~এক~
শহরের একদা অভিজাত উচ্চ-মধ্যবিত্ত পাড়ার বাড়িটা আজ খালিই পড়ে থাকে প্রায়। একসময়ে সে বাড়ির মালিক ছিলেন ভুবনব্রত মুখার্জি — ব্যবসায়ী বলেই তাঁকে জানে পাড়ার লোকে, কিন্তু কী ব্যবসা, তা কেউ ঠিক বলতে পারেনি। থাকতেন স্ত্রী, ছেলে, আর একজন আশ্রিতা এবং আশ্রিতার ছেলে নিয়ে। খুব যে গমগমে বাড়ি ছিল, তা নয়, কিন্তু লোকজনের যাতায়াত ছিল, পালপার্বণে মুখার্জিগিন্নী পাড়ায় আসতেন — দুর্গাপুজোয় ঠাকুরবরণ তো করতেনই। পাড়ার বয়োঃজ্যেষ্ঠরা, প্রধানত কমলকুমারবাবু, এ সব খবর দিয়েছেন। আশ্রিতা মহিলা কে, সে নিয়ে ধন্ধ রয়েছে পাড়ার লোকের মনে। কেউ বলেছে ভুবনব্রতবাবুর বোন, কেউ বলেছে শালী। সধবার পোশাকেই থাকতেন, কিন্তু তাঁর স্বামীকে কেউ কোনও দিন চোখে দেখেনি, কানাঘুষোয় শোনা — হারিয়ে গেছিলেন, তারপরে কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
বড়ো ছেলে দীপব্রত যখন শিশু, তখন একটা পুরোনো বাড়ি কিনে, সেটা আপাদমস্তক রেনোভেট করে থাকতে এসেছিলেন ভুবনব্রতবাবু। ছেলে যখন বছর তিন, বা চার, তখন আগমন সেই আশ্রিতা আর ছেলের। দুটি বাচ্চা প্রায় সমবয়সীই। এই ছেলেটিই ভুবনব্রতবাবুর ছোটো ‘ছেলে’ পরাগব্রত। বোধহয় দত্তক নিয়েছিলেন মুখার্জি দম্পতি। কেউ পরিষ্কার জানে না। আসলে খুব বেশি যাওয়া-আসা-মাখামাখি কারওরই ছিল না। ওরা নিজেদের মতোই থাকত। নামের মিল থেকে দত্তক নেওয়ার ব্যাপারটা আন্দাজ করা যায়।
একে একে মারা যান প্রথমে মুখার্জি গৃহিণী, তারপর সেই আশ্রিতা। সবশেষে ভুবনব্রতবাবু। শেষ কয়েক মাস প্রায় কোনও জ্ঞানই ছিল না। হুঁশ তো ছিল না-ই — এ কথা জানা গেছে স্বয়ং ভুবনব্রতর ডাক্তারবাবুর কাছে।
তিনজন মা-বাবা-মাসি, অথচ ছেলে দুটোর বিয়ে-থা হয়নি। আসলে মুখার্জিগিন্নী যখন চলে গেলেন, তখনও ওদের বিয়ের বয়েস হয়নি, আর ভুবনব্রতবাবুও সাংসারিক বিষয়ে মাথা ঘামাননি কোনও দিন। ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকতেন। দূরসম্পর্কের সেই শালী, বা বোন… একে অসুস্থ, তায় অতীব গ্রামীণ। বহু বছর শহরে থেকেও মোটে সাব্যস্ত হননি। বাড়ি থেকেও বেরোতেন না একেবারে। প্রথম বছর দুর্গাপুজোয় মুখার্জিগিন্নীর সঙ্গে সিঁদুর খেলতে এসেছিলেন। তখনই সকলের চোখে পড়েছিল ওঁর গ্রাম্য আচার-আচরণ। এতই হাসাহাসি হয়েছিল পাড়ায়, যে কানাঘুষোয় সে খবর পেয়ে মুখার্জিগিন্নী বোনকে… না কি ননদকে?… আর বেরোতেই দিতেন না। এ সব কারণেই গার্জেনদের মৃত্যু অবধি ছেলেদের বিয়ে হয়নি। আর তাঁদের অবর্তমানে ছেলেদুটো তো একেবারেই বখে গিয়েছিল। চলাফেরা হাবভাব কোনওটাই বলার মতো ছিল না, কাজকর্ম কখনও করেছে কি না কে জানে। বাড়িতেই যখন মেয়ে নিয়ে আসা শুরু হল তখন কারও কারও মত ছিল — কিছু একটা প্রতিবাদ অন্তত হওয়া উচিত। মাতব্বররা ধরেছিল কমলকুমারবাবুকেই, কিন্তু উনি ঘাড়ে বন্দুক নিতে রাজি হননি। পাড়ার কাউন্সিলরও ওদের বন্ধু, থানার ওসি-ও। এক গেলাসের ইয়ার। বাড়িতে যাদের আনাগোনা, তাদেরও দেখলে পাড়ার লোকে থমকে রাস্তা পেরিয়ে যেত। ওরা ফেরত ঝামেলা করলে পাড়ায় বাস করাই সমস্যা হতে পারত। ফলে দুই ছেলের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে কোনও বাধা পড়েনি।
তবে পর পর, কয়েক মাসের মধ্যে, এক এক করে দুই ছেলেই উধাও হয়ে যায়। বড়োজন হারিয়ে যায় সেই ভয়াবহ আম্ফান ঝড়ের রাতে, ডেডবডি পাওয়া যায় কয়েকদিন পরে শহরতলির কোথায় যেন। সে মৃত্যু-রহস্যের সমাধান হয়নি। ছোটো ছেলেটা যায় কয়েক মাস পরে। প্রায় বছর ঘুরতে গেল, তার কোনও হদিশই নেই এখনও। দু-ভাই-ই নাকি মাঝরাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল, ফেরেনি। বড়োভাইয়ের বেলা ছোটোটা পুলিশে গেছিল, খোঁজ পাবার পরে গাড়িটা নিয়ে ফিরেছিল… ছোটোভাইয়ের বেলা পুলিশে ডায়রিই হয়নি। করবেই বা কে? বাড়িতে এখন তো কেবল ওই মেয়েটাই থাকে — ভাইয়েরা যাবার আগে শেষ কয়েক মাস যে ওদের সঙ্গে থাকত। মেয়েটা কে, জানা যায়নি। পাড়ার লোকেরা কেউ ভাবে ও বড়োছেলের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে এসে বড়োটির মৃত্যুর পর ছোটোজনের…
অবশ্য দু-ভাই চলে যাবার পরে তাকে-ও বাইরে দেখা যায় না বড়ো একটা। না, বাজার-টাজার করে না কেউই, সুইগি আর জোম্যাটো-ই খাবার নিয়ে আসে দুবেলা। পয়সাকড়ি কোথায় পায় কে জানে…
তবে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ছোটোভাইয়েরও কিছু খোঁজ করেছে, কারণ বড়োভাইয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু। ঝড়ের রাতে মফস্বলে নিজের বাড়ির চৌহদ্দিতেই গাছ ভেঙে পড়ে মারা যায়। কিন্তু সে কেন আম্ফানের মতো অমন ভয়ানক ঝড়ের রাতে, যার প্রকোপে পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, দমকল জাতীয় সরকারি সব পরিষেবাও তুলে নেওয়া হয়েছিল, গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল তা জানা যায়নি। ফলত, ছোটো ভাই-ও যখন তার পরেই একদিন রাতে গাড়ি নিয়েই উধাও হয়ে গেল, তখন পুলিশের ভুরু আপনিই কুঁচকেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, যে এই আধার-কার্ড, প্যান কার্ড, আর আধার-লিঙ্কড ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের যুগেও, লোকটা যে কেবল উবে গেছে তা নয়, গাড়িটাও হাওয়া। কমলকুমারবাবুর নেতৃত্বে পাড়ার লোকজন সদলবলে থানায় গেছিলেন, মেয়েটার বিষয়ে কিছু করা যায় কি না জানতে। তখনও পুলিশের স্বরূপ দেখে চুপচাপ ফিরে এসেছেন তাঁরা। কোন বাড়িতে একলা কে অল্পবয়সী মহিলা থাকেন, সে দিকে পাড়ার বয়োঃজ্যেষ্ঠদের অহেতুক কৌতুহল নিয়ে তারা তামাশা করে ওঁদের চুপ করিয়ে দিয়েছে। বাড়িতে ‘নানাবিধ’ পুরুষ-সমাগম হয় জানতে পেরে জিজ্ঞেস করেছে, ক-জন? দুটি করে সব মিলিয়ে চার, বা ছ-জন এবং তারা কেউ দেখতে ভদ্রলোকের মতো নয় শুনে বলেছে, তাদের আচার-আচরণে কোনও অভদ্রতা আছে কি? নেই। বলতে বাধ্য হয়েছেন সকলে। তবু পুলিশ ঘুরে গেছিল। মহিলা তাদের বলেন যে তিনি বড়ো ভাই দীপব্রতর বাগদত্তা ছিলেন, কিন্তু দাদা মারা যাবার পর ভাই তাঁকে থাকতে দিয়েছে। ভাই এখন নেই বটে, কিন্তু ফিরতেও পারে। তাই অপেক্ষা করছেন। দু-টি করে দারোয়ান বাড়ির নিচে ডিউটি করে, সবসুদ্ধ ছ-জন। পুলিশও তাদের দেখেছে। তারা কখনও বাইরে থাকে, কখনও নিচের তলায় বসার জায়গায় শুয়ে ঘুমোয়। ব্যাস। কোনও বেআইনি কিছু হচ্ছে বলে মনে হয়নি। আশ্চর্য, অদ্ভুত — কিন্তু বেআইনি নয়।
~দুই~
রিপোর্ট যে পড়ছিল, সে ফাইল বন্ধ করে মুখ তুলে তাকাল। টেবিলের চারপাশে অন্য মুখগুলো একেবারেই ভাবলেশহীন, নিথর। দেখতে দেখতে নব্যযুবকটির মুখ থেকে আত্মপ্রসাদের হাসিটা শুকিয়ে গেল। কয়েক দিন ধরে অনেক খেটে, বহু লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে তৈরি করা রিপোর্টটা ওর মনে হয়েছিল সম্পূর্ণ। কিন্তু যাদের রিপোর্ট দেওয়া, তারা তো মনে হচ্ছে খুশি নয়।
টেবিলের একপ্রান্তে যে গোঁফওয়ালা অবাঙালী প্রৌঢ়টি বসেছিলেন, দৃশ্যত তিনিই অবিসম্বাদী দলনেতা। এতক্ষণ চোখ বুজে শুনছিলেন, এখন অর্ধনিমীলিত চোখে বললেন, “আগে বোলো।”
থতমত খেয়ে যুবকটি পাশে বসা সিড়িঙ্গে রোগা প্রৌঢ়টির দিকে চাইল। তিনি ছোটো করে হস্তসংকেত করে বললেন, “সিংজী, রিপোর্ট তো বাস ইতনা হি…”
দাঁতের ফাঁকে ‘ছিক্’ করে একটা শব্দ করে সিংজী অস্ফুটে একটা বিশ্রী গালাগালি দিয়ে প্রৌঢ়টিকে উদ্দেশ্য করে হিন্দি-সুরে বাংলায় বললেন, “ই সব ফালতু খোবোর জুগাড় করে এনেছে তুমহার গোয়েন্দা? এই মুরোদ! ও কি ভাবছে এই বেকার ইনফোরমেশনের জন্য ওকে আমরা ফি দেব? ঘর ভেজো উসকো।”
এবার যুবকটির মুখমণ্ডল আরক্ত হল। সামনে ঝুঁকে পড়ে কিছু বলতে যাবে, পাশে বসা প্রৌঢ়র হাত পড়ল হাঁটুর ওপর। চোখের ইশারায় ওকে উঠতে বলে, নিজেও সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন ঘরের বাইরে। লিফটের সামনে যুবকটি অসহিষ্ণুভাবে বলল, “এটা কীরকম হল, ছোটোমামা! তুমি বললে ফ্যামিলিটা সম্বন্ধে পুরোনো খবর জোগাড় করতে। আমি তো তা-ই করলাম।”
প্রৌঢ় সান্ত্বনা দেবার মতো বললেন, “আহা, বুঝলি না, ছেলেটা অনেক টাকার মাল নিয়ে পালিয়েছে। তাই সিংজীরা আশা করেছিলেন তোর রিপোর্টে পরাগব্রত এখন কোথায় আছে তা-ও জানা যাবে। সেটা হয়নি বলেই আপসেট হয়ে গেছেন আর কী। তুই বাড়ি যা, আমি দেখছি।”
তীব্র অভিযোগের সুরে যুবক বলল, “আবার ফি-টাও দেবে না বলল।”
মামা নিজের পকেটে আঙুল ছুঁইয়ে বললেন, “তোর বিল তো আমার কাছে। ভাবিস না। আমি ব্যবস্থা করে দেব।”
কথা বলতে বলতেই মামা লিফটের বোতাম টিপেছিলেন। বাড়ির অভ্যন্তরে লিফট। সামনে অপেক্ষা করার জায়গা যত অল্প, লিফটের ভেতরটাও ততই অপরিসর। ভাগ্নেকে সঙ্গে মামাও লিফটে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, পেছনে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক দশাসই চেহারার ব্যক্তি। লম্বায় তাকে ছ-ফুটের বেশি না বলে সাতফুটের কম বললে বুঝতে সুবিধে হবে। মুশকো জোয়ান। ডাম্বেল-বারবেল ভাঁজা চেহারা। প্রৌঢ় লোকটিকে সে বলল, “ওকিলসাব, আপ ওয়াপস অন্দর যাইয়ে। সিংজী বুলা রহা হ্যায়। ম্যায় ইনকো নিচে লে যাতা হুঁ।”
উকিলসাব — অর্থাৎ প্রৌঢ় মামা — বিনাবাক্যে রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ালেন। বিশালদেহী লিফটে ঢুকল। বিরাট দশাসই চেহারার চাপে গোয়েন্দা একেবারে কোনঠাসা। দরজা বন্ধ হবার আগে ভাগনের ভয়ার্ত দৃষ্টি মামার চোখ এড়াল না।
ঘরের ভেতরে সব আগের মতোই। সিংজী বললেন, “বৈঠো। বেকার তিন হফতা বরবাদ হুয়া।” সিংজীর উষ্মা উথলে উঠল পরাগব্রতর হদিস পাওয়া যায়নি বলে।
উকিলবাবু বললেন, “একটা রাস্তা এখনও আছে — তা হল গাড়িটার সন্ধান করা। আজকাল ফাস্ট-ট্যাগ ইত্যাদি হয়েছে, চট করে…”
“চুপ হো জাও, উকিলবাবু।” সিংজীর ঘড়ঘড়ে গলায় ধমকের সুর স্পষ্ট। “তুমহে জো কাম দিয়া গয়া হ্যায়, ও-হি করো।”
সুযোগ পেয়ে উকিল বললেন, “কিন্তু এই গোয়েন্দাকে তো পরাগব্রতর হদিস বের করার কাজ দেওয়া হয়নি। ওর কাজ ছিল অতীতটা ঘেঁটে দেখা। যদি তা থেকে কিছু পাওয়া যায়?”
“তো? কেয়া পাতা চলা তুমহে?”
“ওই যে বলল, পরাগব্রত হয়ত দত্তক নেওয়া?”
“তো?”
উকিলবাবু বললেন, “দত্তক নেওয়া হলে নিশ্চয়ই তার কোনও কাগজপত্র আছে? হয়ত তা থেকে কিছু পাওয়া যাবে…”
টেবিলের মাঝামাঝি বসা আর একজন মাঝবয়সী অবাঙালি বললেন, “অগর সাচমুচ এডোপটেড হ্যায়, তো।”
উলটো দিক থেকে একজন বলে উঠলেন, “সেটা কিন্তু হ্যায়।”
সকলে প্রায় চমকেই তাকালেন বক্তার দিকে। বেঁটেখাটো, নাদুসনুদুস, টাকমাথা বাঙালিটিকে দেখে মনে হয়, ইনি শার্ট-প্যান্ট-জামা-জুতো পরে টেবিলে না বসে যদি গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরনে মিষ্টির দোকানে ছানা-ক্ষীর ঠাসতেন, মানাত ভালো। সিংজী বললেন, “কোনটা কিন্তু হ্যায়, রবিবাবু?”
রবিবাবু বললেন, “দত্তক। সত্যি হ্যায়।”
টেবিলের চারপাশের সবার মুখে চাপা হাসি। সিংজী বললেন, “আপকো ক্যায়সে মালুম?”
রবিবাবু একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, “ও এক জামানা থা যখন আমি ভুবনব্রতকা পিছুমে খুব কাঠি দেতা থা। ওই সময়কা বাত হ্যায়, একবার ভুবনব্রতকা ঝি… মানে নোকরানি… উসকা ঘর ছোড়ে ভাগা। নোকরানি, ঔর ওই কী বোলতা, রাঁধুনি…” রবিবাবু হাত নেড়ে খুন্তি চালানোর ভঙ্গি করে বললেন, “ওই যে রান্না করতা হ্যায়।”
ঘরে বসা অন্যদের হাসি আর নিঃশব্দ নেই। বোঝা-ই যায়, যে তারা রবিবাবুর হিন্দি বলা খুবই উপভোগ করে। কিন্তু আজ সিংজীর মেজাজ তেতো। বললেন, “হাঁ, তো কেয়া হুয়া? আপ হিন্দি ছোড়কে বাংলা বোলো, রবিবাবু। হাম সমঝতে হ্যায়।”
রবিবাবুর ধারণা উনি ভালোই হিন্দি বলেন। বললেন, “তখনই তো হাম জানতে পারা থা। ও জো দুসরা লেড়কা, ওকে তো ভুবনব্রত দত্তক লিয়া থা। ও থা ওই অন্য মেয়েটার বাচ্চা। ওরা ওদের আত্মীয় টাত্মীয় নেহি থা। রাস্তাসে কুড়াকে লায়া থা। গরিবের মেয়ে বলে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, মেয়েছেলেটা ভুবনব্রতবাবুর ইয়ে ছিল, মানে বউ তো আর ভুবনব্রতকে স্যাটিসফাই করতে পারত না… ছেলেটাকে দত্তক নিয়েছিল, যাতে মেয়েটা কিছু ট্যাঁ-ফোঁ না করে।”
সিংজী জানতে চাইলেন, “ইয়ে সব তুমহার জানা ছিল কি?”
রবিবাবু বললেন, “হাঁ তো।”
“কভি বোলা নেহি?”
“কেউ তো কভি জিজ্ঞেস নেহি কিয়া…”
আবার সুযোগ বুঝে উকিলবাবু বললেন, “আমরা পরাগব্রতর পাস্ট্ নিয়ে আগে কখনও মাথা ঘামাইনি। এখন এই ইনভেস্টিগেটর বলল তাই…”
সিংজী বললেন, “হুঁ। তো উকিলবাবু, তুমি উখানে সব কাগজ, ফাইল, সব ছানবিণ করিয়েছিলে কি?”
ঘাড় নাড়লেন উকিলবাবু। পরাগব্রত নিরুদ্দেশ হবার পর এক বাণ্ডিল হীরের খোঁজে বাড়িটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে। এর চেয়ে ভালো করে খুঁজতে হলে ইঁট খুলে খুলে খুঁজতে হত। কিছু না-পাওয়া যেতে উকিলবাবুকে পাঠানো হয় কাগজপত্র খুঁজে দেখতে।
“উসমে দত্তক কা কাগজাদ নেহি থা?”
উকিলবাবু বললেন দত্তকের কাগজের কথা তো আলাদা করে বলা হয়নি, বলা হয়েছিল জমিজমা, প্রপার্টির কাগজ খুঁজতে — যদি অন্য কোথাও গিয়ে পরাগব্রত লুকিয়ে থাকে তার হদিস পাবার আশায়। যদিও সে-ও পাওয়া যায়নি কিছুই।
“ঠিক হ্যায়,” বললেন সিংজী। “ওয়াপস যাও। আচ্ছে সে ঢুণ্ডো। কুছ শায়দ হ্যায় নেহি, লেকিন ফিরসে ঢুণ্ডো। রবিবাবু?”
রবিবাবু বললেন, “হাঁ?”
“ওই মেয়েলোকটা আপনার কাছে এখনও কাম করে? ও বলতে পারবে না, পরাগব্রৎকা পাস্ট?”
“ও তো কভকে চলি গয়ী — উসকো খুঁজে পাওয়া সম্ভব নেহি হ্যায়।”
সিংজী ছাড়লেন না। বললেন, “খোঁজ করো, রবিবাবু। সোর্স লাগাও। ঘর কাহাঁ থা, মালুম?”
রবিবাবু একটু ভেবে বললেন, “এক্ষুনি মনে পড়ছে না। নামটা-ই মনে নেই হ্যায় ছাতা। কী যেন, মানসী… না মনীষা…”
সিংজী একটু হাসলেন। কোন বিষয় কার কতটা মনে থাকে সে সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান অনেক। বললেন, “ঠিক সে ইয়াদ করো, ইয়াদ আ জায়েগা।”
দরজা খুলে ঘরে ফিরল সেই বিশালদেহী। তার স্থান সিংজীর চেয়ারের পেছনে। সিংজী মিটিং শেষ করলেন। সকলে একে একে চেয়ার ছেড়ে ওঠা আরম্ভ করামাত্র বললেন, “উকিলবাবু বৈঠো।” ঘরের বাইরের ছোট্ট জায়গাটায় একসঙ্গে চারজনের বেশি দাঁড়াতে পারে না, লিফটের ভেতরে চারজনের দাঁড়ানোর জায়গা লেখা থাকলেও খুব রোগা না হলে তিনজনের বেশি উঠতে পারে না, তাই দরজাটা অনেকক্ষণ খোলা রইল। ক্রমে তিন-চার বার লিফট ওঠানামা করে বাইরের কথাবার্তার শব্দ মিলিয়ে এল। সিংজী বললেন, “আজ-হি যাও। কাগজাদ দেখো। ঠিক সে দেখনা। কাফি দিন হো গিয়া। সির্ফ দত্তক কা কাগজ নেহি। সব কাগজ দেখনা। কাহিঁ কুছ ভি অগর মিল যায়ে।”
উকিলবাবু উঠছিলেন, সিংজী বললেন, “নিচে রুকনা। লচমণ ভি যায়গা।”
বিনা বাক্যে উকিলবাবু বেরিয়ে গেলে পরে সিং বললেন, “লচমণ।”
বিশালদেহী চেয়ারের পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়াল।
“লাগতা তো নেহি হ্যায় কি ও লড়কা উস্ মকান মে ওয়াপস্ আয়েগা।”
এটা প্রায় স্বগতোক্তি। লক্ষ্মণ উত্তর দিল না। সিংজী বললেন, “ও লড়কি…”
“হাঁ, সরকার।”
“ওহাঁ বিঠাকে নেহি রাখনা ঔর। অয়সে তো কোই কাম কি নেহি নিকলি। ওহ্ রহতে হুয়ে ভি দোনো ভাই ভাগ গিয়া। সির্ফ্ বৈঠে বৈঠে দারু পিতি থি ঔর দোনো কা সাথ সোতি থি। বেকার খরচা বঢ়াকে ফায়দা কেয়া? মকান খালি করোয়া দো।”
“জি, সরকার। কহাঁ লে যায়ুঁ?”
সিংজী একটু চুপ করে রইলেন। লক্ষ্মণ বহু বছরের বিশ্বস্ত কর্মচারী। এই নৈঃশব্দের অর্থ জানে। তবু কিছু বলল না। অপেক্ষা করে রইল।
“কাহিঁ নেহি। মিটা দেনা। কিসিকো পতা না চলে।”
এই শেষ বাক্যটা বলার দরকার ছিল না। লক্ষ্মণ আজ পর্যন্ত কতজনকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই। কোনও ক্ষেত্রেই কেউ কিছু জানতে পারেনি।
“কিতনা আদমি হ্যায় পাহারা মে?”
“সব মিলাকে ছ আদমি। একসাথ দো রহতা হ্যায়।”
“সবকো ওয়াপস ভেজো। মকান বন্ধ করকে নিকলনা। ঔর ও টিকটিকি বোলা কি পুলিশ আভি ভি গাড়ি কা তালাশ মে হ্যায়। গাড়ি কা কোই নিশানা বাকি নেহি হ্যায় না?”
“নেহি, সরকার। সব খতম।”
“ঠিক হ্যায়।” হাত নেড়ে সিংজী লক্ষ্মণকে বিদায় দিয়ে নিজেও উঠে বাড়ির ভেতর গেলেন। পুলিশ পরাগব্রতর গাড়ি খুঁজে পায়নি, কারণ তারা তল্লাশি শুরু করার অনেক আগেই সিংজীর লোকজন পরাগব্রতর পাড়ার থানার পাশের গলিতেই গাড়িটা পায়। পার্ক করা ধুলি-ধুসরিত গাড়ি, বেশ কিছুদিন হল পড়ে ছিল ওখানে। দু-চারদিন সারাক্ষণের নজরদারির পরে একদিন প্রকাশ্য দিবালোকেই গাড়ি সারানোর ট্রাক পাঠিয়ে টেনে আনা হয়েছিল সিংজীর গ্যারেজে। প্রতিটা অংশ খুলে খোঁজা হয়েছিল কিছু লুকোনো আছে কি না। পাওয়া যায়নি কিছু, এবং সে গাড়ির কোনও অংশই আর অবশিষ্ট নেই। হয় অন্য গাড়িতে লাগানো হয়ে গেছে, নয়ত গলিয়ে ফেলা হয়েছে। পুলিশ সে গাড়ির হদিস আর পাবেই না।
~তিন~
সন্ধে হয়ে এসেছে। একা বাড়িতে এই সময়টা মিনির খুব মন খারাপ করে। কী হয়ে গেছে জীবনটা। শহরের সুপ্রতিষ্ঠিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, দেখতেও অতিশয় সুশ্রী, অভিনয় বা মডেলিং কেরিয়ারে উন্নতি অবধারিত — শুনে শুনে বড়ো হওয়া মিনির সেই রূপ, বা অঙ্গসৌষ্ঠব, কিছুই আর আগের মতো নেই। একটা দোতলা বাড়ির ওপর তলার একটা ঘরে কার্যত বন্দী। পড়াশোনা ছেড়ে ফুল-টাইম মডেলিং করতে চাওয়া নিয়ে বাড়িতে অশান্তি যখন তুঙ্গে, বার বার বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথাও ঠাঁই না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফিরে এসে মায়ের বকুনি আর বাবার মার খেয়ে খেয়ে যখন একেবারেই বীতশ্রদ্ধ, যখন প্রায় পাগলের মতো পথ খুঁজছে গ্ল্যামার জগতে স্থায়ীভাবে ঢোকার, তখনই সিংজীর সঙ্গে পরিচয়। সিংজীই বুদ্ধি দিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে পালিয়ে ওঁর হোটেলে গিয়ে থাকতে। বলেছিলেন একবস্ত্রে বেরোতে, সবই সিংজী দেবেন।
দিয়েওছিলেন। কেবল আশ্রয় নয়, অন্ন, বস্ত্র, সুখ, সঙ্গ — কোনওটারই অভাবই রাখেননি। শুধু দেননি কাজ। বা, বলা ভালো, যে কাজ মিনি চেয়েছিল, তা দেননি। প্রথমে কেবল সিংজীর ব্যক্তিগত ভোগের জন্যই বরাদ্দ ছিল মিনি। তারপর দু-চারজন অন্য লোক — সিংজীই পাঠাতেন। মিনিকে বলতেন, তারা মডেলিং কেরিয়ার তৈরি করে দেবে। এসব লাইনে কাজ পাবার আগে ওপরওয়ালাদের সন্তুষ্ট করতে হয়, জানত মিনি। কিন্তু কাজ পায়নি। সিংজীকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, হবে।
সব শেষে দীপব্রত। ওই একই টোপ দিয়েছিলেন সিংজী। মডেলিং কেরিয়ার। কিন্তু সেই সঙ্গে দীপের ওপর নজরদারি করে সিংজীকে মাঝে-মধ্যে খবর দিতে হবে। সবই হয়েছিল। দীপব্রত মুখার্জি খুবই সন্তুষ্ট ছিল, এবং দীপের কাজকর্ম, চলাফেরা সবই ওর মারফত জানতে পারতেন সিংজী। কিন্তু মিনির কোনও লাভ হয়নি। আজ অবধি কোনও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়নি মিনি, কোনও ফটোশুট হয়নি ওকে নিয়ে। মুখের কথাই সার — হচ্ছে, হবে। অনেকদিন আগেই মিনির চৈতন্যোদয় হয়েছে। এ জন্মে আর বিখ্যাত মডেল, বা হিরোইন কোনওটাই হওয়া হবে না। বয়েস হয়ত এখনও আছে, চেহারাটা আর নেই। ধস নামা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, যখন কার্যত বন্দীদশা শুরু হয়েছিল সিংজীর হোটেলের বিশাল স্যুইটে। চারবেলা পাঁচতারা হোটেলের ভূরিভোজ, রোজ সিংজীর দেওয়া বিলিতি চকলেট… তবু সেখানে একটা জিম ছিল, ট্রেনার ছিল। তারপর যখন ঠাঁই হল এই মুখার্জি-বাড়িতে, তখন থেকে তো তা-ও নেই। দীপব্রত মুখার্জি বলেছিল, একেবারে কাঠির মতো রোগা মেয়ে চাই না। জিরো ফিগারের যুগ শেষ। যদিও মিনি কোনও দিনই জিরো ফিগার ছিল না, তবু দীপব্রতকে খুশি করতে কিছু মেদ শরীরে জমতে দিয়েছিল। কিন্তু আজ…?
জোর করে বিছানা ছেড়ে উঠে মিনি মাটিতে বসে কয়েকটা যোগাসন করল। বড়ো, দোতলা বাড়িটায় মিনি একা। তা সত্ত্বেও চলাফেরা একেবারেই সীমিত। বেশিরভাগ সময় এ-ঘরেই থাকে। সিংজীর লোক দুজন করে সর্বক্ষণ নিচে থাকে পাহারায়। ওরা জানে মিনি সিংজীর। ওদের সাহস নেই মিনিকে কিছু করার, কিন্তু চোখ দিয়ে গিলতে থাকে সারাক্ষণ। মিনি ওর ভাগ্যকেই দোষ দেয়। বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর আগের প্রায় চার-পাঁচ বছরের অশান্তির জন্য দায়ী করে মা-বাবাকে। আর পাহারাদারদের চোখের আড়ালে থাকে। ওরা ওকে যেন সহজলভ্য মনে না করে।
~চার~
উকিলবাবু একতলায় অপেক্ষা করছিলেন কেউ সিংজীর নির্দেশ নিয়ে আসবে বলে। সাধারণত কাজের লোকেদের কারও মুখে নির্দেশ আসে, কখনও কপাল ভালো থাকলে গাড়ি পান একটা।
আজ কপাল ভালোর দিন, ‘লচমণ্ ভি জায়েগা’ — বলেছেন সিংজি। তবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে মারুতি ইকো ভ্যানটার দরজা খুলে লক্ষ্মণ যখন নিজেই ডাকল, “আইয়ে ওকিলসাব।” তখন অবাকই হলেন উকিল তারাশঙ্কর।
এই ভ্যানটা লক্ষ্মণ একাই চালায়। লক্ষ্মণের বিশাল বপু ধরানোর জন্য এর ড্রাইভারের সিট-টা নতুন করে লাগাতে হয়েছে প্রায় আট ইঞ্চি পিছিয়ে। এই গাড়িতে তারাশঙ্কর চড়েননি আগে। অন্য দিন যদি গাড়ি পান, তা চালায় ড্রাইভার, উনি পেছনে বসেন। আজ দোনোমোনো করে সামনে গিয়েই বসলেন। বললেন, “তুমি নিজেই যাচ্ছ।”
বক্তব্যের ঢঙে প্রশ্ন। লক্ষ্মণের কাছ থেকে এভাবেই খবর পেতে হয়। কিন্তু আজ লক্ষ্মণ নাক দিয়ে ঘোঁত করে একটা শব্দ করল কেবল। উকিলবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “ওই পরাগব্রতটা গেল কোথায় কে জানে! আজকের দিনে একটা লোক কী করে পুরো ভ্যানিশ করে যায়!”
লক্ষ্মণ গাড়ি চালাতে চালাতেই তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “কোথা আর গায়েব হোবে? ইখানেই আছে কোথাও ঘাপটি মেরে। হামার তো মনে হয় দুই ভাই-ই বেঁচে আছে। ওই বড়োভাইয়ের মরে যাওয়ার ব্যাপারটাও ঝুট হ্যায়।”
উকিলবাবু আঁতকে উঠলেন। “বলো কী! ওর তো ডেডবডি পাওয়া গেছে। পোস্ট মর্টেম হয়েছে… পুলিশ কেস ক্লোজ করে দিয়েছে…”
লক্ষ্মণের উত্তর শুনে তারাশঙ্করবাবু থতমত খেয়ে গেলেন। “হাঁ, হাঁ। সব শুনা হ্যায় ম্যায়নে। লেকিন ডেডবডি দেখা কৌন? সির্ফ পুলিস, না? ভাই ভি নেহি দেখা। কৌন জানতা হ্যায় বডি কিসকা থা? কৌন জানতা হ্যায় সচমুচ মর গিয়া কেয়া?”
উকিলবাবু ভাবতে বাধ্য হলেন। লক্ষ্মণ ঠিক বলেছে। দীপব্রত মুখার্জিকে বাড়ি থেকে বেরোতে কেউ দেখেনি। আম্ফানের পরদিন সকালে তার শয্যাসঙ্গিনী মিনি আর ভাই পরাগব্রত নাকি দেখেছিল দীপব্রত বাড়িতে নেই। পুলিশকে তা-ই বলে দু-জনে। প্রায় দু-সপ্তাহ পরে পুলিশ দুই-য়ে দুই-য়ে চার করে, যে শহরতলীর একটা বড়ি ভেঙে যাবার ফলে যে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল — পরদিন সকালে ভাঙা বাড়ির ইঁটকাঠের নিচ থেকে পাড়ার লোকজন যার মৃতদেহ উদ্ধার করে — সে-ই দীপব্রত। এই সিদ্ধান্তের প্রধান তিনটে কারণ — ওই বাড়ির মালিক ছিল দীপব্রত, বাড়ির বাইরে দীপব্রতর গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, আর মৃতের পরনে ছিল দীপব্রতর পোশাক। কিন্তু এ সব দু-সপ্তাহ পরের কথা। দীপব্রতকে কেউ দেখেনি, কারণ বেওয়ারিশ মৃতদেহ ততদিনে দাহ হয়ে গেছে। ভাই পরাগব্রতও লাশ দেখতে পায়নি। দু-সপ্তাহ পরে পুলিশের কাছে খবর পেয়ে থানায় গিয়ে মৃতব্যক্তির পোশাক দেখে বলে যে সেগুলো তার দাদারই বটে। ঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে যাওয়া শহর তখন কেবল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্বাভাবিক হচ্ছে, তা নয়, ভুললে চলবে না, কোভিড মহামারীও চলছিল। কারওরই কাজ কম ছিল না। একটা মৃতদেহ বেশিদিন ফেলে রাখার কোনও উপায়ই ছিল না। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে ছিল, মাথায়, মুখে এবং শরীরের অন্যত্র আঘাতজনিত কারণেই মৃত্যু, কিন্তু খুব মন দিয়ে কিছু খোঁজা হয়েছিল কি না কে জানে? ফাউল প্লে সন্দেহ করেছিল কেউ? না বোধহয়। করলেও, কোভিড জমানায়, সে প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের পরে কতটা মন দিয়ে ফরেনসিক ডাক্তাররা কাজ করতে পেরেছিলেন? ভেঙে পড়া বাড়ির ইঁট-কাঠের আঘাতে মৃত্যু ধরে নিয়েই রিপোর্ট লেখা হয়নি তো? আর ওদিকে দুই ভাই হয়ত কয়েক কোটি টাকার হীরে হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে এখন ঘাপটি মেরে বসে আছে!
অশিক্ষিত গুণ্ডা লক্ষ্মণ ছোকরার ওপর শ্রদ্ধা অনুভব করলেন তারাশঙ্কর। ছোটো ভাইয়ের ওপর সবার সন্দেহ হয়েছিল কারণ লোকটা কেবল রাতারাতি বেমালুম গায়েব হয়ে যায়নি, সিংজীর বিরাট সাম্রাজ্যের নানা চর খবর এনেছিল, ওর সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে অনেক দিন আগেই। দীপব্রত বেঁচে থাকতেই। দীপব্রতর তথাকথিত মৃত্যুর পরে — এখন তথাকথিতই ভাবছেন উকিল তারাশঙ্কর — জোরকদমে দীপব্রতরও অ্যাকাউন্টগুলোও খালি হয়ে যায়। পরাগব্রতর ওপর সন্দেহ গাঢ় হয় সেইজন্যই। এতদিন অবধি সবার ধারণা ছিল পরাগব্রতই কোনও ভাবে দাদাকে খুন করে মিনির চোখ এড়িয়ে, বা মিনির সাহায্যেই, মৃতদেহ ওখানে ফেলে এসেছিল। কিন্তু… উকিলবাবু ভাবলেন আবার… দীপব্রতর বেঁচে থাকতে আপত্তি কিসের? ওই দুই ভাইয়ের যা ক্যালি, একটা রাস্তার লোককে ঝড়বাদলের নামে আশ্রয় দিয়ে তাকে অনায়াসেই মেরে ফেলে ডেডবডি নিয়ে গিয়ে ভাঙা বাড়িতে ফেলে দিয়ে আসতে পারে। আবার লক্ষ্মণের প্রতি শ্রদ্ধা হল। এটা তো ওঁদেরই ভাবা উচিত ছিল। আর কারও না হোক, উকিলবাবুর নিজেরই ভাবা উচিত ছিল। জানতে চাইলেন, “এ কথা শুনে সিংজী কী বললেন?”
মুখার্জিবাড়ির খোলা গেটের ভেতরে গাড়িটা ঢুকিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দরজা খোলার আগে তারাশঙ্করের দিকে তাকাল লক্ষ্মণ। বলল, “ম্যায় কুছ নেহি বোলা। আপনি অওকাদ সে বড়কে ম্যায় কভি কুছ বোলতা ভি নেহি, করতা ভি নেহি।”
নিশ্চিন্ত। তাহলে কোনও সময়ে বক্তব্যটা সিংজীর কাছে উকিলবাবুই পেশ করতে পারবেন। তবে তার আগে কিছু হোমওয়ার্ক করতে হবে।
বাড়ির ভেতরে, একতলার বসার ঘরে সোফায় পা তুলে বসে টিভি দেখছিল সিংজীর দুই কর্মচারী। দেখতেও চোয়াড়ে গুণ্ডার মতো, এবং করেও গুণ্ডামিই। এখন এদের কাজ মিনিকে পাহারা দেওয়া, এবং পরাগব্রত ফিরলে তাকে ধরে রেখে সিংজীকে খবর দেওয়া। দ্বিতীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়নি এখনও। তারাশঙ্কর একবার আড়চোখে ওপরতলার দিকে দেখলেন। মিনি নিশ্চয়ই ঘরে। আজকাল নামে না। আগে আসত, দুটো কথা বলত। দীপব্রত বা পরাগব্রতর খবর পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইত। মেয়েটাকে দেখতে বেশ। চাইলে যে কোনও পুরুষই ওর অধরা থাকত না। কিসের আশায় সিংজীর দলে নাম লিখিয়েছে কে জানে। তারাশঙ্করের হঠাৎ রাগ হল সিংজীর ওপর। মেয়েটাকে হাত করে বেশ্যার কাজ করাচ্ছে শালা। তারপরে ভাবলেন, রাগটা কি একজন পিতৃস্থানীয় ব্যক্তির? না কি অসফল এক কামুক প্রৌঢ়ের? অত ভেবে কাজ নেই… এখন ভুবনব্রতর কাগজপত্র নিয়ে পড়তে হবে।
বসার ঘর থেকে অফিসে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেলেন, লক্ষ্মণ দারোয়ান দুজনকে বলছে সিংজীর বাড়ি ফিরে যেতে। এখনই। এখানের পাট চুকল।
কেন? মিনি কি তাহলে সিংজীর বাড়িতেই ফিরে যাবে আবার? পরাগব্রতর জন্য অপেক্ষা শেষ? কেন?
তারাশঙ্করের সে নিয়ে কী দরকার? কাজ করতে হবে অঢেল। অনেক কাগজপত্র ঘাঁটতে হবে। ভুবনব্রতবাবুর টেবিলে বসে স্থির করতে লাগলেন কোথা থেকে শুরু করবেন।
ক্রমশঃ