একবার শোনানো গল্প আরেকবার। গল্পটাকে পাপের খতিয়ান হিসেবে ধরতে পারেন। গল্পটা আবার গানের গল্পও বটে। বহুদিন আগের গল্প। অঙ্গনওয়ারি কর্মী হিসেবে কুক ও তাদের হেল্পার নিয়োগের ইন্টারভিউ হচ্ছিল। সেই বোর্ডে পদাধিকার (এসিসটেন্ট চিফ মেডিক্যাল অফিসার) বলে আমিও ছিলাম। সঙ্গে সরকারি আদেশবলে এমএলএ, স্থানীয় পুরসভার চেয়ারম্যান, মহকুমা শাসক এরাও ছিলেন। চেয়ারম্যান এবং এমএলএ ভিন্ন রাজনৈতিক দলের। দুজনেরই অনেক পছন্দসই ক্যান্সিডেন্ট ছিল। এবং যথারীতি আমার ও এসডিও-র ওপরে দুজনেই চাপ তৈরি করেছিলেন তাদের সিলেক্ট করার জন্য।
সেই চাপের পাপের একটি কাহিনীই আজকের গল্প। একজন ক্যান্ডিডেট ঘরে ঢোকার আগে এমএলএ সাহেব (এই সম্বোধনটাই আমলাতন্ত্রের দস্তুর), আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, “এই মেয়েটি আমার ক্যান্ডিডেট, একে নিতেই হবে।” আমি মরিয়া হয়ে খালি বলেছিলাম যে, মেয়েটির কিছু একটা পজিটিভ দিক বলুন যাতে অন্যদের কনভিন্স করতে সুবিধে হয়। এমএলএ তার উত্তরে বলেছিলেন, “ডাক্তার সেন, মেয়েটি গাইতে পারে ভালো।”
স্রেফ এই টুকু তথ্যের ভিত্তিতে ওই মেয়েটিকে নিতে রাজি করানোর দুরূহ কাজ চাপাতে কিছুটা ঘাবড়ে গেছিলাম। এর আগে প্রশ্ন হিসেবে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কিছুই মুখ বুঁজেই শুনেছিলাম। সেই উদ্ভট প্রশ্নগুলির নমুনা আর দিলাম না। স্রেফ একটা নমুনা না দিয়ে পারছি না। একজন ইন্টারভিউযার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “নেমসেক বইটি কার লেখা?” ভাবুন একবার।
এই পটভূমিকায় শুরু হয়েছিল সেই ইন্টারভিউ। অতীব সাদামাটা রোগা পাতলা চেহারার একটি মেয়ে। তার দিকে নানা প্রশ্নবান। মেয়েটি প্রায় নতমুখেই উত্তর দিচ্ছিল, মানে দেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছিল। আমার পালা আসলে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “ধরো খাওয়া দাওয়ার পরে তোমার সেন্টারের সেই বাচ্ছাগুলির মধ্যে কেউ কেউ একটু ঘুমোতে চাইলো, আর বাকিরা হইচই করছে। না বকে ঝকে তাদের শান্ত করতে পারবে ?”
খুব শান্ত গলায় উত্তর এলো, “হ্যাঁ স্যার, পারবো” “কিভাবে?” “গান শুনিয়ে।” “তুমি গান জানো?” “ওই একটু আধটু।” “কিছু মনে না করলে একটা যে কোনো গানের একটু খানি শোনাবে? তাই বলে আবার বাচ্চাদের গান নয়, বড়দের গানই শোনাও।”
ইন্টারভিউ বোর্ডের বাকি সদস্যরা ততক্ষণে এই প্রশ্নোত্তরে কিঞ্চিৎ উৎসাহী হয়ে পড়েছেন সেটা তাঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বুঝতে পারলাম। সেই এমএলএ-র মুখে কেবল সামান্য হাসি।
মেয়েটি খালি গলায় গান ধরলো। মাথাটা সামান্য ঝুঁকে। কুড়ি বাইশ বছরের একটি মেয়ে। উল্টোদিকে বাঘা বাঘা সব শ্রোতা, গানের কিছু বুঝুক না বুঝুক। তাঁদের চোখ মেয়েটির কালো চুলের সাদা সিঁথির দিকে।
বিশ্বাস করুন। সেই প্রায় অন্ধকার উত্তরবঙ্গের হেমন্তের বিকেলের কথা আজো মনে আছে। সরকারি অফিসের বিবর্ণ ঘরখানি সুরের মূর্ছনায় সেই দিন কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বলে বোঝাতে পারবো না। দু কলির বদলে গোটাদুয়েক গান শোনার পরে মেয়েটিকে সাক্ষাৎকার পর্ব থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। চারজন ইন্টারভিউয়ার একমত হয়ে ঢেলে নম্বর দিয়েছিলাম। মেয়েটি চাকরি পেয়েছিল।
জানিনা অন্য কোন যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে ওই মেয়েটিকে সিলেক্ট করে কোনো পাপ করেছিলাম কি না। করে থাকলেও সেই পাপের ভাগিদার আমি একা নই। দুই ভিন্ন মেরুর রাজনীতির নেতাকে একসাথে মেলানোর মতো কথা আর সুর যাঁরা রচনা করে গেছিলেন, তাঁরাও বোধ হয় কিছুটা দায়ী। আর কিছুটা দায়ী সেই মেয়েটির অজানা সংগীত-শিক্ষক, যাঁর শেখানোর গুণে চারজন চল্লিশ উত্তীর্ণ পোড় খাওয়া মানুষের চোখ সেদিন শরতের বিকেলে ছলছল করে উঠেছিল।
আমার মতো নাস্তিক মানুষের পাপপুণ্যের বিচার আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। যাক সে কথা, এটা আমার নয়, এটি ওই মেয়েটির গল্প, এটা গানের গল্প। গান স্রেফ একজন সাধারণ মানুষকে এক লহমায় কতটা অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে কতটা আনন্দময় করে তুলতে পারে আমাদের নিরানন্দ এই জীবনটাকে, সেটা সেদিন বুঝেছিলাম। সেটাই পুণ্য আমার কাছে।
মেয়েটির গাওয়া গানদুটি অনেকের গলায় শুনেছি। একটি গান ছিল রবীন্দ্রসংগীত। অন্য গানটি ছিল মহালয়ার গান। জানিনা এত বছর বাদে মেয়েটি ওই অঙ্গনওয়ারীতে চাকরিতে আছে কি না। জানিনা ওই সামান্য বেতনে সে কি ভাবে এখনো বেঁচে আছে। জানি না আজকের দিনে কোথাও সেই গানটি সেই মেয়েটি আবার গায় কি না–“বাজলো তোমার আলোর বেণু”।
সবাইকে শারদীয়া উৎসবের আগাম শুভেচ্ছা।
অসামান্য।