পাগলা চুলকে নে- এই বিখ্যাত ডায়ালগ টা জানেন না, এমন বাঙালি স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কোথাও নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
পাগলা চুলকে নে- বলে এই তিনটি মাত্র শব্দে আমরা কি না কি প্রকাশ করি! তীব্র প্রত্যাখান, উপহাস, ভালোবাসা, সহানুভূতি, বন্ধুত্ব- সব এই এক বাক্যে সেরে দিতে পারি আমরা। তাও বেশিরভাগ সময় বাঙালি এটা ব্যবহার করে উল্টো অর্থে! সে অন্য কথা।
বিশ্বাস করুন, ‘পাগলা চুলকে নে’ বলে ও, এমনকি না বলেও, চুলকে দেয়ার জন্য অগণিত সহৃদয় বাঙালির অভাব হয় না!
কিন্ত সত্যিটা হলো, যত সহজে অন্যকে ‘চুলকে নে’ বলে নিজেই চুলকে দেয়, ততটা মহানন্দে কেউ নোংরা মাখানো নখ দিয়ে নিজের খোলা বা ঢাকা জায়গা মোটেই চুলকায় কি???
এ প্রশ্ন যেমন জটিল , উত্তর আরো মাকড়সার জাল। থাক আপাততঃ। উত্তর বেশিরভাগ সময় ই ‘না’। চুলকাতে পারে না।
মানুষের যে কয়টি আদিম অসুখ আছে, তার মধ্যে চুলকানি সম্ভবতঃ সবচেয়ে পুরনো! ষড়রিপুকে একত্র করে একটি মাত্র রিপু যদি ভাবা যেত, তাহলে সেটি হতো চুলকানি!
যাইহোক, চুলকানিকে শুধু মাত্র খারাপ অর্থে নেবেন না।
একটু তলিয়ে ভাবুন, আমরা চুলকানিকে যে কোন অর্থে ব্যবহার করতে পারি !
ফিরিস্তি দিতে গেলে আসল ঘটনা লেখা হবে না।
মানব সভ্যতার ইতিহাস যদি দেখা যায়, তার সমস্ত সৃষ্টি অনাসৃষ্টি লালন পালন ধ্বংস পুনঃনির্মাণ- সমস্তই কোন না কোন চুলকানির ফসল! আমাদের চারপাশের যা কিছু দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য, সব কিছুর পেছনে ভালো মন্দ সব অর্থেই ব্যবহার করা যেতে পারে চুলকানি!!
ধরা যাক, নিউটন এর কথা। আপেলটা যেই না টুপ করে পড়লো, অমনি ‘পাগলা চুলকে নে’ বলে নিজেই নিজের মাথা চুলকাতে শুরু করলো!মহাকর্ষীয় চুলকানি!
ধরা যাক, শূর্পনখার কথা! বেচারীর প্রেম নিবেদনের পর লক্ষণ এবং রাম, দু’জনেরই উপহাস একটা রামায়ণের জন্ম দিল!
ধরা যাক, মহাভারতের কথা! যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার চুলকানি না উঠলে, শকুনি আর দুর্যোধনের রাজ্য লাভের চুলকানি না উঠলে – হয়তো মহাভারত লেখা ই হতো না!
এছাড়া ও আশেপাশে যা কিছু দেখছেন, তার পেছনে একটি চুলকানির ইতিহাস অবশ্যই থাকবে! এটা স্বতঃসিদ্ধ!
এমনকি আত্মনির্ভরশীল হবার জন্যও চুলকানি দরকার খুব!!
থাক এসব। ডাক্তারির ইতিহাসে আস।
শুধু মাত্র চুলকানির উপর বিশ্বাস করে, চুলকানিকে সকল বিশ্বাসের স্তম্ভ হিসেবে ধরে, চুলকানিই সকল অসুখের মূল প্রকাশ বলে মেনে নিয়ে, চুলকানির বিরুদ্ধে অলৌকিক সব ওষুধ আবিষ্কার করতে করতে, মানুষের চুলকানির ভয়কে কাজে লাগিয়ে, মানুষকে চুলকে দিয়ে- একজন বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক(?) চিকিৎসার একটি আলাদা চুলকায়িত শাখাই আবিষ্কার করে ফেলেছেন!!
সে চুলকানির ইতিহাস সগর্বে বুকে ধারণ করে, লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্যকে চুলকে দিচ্ছেন, চুলকে নিতে সাহায্য করছেন! তার পেছনে কি পরিমাণ ব্যবসায়িক চুলকানি আছে, সে উহ্য থাক।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই রকম হাজারো চুলকানির ইতিহাস আছে। বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা ব্যবস্থা , প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত- সগর্বে চুলকে যাচ্ছে আমাদের!
তন্ত্র মন্ত্র জ্যোতিষ জলপড়া তেলপড়া তাবিজ কবজ মাদুলি অং বং চং ইত্যাদি নানা রকম চুলকানিজাত অজ্ঞতার ফলে আমরাও সযত্নে লালন পালন করি হাজারো চুলকানিকে ।
তেমনই এক চুলকানি নিয়ে কিছু কথা ।
সত্যিকার অর্থে চুলকানি নিয়ে বলতে গেলে আমাদের মনে কয়েক রকম চুলকানির কথা চলে আসে। যেমন- খোসপাচড়ার চুলকানি, অ্যালার্জির চুলকানি, শুকনো চামড়ার চুলকানি, নানারকম রাসায়নিক পদার্থের ফলে তৈরি হওয়া চুলকানি। যে সব অসুখগুলোর উপসর্গ চুলকানি, তার মধ্যে কিছু কমন অসুখ- একজিমা, দাদ, সোরিয়াসিস ইত্যাদি। এছাড়াও জন্ডিস ডায়াবেটিস ক্যান্সার অব্দি চুলকানি নিয়ে আসতে পারে। আর কৃমি নামক একটি প্রাণীর চুলকানি তো সর্বজনবিদিত।
এই লকডাউনের বাজারে নানা রকম সমস্যা নিয়ে মানুষ ফোন করে যাচ্ছেন প্রতিদিন। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ, টক ঝাল মিষ্টি ইত্যাদি গিলে ঢেঁকুর তোলার পর, বসে বসে চুলকে চুলকে ছাল তোলার পর, চুল ছেঁড়ার পর, সর্বোপরি গর্ভনিরোধক পিল-এর জন্য দিনে গোটা কুড়ি ফোন ধরা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেহেতু বাইরে এখন ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ, বিনা পয়সায় যদি আলকাতরাও পাওয়া যায়, মানুষ তার লোভেই ফোন করছেন। অথচ আমরা মডার্ন মেডিসিনের চিকিৎসকরা এই বিষয়ে খুব অসহায়। যাঁর যাঁর বিষয় ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে লিমিটেশন আছে। কেউই সর্বরোগহর বটিকা নিয়ে গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসা করতে পারি না।
অথচ মানুষকে কে বোঝাবে! তাঁদের চাই সবকিছু একজায়গায়! গ্যারান্টি ও! অতএব ইলিগ্যাল টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে যেতে হচ্ছে মুখ বুজে।
যতটা সম্ভব সবদিক বাঁচিয়ে চেষ্টা করছি।
পরশুই একজন এলেন পাশের বাড়ি থেকে। একে নিয়ে না লিখে পারলাম না। এনার উপসর্গ সেই বিখ্যাত চুলকানি। না, কোন রকম অসুখ বিসুখ আগে থেকে নেই। শুধু মাত্র দিন তিনেক ধরে দুই হাতের তালু চুলকাচ্ছে। প্রথম দিন ডান হাতে। তো ভদ্রলোক মহাখুশি হয়ে ভেবেছেন, এই লকডাউনের বাজারে কোন এক অলৌকিক উপায়ে টাকা আসবে ঘরে!
এই কুসংস্কারটি কত বছরের পুরানো জানি না, তবে এর একটা ফ্যানবেস আছে। ডান হাতের তালু চুলকাচ্ছে, বা লিঙ্গভেদে বাম হাতের তালু চুলকাচ্ছে মানে টাকা আসবেই!!
আবার উল্টোটা হলেই মাথায় হাত! কি জানি কোন আপদ আসে- পয়সা খরচ হবেই!
তো ভদ্রলোক সারাদিন ধরে চুলকে গেছেন। কোনদিন থেকে টুপ করে পয়সা পড়তে শুরু করে কে জানে। অতএব চব্বিশ ঘণ্টা কামাই দেননি চুলকানিতে।
একদিন মহানন্দে কাটালেন। না, একটি ফুটো কড়িও আসেনি! উপরন্তু পরের দিন সকালে দেখলেন বাম হাতের তালুও চুলকাচ্ছে!!
মাথায় হাত! একি রে বাবা! করোনা আসেনি তো? ঘরেই তো আছেন- হঠাৎ টাকা পয়সা খরচ হবে কি করে??
সারাদিন ডান চুলকাতে চুলকাতে কেটে গেল!
একে তাঁকে ফোন করে ভালো মন্দ সব খবর নিয়েছেন। কোনদিক থেকে টাকা আসবে আর কোনদিকে খরচ হবে- কোন ক্লু পাননি।
অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দু’একজনকে ফোন করেছেন- কোন পুরিয়া, জলপড়া তেলপড়া তাবিজ কবজ শেকড় কিছু যদি পাওয়া যায়!
কিন্ত ওই যে দক্ষিণা না পেলে বিনা পয়সায় ‘পাগলা চুলকে নে’ বলা ছাড়া কেউ কিছু বলে না, তেমনই ঘটলো।
গতকাল দেখলেন, চুলকানিটা বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে গেছে। দুই হাতেই! সাথে অসংখ্য ছোট ছোট ফোলা ফোলা। হাত লাল হয়ে গেছে চুলকে চুলকে।
আরো সমস্যা হলো, দুই পাছায় চুলকানি হলে যেমন দুই হাত দিয়ে একসাথে চুলকানো যায়, এক্ষেত্রে সেটাও করা যাচ্ছে না! দুই হাতের তালু একসাথে চুলকানো যায় না কোনভাবেই!! হাত পাল্টাতে হয়!
অবশেষে গতকাল মনে হাজারো রকম প্রশ্ন নিয়ে কাল এলেন অধমের কাছে। বলতে ও পারছি না যে, ‘পাগলা চুলকে নে’! আর এই রোগের বিশেষজ্ঞের মত চিকিৎসা করাও আমার এক্তিয়ারে পড়ে না!
পুরো ইতিহাস শুনে বুঝলাম, যতটা না চুলকানির চিকিৎসা চাইছেন, তার চেয়ে বেশি জানতে চান, কোনদিক থেকে টাকা আসবে আর কোনদিকে ড্রেন হয়ে যাবে!! জ্যোতিষী তথা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন চিকিৎসক সবাই নিরাশ করেছেন!
কেউ কেউ ভয় ও দেখিয়েছেন!
বুঝলাম, এনাকে একটুখানি ভালো করে না দিলে, আমার মাথা খারাপ করে ছাড়বেন। ওনার কোন সুত্র থেকে আয় ব্যয় হতে পারে, তা জানার জন্য কোন গ্রহ নক্ষত্রের সাহায্য নেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। দরকারও নেই!
জাস্ট বলতে গেলাম- আপনাকে করোনা ভয়….
ব্যস! ভদ্রলোক ছিটকে উঠলেন!- এই হলো আপনাদের দোষ! খালি অসুখ খোঁজেন! আরে মশাই, হাতের তালু চুলকানো আবার কবে থেকে করোনা হলো?? যা ইচ্ছে খুশি বললেই হলো??
টিভিতে এতকিছু দেখলাম। কই একবারও তো কেউ বললো না যে, করোনা হলে হাত চুলকায়!!
আপনি এখন বলবেন করোনা টেস্ট করাও!আপনাদের এই এক দোষ!
বুঝলাম, এনাকে বোঝানো সম্ভব নয়। ইনি অনেক চুলকে একটি অলৌকিক ঘটনার আশায় বুক বেঁধে আছেন। হেসে বললাম- আপনি তো মশাই বেজায় চটেছেন! কথা শুনুন আগে! আমি কখন বললাম, করোনা হাত চুলকায়? করোনার কি নখ আছে নাকি??
ভদ্রলোক খচে বোম। বুঝতে পারছি, আর কিছু শুনবেন না। বেরোতে পারলে বাঁচেন।
বললাম- শুনুন, বিনা পয়সায় তো ডাক্তারি পরিষেবা নিতে এসেছেন। একটুখানি ধৈর্য অন্ততঃ রাখুন। আপনাকে চিকিৎসা না করলে আমার কিছু যাবে আসবে না । কিন্ত আপনার হাতের যা অবস্থা দেখছি, ভালোই চুলকাবে!!
একটু নরম হয়ে বললেন- আসলেই কি করোনা?
বললাম- না। করোনার ভয়ে শেষ ক’দিন যত স্যানিটাইজার আর সাবানের শ্রাদ্ধ করেছেন, সেটা দিন তিনেক বন্ধ করে দেখুন। আশা করি ভালো হয়ে যাবে! আর এই একটা অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধ খান।
এবারে একটুখানি শান্ত হলেন মনে হলো। তাও বেরিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করতে লাগলেন- কি জানি। এই বাজারে টাকা পয়সা …
মনে মনে হেসে বললাম- যা পাগলা চুলকে নে !
* আজ সকালে ভদ্রলোক দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি বললাম- কেমন আছেন?
বললেন- কিছু মনে করবেন না। একদিনেই অনেকটা কমেছে চুলকানি। দুটো ওষুধ খেয়েছি।
আমি হাসলাম একটু। বললাম- ভালো তো। যাইহোক, একটু কম চুলকাবেন! ঘা হলে সমস্যা!
(ইতিগজ বলার মত বললাম- আপনারও , আমারও!)
শেষ করি এবার। স্যানিটাইজার এর যথেচ্ছ ব্যবহার (কতকটা হয়তো নিয়ম মেনে উৎপাদন না করার ফলে বা কোন রাসায়নিক পদার্থের প্রতি ব্যক্তিবিশেষের অত্যাধিক সেনসিটিভিটির ফলে) কিন্ত অনেকেই একই সমস্যা নিয়ে আসছেন।
আরো অনেকে আসছেন একই সমস্যা নিয়ে।
সবসময় চেষ্টা করুন, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে।
লকডাউন বাড়ুক আর নাই বাড়ুক, চুলকানি না বাড়ুক এটাই এখন কাম্য।