তুলে ফেলে সেই পিচ দিয়ে আগে পরীক্ষা করা হয়।
আর আছে প্রতি বাতি-স্তম্ভ পিছু গোটা ছয়েক মাইক। সন্ধ্যে বেলায় খোকা খুকুরা পড়াশুনো শুরু করলেই একসাথে সবকটা মাইক কেউ চালিয়ে দেয়। ছাত্র ছাত্রীদের মনঃসংযোগ তুঙ্গে তোলার এমন আন্তরিক প্রচেষ্টা অন্য কোথাও হয় বলে জানা নেই।
আছে একঘেয়ে সকাল, দুপুর, রাত্রি, একঘেয়ে খুপরি, একঘেয়ে জ্বরের রোগী। একঘেয়েমির থেকে আমাকে দু-দণ্ড শান্তি দেবে এমন বনলতা সেনও নেই।
শুধু যখন সবকিছু অসহ্য লাগে দুই খুপরির মাঝে ঘন্টাদেড়েক সময় পেলে চলে যাই গঙ্গার ধারে। শুকচরের বারো-মন্দির অথবা পাশের নির্জন নীহারিকা ঘাটে। চুপচাপ বসে থাকি, ঘাটে বসে মানুষ দেখি।
হাজার রকমের মানুষ। এতো ভ্যারাইটিস মানুষ আর দেখা যায় সরকারি হাসপাতালে। কারো কারো তাড়া নেই। চুপচাপ চেয়ে রয়েছে গঙ্গার দিকে। কেউ কেউ ভয়ানক ব্যস্ত। ফোনে একে ওকে ধমকে চলেছে। একজোড়া ছেলে মেয়ে আবার পাশাপাশি বসে জগৎসংসার ভুলে গেছে। মেয়েটির মাথা ক্রমশ ছেলেটির বুকের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের এতো কাছে গিয়েও কি হৃদয় চেনা যায়?
ঘাটের দেওয়ালে নানা রঙে আঁকিবুঁকি- লেখা। মানব+ তনিমা, ভিকি+ পায়েল, তাপু+ শানু। অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় যৌন আকাঙ্ক্ষার কথা লেখা। তাঁর নিচেই গোটা গোটা অক্ষরে কেউ লিখেছে- মা তুমি যেখানেই থেকো ভালো থেকো। ভালোবাসা, মোহ, কাম, মায়া মমতা সব মিলে মিশে একাকার।
মন পঁচিশ বছর পিছিয়ে যায়। আমি আর সুমনদা সেসময় মাঝে মধ্যেই বিকালে যেতাম কমলেশ জেঠুর বাড়ি। কবি কমলেশ পাল। উনি তখন বসুনগরে একটা দোতলা বাড়িতে থাকতেন। আমি তখন ক্লাস ইলেভেন। চুপচাপ কবি কণ্ঠে কবিতা শুনতাম-
”লোকে পাখি পোষে।
আমি পুষি ভালোবাসা বুকের খাঁচায়।
উনত্রিশ বছর ধরে সে কেবলই ডেকে যাচ্ছে
সর্বক্ষণ নিরর্থ ভাষায়।
আমি বলি: ভালোবাসা, যাকে ডাকছো
সে কি শুনতে পায়?
সোমা ঘোষ! ঠিকানা বদল করে
তুমি আজ সোমা বসু রায়।
তবু ছিন্ন ফোটোখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে
গোপন তোরঙ্গে আজও রাখি।
ভালোবাসা পুষি আমি, লোকে পোষে পাখি।”
সেই অদ্ভুত বয়স থেকে আমার একটা ধারণা হয়ে গেছে ভালো কোনো কিছু পেয়ে যেতে নেই। পেয়ে গেলেই সেই ভালো লাগা নষ্ট হয়ে যায়। পেয়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে সাবধানে এতোবছর বেঁচে আছি।
বেশ ভালো লাগে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে যা পাইনি সেই সব স্মৃতি রোমন্থন করতে। কতো মানুষ- যাদের এক সময় আত্মার আত্মীয় মনে হতো তাদের সাথে বহুদিন যোগাযোগ নেই। হয়তো ফোন করা যায়। কিন্তু ফোন করে কী বলব? তোর কথা খুব মনে পড়ছে- তুই কেমন আছিস? অতি নাটকীয় শোনাবে না?
অথবা সেটাই স্বাভাবিক ছিল। আমরাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি গুলিতে সভ্যতার প্রলেপ লাগিয়ে সংস্কৃতিবান হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। এই নিয়ে আরেকদিন গভীর চিন্তাভাবনা করতে হবে। আপাতত আমার সময় শেষ। আবার গিয়ে খুপরিতে ঢুকব।
দাঁড়িয়ে প্যান্ট থেকে ধুলো ঝাড়ছিলাম। হঠাত একটা দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। একটি সদ্য নেড়া ছেলে বয়স তেরো চৌদ্দ হবে- বেচারার মা বা বাবা কেউ মারা গেছে। ঘাট কাজ সারতে এসেছে। ছেলেটি এক বয়স্ক মহিলাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছে। দৃশ্যের মধ্যে একটাই অসংগতি- বয়স্ক মহিলাটির পোশাক আশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি মুসলিম ধর্মের। তাঁর পাশে যে বয়স্ক পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছেন তারও মাথায় ফেজ, গালে সাদা দাড়ি, পরনে ফতুয়া লুঙি। কে জানে এঁরা বাচ্চা ছেলেটির কে হন। তবে সব কৌতূহল মেটাতে নেই।
আরেকবার তাকিয়ে হেলমেট পরলাম। খুপরির বেশ দেরি হয়ে গেছে।