নিজের পারিবারিক জীবনের সমস্যা ইত্যাদির গল্প আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় সেভাবে করি না। কিন্তু আজ একটু বলি।
আমার ছেলের যখন জন্ম, সেসময় আমি বাঁকুড়ায় কর্মরত। আগের মাসেই চাকরিতে জয়েন করেছি, সুতরাং ছুটি-ছাটা কিছুই পাওনা হয়নি। মার্চ মাসের এক বৃহস্পতিবার দুপুরে বাঁকুড়া থেকে ফিরে সেদিনই বউকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় – আমার বউ তখন সেই কর্পোরেট হাসপাতালেই চাকরি করে – পরেরদিন প্ল্যানড সিজার। ছেলের জন্ম শুক্রবার। পরের সপ্তাহে বউকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে আয়ার ভরসায় বউ-ছেলেকে রেখে আবার চাকরি করতে যাই। ওই কয়েকটা দিনের ছুটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘ম্যানেজ’ করে দিয়েছিলেন – নইলে আমার তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান এটুকুও দিতে রাজি ছিলেন না। উপরন্তু, এই তো বাচ্চা হবে, এবারে বাচ্চা প্রায়ই অসুস্থ হবে আর তুমি ছুটি নেবে, তোমার তো চাকরি জয়েন করা উচিতই হয়নি ইত্যাদি ঋষিবাক্য তাঁর মুখে শুনতে হয়েছিল – বয়স কিছুটা বেশি, স্রেফ এই কারণে কারও শ্রদ্ধা প্রাপ্য হয়, একথায় আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না, এখনও করি না, আবার অকারণ গালিগালাজেরও মানে হয় না, কাজেই আমার সেই বিভাগীয় প্রধান নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না।
আমার মা তখনও বিষ্ণুপুরে চাকরি করে। এদিকে বউয়ের বাবা-মা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন, বউয়ের একমাত্র দিদি মার্কিনদেশে থাকে। কাজেই এককথায় আমাদের তখন সাপোর্ট নেটওয়ার্ক জিরো।
তো যা বলছিলাম, বউ তখন একটি বিখ্যাত কর্পোরেট হাসপাতালে চাকরি করে। বেশ কয়েকবছর যাবৎ সেখানে কাজ করার সুবাদে খানিকটা সিনিয়রই বলা যায়। এবং এতটুকু বাড়িয়ে না বলেই বলি – আমার বউ সত্যিই আমার চাইতে ভালো ডাক্তার, ঢের বেশি ভালো, রোগী দেখার সময় মনোযোগ, আন্তরিকতা, রোগীর শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি বাকি সমস্যার কথা মাথায় রাখা, সবদিকেই সে আমার তুলনায় এগিয়ে – আর সেই সুবাদে রোগীর কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া এবং ভালো ও নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে কর্তৃপক্ষের সুনজরে থাকা, এই দুই দিক থেকেই আমার বউ আমার চাইতে ঢের এগিয়ে।
কিন্তু যেকথা বলছিলাম, বউয়ের সেই হাসপাতালে তখম মাতৃত্বকালীন ছুটি মাত্র তিন মাস – যদিও সরকারি নির্দেশিকা সাড়ে চার মাস, যা পরে বেড়ে ছয়মাস হয়েছে। সেই তিনমাসের পর বউ নিজের পাওনা ছুটি লিভ-উইদাউট-পে জুড়েটুড়ে ছুটিটা আরও মাসতিনেক বাড়াল। তারপর আয়ার ভরসায় বাচ্চাকে রেখে চাকরিতে ফিরল। কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে বুঝল, বাচ্চাটার দেখভাল ঠিকঠাক হচ্ছে না, ওর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। একবার তো বাচ্চাটা এমন গুরুতর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ল যে রীতিমতো দুশ্চিন্তার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তো আমার স্ত্রী ঠিক করল, চাকরি ছাড়তে হবে।
সেসময় আমাদের রাজ্য সরকারি চাকরিতে মাইনে সত্যিই কম। তার সঙ্গে বাঁকুড়া যাতায়াত, সেখানে কোয়ার্টার রান্নার মাসি ইত্যাদি প্রভৃতি মিলে অনেকখানি খরচ। দুজনে চাকরি করি বলে স্বচ্ছলতাটুকু বজায় আছে। এমতাবস্থায় বউ চাকরি ছাড়লে আর্থিক সমস্যা কিছু কম হবে না। কিন্তু চাকরিটা আমি ছাড়ব নাকি আমার স্ত্রী, এ নিয়ে আলোচনা করতে যেতেই সে বলল, সরকারি চাকরি ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না, এখন মাইনে কম হলেও পরে বাড়বে, প্লাস ওটা পাকা চাকরি, তাছাড়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও আছে। অতএব, চাকরি ছাড়বে আমার স্ত্রী, এমনটাই নির্ধারিত হলো।
এতদিন সুনামের সঙ্গে চাকরি করার পর সেই চাকরি ছাড়ার কথা বলতে যেতে সেই হাসপাতালের কর্ণধার – লিঙ্গপরিচয়ে তিনিও নারী – খুব করে মানা করেছিলেন। বলেছিলেন – চাকরিটা ছেড়ো না, তোমাকে বলেই বলছি, মাইনে অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছি, খরচা নিয়ে ভেবো না, ভালো ক্রেশে ছেলেকে রাখো।
কিন্তু আমরা তার আগেই বেশ কিছু ক্রেশে খোঁজখবর নিয়েছিলাম। হয় পছন্দ হয়নি, নয়ত সেখানে শনিবার রাখা যায় না (হাসপাতালে তো শনিবারও ওয়ার্কিং ডে), নইলে আরও কিছু ফ্যাচাং (যেমন একটি ক্রেশে সকাল ন’টার সময় বাচ্চা পৌঁছানোর সময় যা যা সঙ্গে দিয়ে দিতে হবে, তার আয়োজন করতে হলে সারাদিন একজনকে সে কাজ নিয়েই বসে থাকতে হবে)।
সেসময় বউ সেই হাসপাতাল-কর্ত্রীকে বলেছিল – ম্যাডাম, হাসপাতালে তো এতজন ওয়ার্কিং মেয়ে, এখানেই একটা ক্রেশ খুলুন না! আমরা টাকা দিয়েই বাচ্চা রাখব, কিন্তু এটুকু ব্যবস্থা হলে আমাদের কাউকেই চাকরি ছাড়তে হবে না। বরং, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের একটা দায়বদ্ধতার মানসিকতা তৈরি হবে – আমাদের মনে হবে, হাসপাতাল যখন আমাদের কথা ভাবে, আমাদেরও সেভাবেই ভাবা উচিত।
কথাটা শুনে ভদ্রমহিলা মৃদু হেসেছিলেন। ওটুকুই। অথচ পড়েছিলাম, ন্যূনতম কতজন যেন মহিলা-কর্মী থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ক্রেশ রাখা বাধ্যতামূলক। এবং ন্যূনতম যে সংখ্যা, তার কয়েকগুণ বেশি মহিলা-কর্মী সেই হাসপাতালে তখন চাকরি করতেন – অবশ্য একথা মনে করিয়ে কোনও লাভ নেই বলেই বলার চেষ্টা করা হয়নি।
বউকে চাকরিটা ছাড়তে হয়। পরের বেশ কয়েকটা বছর সে বাড়িতেই ছিল। ছেলের দেখাশোনা করত। দেখে মাঝেমধ্যে আমার খারাপ লাগত, কিন্তু আর কী-ই বা করার ছিল!
সেভাবে বাছবিচার না করলে ডাক্তারদের চাকরি পেতে অসুবিধে হয় না – তাই আমার স্ত্রী পরে অন্য চাকরিতে ঢোকে। কিন্তু বউয়ের অনেক বন্ধুই পাকাপাকিভাবে গৃহবধূ থুড়ি হোমমেকার হয়ে গিয়েছে। শুরুতে বাচ্চা ছোট, তারপর বাচ্চা ইশকুলে যায় পৌঁছে দিতে হয়, তারপর পড়াশোনার সময় পাশে বসতে হয়, তারপর…
ছেলেমেয়েদের জীবনে নাকি মায়ের ভূমিকা সবসময়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ – বাচ্চাবয়সে স্তন্যপান, আরেকটু পরে স্নান-খাওয়া করানো, তারপর ইশকুল শুরু, যত উঁচু ক্লাস তত পড়াশোনা, সেসময় নাকি মায়েরা রাখালের মতো লেগে না থাকলেই মুশকিল! অবশেষে ছেলেমেয়ে কলেজে গেলে মায়েরা আচমকা অনুভব করেন – যাহ্! এবারে তাহলে কী করব? কী করলাম এই জীবনটা নিয়ে!!
এভাবে… ঠিক এভাবেই…