অনেক বছর আগে, একবার এক সদ্য কিশোরকে নিয়ে তার মা দেখাতে এসে বললো,’ডাক্তারবাবু, আপনি একটু বারণ করুন তো, ও খুব খারাপ ভাষা ব্যবহার করছে, স্কুল থেকেও complain এসেছে। ছোট থেকেই আমি বাচ্চাটাকে দেখতাম, তাই ভালোই পরিচিত। ছেলেটিকে বললাম, ‘তুই কি কি গালাগালি জানিস বলে যা, মা কিছু বলবে না ; আর বললে আমি মাকে বাইরে পাঠিয়ে দেবো’। যথারীতি ছেলেটি চুপ করে থাকলো। আমি বললাম, ‘দেখ গালাগালি তুই যা জানিস আমি তার থেকে অনেক বেশি জানি, আমার ‘স্টক’ তোর থেকে প্রচুর। কিন্তু, এটাকে ব্যবহার করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই, বরং জেনেও সংযত থাকাটাই বাহাদুরি। তুই জীবনে অনেক খারাপ জিনিস শিখবি, কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করাটাই হলো মূল শিক্ষা, সেটা তোর বাবা মা দিক বা মাস্টারমশাই দিক’! সেই ছেলেটা কতটা বুঝেছিল জানিনা, কিন্তু এই শিক্ষাটার অভাব প্রতি পদে পদে face করছি এই সময়ে। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বাঙলার এম পি আচমকা যেভাবে একটা জঘন্য গালাগালি করে উঠলো, রীতিমতো চমকে যাওয়ার মতো। সবচেয়ে অবাক লাগলো তার পেছনের সারিতে একঝাঁক মহিলার (অবশ্যই বাংলার) প্রতিক্রিয়ায় ; একজনেরও অভিব্যক্তির মধ্যে অনুমোদন না করার কোনো রকম প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় নি, অন্ততঃ দৃশ্যত। যাক, রাজনৈতিক নেতাদের নাহয় সব সময়ে চমক দিতে হয়, খারাপ ভাষা ব্যবহার করলেই তাহলে মিডিয়ায় কভারেজ পাওয়া যাবে, নচেৎ……
তবে, এ বিষয়ে গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা সে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে বহু দূর। পশ্চিম সীমান্তে উত্তেজনা যত বেড়েছে, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা- আশ্রয় যত বিপন্ন হয়েছে যুদ্ধের আবহাওয়ায়, মুহুর্মুহু গোলা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণে জনজীবন যতটাই বিপর্যস্ত ; ঠিক ততটাই কিংবা তার থেকেও অনেক তীব্র ভাবে নিক্ষেপিত হচ্ছে খিস্তি, গালাগালি ও অশ্লীল শব্দের ব্যাপক,দুরন্ত, বাধাহীন প্রয়োগ (বা অপপ্রয়োগ) সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে!! ভুলেও ভাববেন না, এর উৎস স্থল কোনো কুখ্যাত অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল! বরং, এর প্রায় সবটারই উদ্গাতা (rather authored by) শুধু শিক্ষিত নয়, উচ্চশিক্ষিত বা অতি উচ্চ শিক্ষিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন। এর মধ্যে চিকিৎসকদের সংখ্যাও কম নয়, বেশ কয়েকজন তো যথেষ্ট পরিচিত এবং আগে ধারণা ছিল পরিশীলিত সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ হিসেবেই। একটা কথা অবশ্যই বলা উচিত, যত দিন যাচ্ছে তত আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে আমি সত্যিই কিছু বুঝিনি বেশির ভাগ জিনিস সম্বন্ধে। বা, বুঝলেও পুরোপুরি ভুল বুঝেছি, অন্ততঃ মানুষ চেনার ক্ষেত্রে তো বটেই। মেনে নিলাম দেশপ্রেমের উচ্ছ্বাসে হয়তো সব সংযম বিস্মৃত হয়েছেন, কিন্তু তাবলে এই রকম আদিম অপ্রাকৃত উল্লাস!! কোনো অপছন্দের মহিলাকে ‘ট্রোল’ করার ক্ষেত্রে শুধু লেখক নয় তার/ তাদের সমমর্মীদের সম্মিলিত উচ্ছ্বাস কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে, তার সত্যিই অকল্পনীয়। ‘দেশপ্রেমিকদের’ ভাষার ব্যবহার বা অপব্যবহার ও তার সঙ্গে অশ্লীলতার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রয়োগ দেখে, আমি কি বলবো, পুরো স্তম্ভিত!! এ বিষয়ে যে যত নোংরা ভাষা ব্যবহার করবে, সেই বোধহয় সবচেয়ে অগ্রণী ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে গণ্য হবে!! দেশপ্রেম বিষয়ে আমার খুব একটা কিছু বলার নেই, আমি শূন্য পেলেও যে অনেকেই বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থার নিরিখে ৯৯•৯৯৯৯ শতাংশ পাবেন তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাতে কোনো আপত্তিও নেই, আপত্তি পরিষ্কার একটা জায়গাতেই, সেটা হলো সোস্যাল মিডিয়ায় অতি নোংরা ভাষা ব্যবহার বা ভাষা সন্ত্রাসে…….
আমি ঠিক বুঝতে পারিনা যারা এইসব আক্রমণের মূল লক্ষ্য মানে সেক্যু-মাকুরা এই যুদ্ধকে ঠিক কি কি ভাবে প্রতিহত করেছে বা করে চলেছে? কি কারণে জানিনা ছন্দ মিলিয়ে সেক্যু-মাকু-নকু বলার পরিসর থাকলেও ‘নকু’ শব্দটা এক্ষেত্রে ইংরেজি ‘h in hour’ এর মতোই উহ্যই থাকছে। হতে পারে, এই দেশপ্রেমিকদের একটা অংশ (অন্ততঃ চিকিৎসক সম্প্রদায়ের মধ্যে), কম বয়সে এদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীলই ছিলেন!
সে যাই হোক, মাকু বলতে নিশ্চয়ই মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য-সমর্থকদের বোঝায়, গত নির্বাচনে যাদের সারা ভারতে ভোটের পরিমাণ ছিল total cast vote এর ১• ৭৬ ( সিপিআই ০•৪৯ ও সিপিআই এম-এল ০•২৭) শতাংশ। সব জায়গায় লড়েনি, লড়লেও কতো হতো শতকরা দু ভাগ বা সব মিলিয়ে বামপন্থী ভোট হতে পারতো তিন খুব জোর চার শতাংশ। তারা যুদ্ধ চাইলো না চাইলোনা তাই নিয়ে আপনাদের এতো চিন্তা কেন, সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না। মাকুর মতো ‘সেক্যু’র মানে এতো পরিষ্কার নয়, কারা সেক্যুলার? কংগ্রেস? তৃণমূল কংগ্রেস? তৃণমূল নিয়ে কোনো ধরণের আলোচনা না করাই ভালো, তবে কংগ্রেস যদি সত্যিই সেক্যুলার হতো তাহলে তো মুসলিম লীগের জন্মই হয়তো হতো না। দীর্ঘ কাল ধরে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের ভূমিকা আর যাই হোক, সেক্যুলার ছিল না, সংবিধানে সেক্যুলার কথা তো অনেক রাজনৈতিক দলই ভেবে এবং না ভেবে রেখে দিয়েছে !! আসলে, ‘সেক্যু’ শব্দটা বোঝানো হয় যারা ‘উৎসাহী/সোচ্চার ভাবে মুসলিম বিরোধী’ নয়। লক্ষ্যণীয় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে ‘ব্রিফিং’ এ দুটো জিনিসের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, ১) পাকিস্তান চেষ্টা করেও আমাদের দেশে ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করতে পারে নি (দৃষ্টান্তস্বরূপ এক মুসলিম মহিলা সামরিক অফিসারকেও রাখা হয়েছে ‘ব্রিফিং এ), ২) ভারত পাকিস্তানে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে নয়। এক্ষেত্রে, পাক সরকার ও সেনাবাহিনীর response অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
ভক্তগণ একটু শান্ত হন, সংযত হন, ‘হোশ মে আইয়ে’।
হতে পারে, গালাগালি ও অশ্লীল শব্দ প্রয়োগের পৈশাচিক আনন্দে dopamine, serotonin জনিত সুখানুভূতি আপনার বেশ কিছুটা বৃদ্ধি প্রাপ্ত ঘটছে। সেটা ভালো কথা, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, সবার জন্য বলছি না একদম নিজের সন্তানের কাছে কি খুব অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন?! এগুলো পড়লে ( এখন বা পরে) তার/তাদের কি আপনার প্রতি সম্মানবোধ খুব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে?? না, একটা গালাগালি দিয়ে বলবেন তাতে কিছুই যায় আসে না !!
যাহোক, জানি না কাকে বলছি কেনই বা বলছি?! যাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো, পাকিস্তান নয়, সেক্যু-মাকুদের বিরোধীতা তাদের বলে কীইবা লাভ?!
লেখাটার একটাই উদ্দেশ্য, আমার friend list এ যারা যারা এ রকম নোংরা ভাষা ব্যবহারপন্থী আছেন, অবিলম্বে আমাকে পরিত্যাগ করুন; না হলে আবার আমাকেই খুঁজে খুঁজে (চুন চুন কে) তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। অনেক বয়স হয়েছে, এ রকম ফালতু নোংরা মানসিকতার ভাষা সন্ত্রাসী মানুষের বন্ধুত্ব আমার সত্যিই দরকার নেই। তার চেয়ে বন্ধুহীন থাকাই অনেক ভালো।











ভালো লেখা।
অত্যন্ত সময় উপযোগী লেখা