ডায়াবেটিসে মৃত্যুর অন্যতম কারণ নেফ্রোপ্যাথি। ভারতবর্ষে কিডনি ফেলিওর হয়ে যত রোগী শেষ জীবনে ডায়ালাইসিসের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি দায়ী।
আমাদের মত গরীব দেশে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের ডায়ালাইসিস চালানোর মতো পরিকাঠামো নেই। এবং দরিদ্র পরিবারের অধিকাংশ মানুষই অর্থনৈতিক কারণে ডায়ালাইসিস চালাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুকেই বেছে নেন। ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথিতে রেনাল ফেলিওর হলে তা সারানোর একমাত্র উপায় আত্মীয়দের কারো কাছ থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন। সেটি আরও বেশী খরচ সাপেক্ষ এবং ফলাফলও খুব বেশি সন্তোষজনক নয়।
কিভাবে বোঝা যাবে কিডনি খারাপ হচ্ছে?
অধিকাংশ মানুষই জানেন ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়া মানে কিডনি খারাপ হওয়া। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে অন্তত ৯০% কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ার পরেই তবে ক্রিয়েটিনিন বাড়তে শুরু করে।
একবার ক্রিয়েটিনিন বাড়তে শুরু হওয়া মানে অন্তত ৯০% কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তখন হাজার চিকিৎসা করলেও কিডনি আগের অবস্থায় ফেরে না। আস্তে আস্তে এর কার্যক্ষমতা আরও হ্রাস পায়।
অতএব ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথিকে প্রাথমিক অবস্থায় ধরার জন্য আমাদের আলাদা পরীক্ষার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দুটি পরীক্ষা করা যায়। দুটি পরীক্ষাতেই নির্ভর করা হয়, আমাদের মূত্রে কি পরিমাণ এলবুমিন বেরোচ্ছে তার উপর। কিডনির কার্যক্ষমতা স্বাভাবিক থাকলে মূত্রে কোনো এলবুমিন বেরোয় না।
১. ২৪ ঘণ্টার মূত্রে এলবুমিনের পরিমাপঃ এক্ষেত্রে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মূত্র একটি পাত্রে সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেই মূত্রে এলবুমিনের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়।
৩০- ২৯৯ মিগ্রা/ডেসিলি= মাইক্রোএলবুমিনিউরিয়া।
>৩০০ মিগ্রা/ডেসিলি= ম্যাক্রোএলবুমিনিউরিয়া।
২. স্পট ইউরিনে এলবুমিন ক্রিয়েটিনিন রেসিও বা এ সি আরঃ এক্ষেত্রে যেকোনো সময়ে দেওয়া মূত্রের নমুনায় এলবুমিন ক্রিয়েটিনিন রেসিও বার করা হয়।
৩০- ২৯৯= মাইক্রোএলবুমিনিউরিয়া।
>৩০০= ম্যাক্রোএলবুমিনিউরিয়া।
যেহেতু এই পরীক্ষায় সারাদিন ধরে মূত্র জমিয়ে রাখার দরকার নেই তাই এ সি আর পরীক্ষা বেশি জনপ্রিয়।
মাইক্রোএলবুমিনিউরিয়ার রোগীদের চিকিৎসার মাধ্যমে এই স্তরেই আটকে রাখা যায়, অথবা এলবুমিন বেরোনো বন্ধ করে ভালো করে তোলা যায়। কিন্তু একবার ম্যাক্রোএলবুমিনিউরিয়া হলে তা অপরীবর্তনশীল। আস্তে আস্তে রোগী রেনাল ফেলিওরের দিকে এগিয়ে চলে এবং ৭-১০ বছরের মধ্যে তাদের রেনাল ফেলিওর হয়।
এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা উচিৎ, রক্তে গ্লুকোজ অনিয়ন্ত্রিত থাকলেও সকলের কিন্তু ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি হয় না। এক অজানা কারণে মাত্র ২০-৪০% রোগীর নেফ্রোপ্যাথি হয়। কোনো ডায়াবেটিস রোগীর নিকটাত্মীয়ের কারো আগে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি হলে, তার ক্ষেত্রে নেফ্রোপ্যাথি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
আরও একটি কথা আমাদের মনে রাখা দরকার, ডায়াবেটিস রোগীদের মূত্রে অ্যালবুমিন কিন্ত অন্য কারণেও বেরোতে পারে। যেমন মূত্রনালিতে সংক্রমণের জন্য অথবা অত্যাধিক রক্তচাপের জন্য। পরীক্ষা করার সময় এই বিষয়গুলি মনে রাখা উচিৎ এবং দরকার হলে পরীক্ষাটি আরেকবার করা উচিৎ।
চিকিৎসাঃ
আগেই বলেছি মাইক্রোএলবুমিনিউরিয়ার রোগীদের চিকিৎসার মাধ্যমে এই স্তরেই আটকে রাখা যায়, অথবা এলবুমিন বেরোনো বন্ধ করে ভালো করে তোলা যায়। কিন্তু একবার ম্যাক্রোএলবুমিনিউরিয়া হলে তা অপরীবর্তনশীল। সে কারণে প্রতিবছরই ডায়াবেটিস রোগীদের অন্তত একবার করে ইউরিনে এলবুমিন ক্রিয়েটিনিন রেসিও বা এ. সি. আর. পরীক্ষা করা উচিৎ। তার সাথে বছরে অন্তত একটি বার রক্তের ক্রিয়েটিনিনও পরীক্ষা করা উচিৎ।
নেফ্রোপ্যাথি বা এলবুমিনিউরিয়া ধরা পড়লে তার চিকিৎসাঃ
১. রক্তের গ্লুকোজ ঠিক রাখা।
রক্তের গ্লুকোজ স্বাভাবিক রাখার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে ইনসুলিন নিষ্ক্রমণের প্রধান স্থান কিডনি। রেনাল ফেলিওরের রোগীদের কিডনি ফাংশান খারাপ হওয়ার সাথে সাথে ইনসুলিনের প্রয়োজন কমে। এবং ইনসুলিনের মাত্রা না কমালে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। যা রেনাল ফেলিওর রোগীদের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাছাড়া ডায়াবেটিসের বেশিরভাগ মুখে খাওয়ার ওষুধই রেনাল ফেলিওরের রোগীকে দেওয়া যায় না।
২. রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা। (< ১৩০/৮০মিমি এইচজি)
৩. রক্তের কোলেস্টেরল ঠিক রাখা।
৪. এ ছাড়াও কিছু ওষুধ পত্র মাইক্রোএলবুমিনিউরিয়াকে ঠিক করতে পারে।
৫. আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশানের গাইডলাইন অনুযায়ী নেফ্রোপ্যাথি রোগীদের খাদ্যে প্রোটিন কম করা উচিৎ।
মাইক্রোএলবুমিনিউরিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিকেজি দেহের ওজনের জন্য প্রতিদিন ০.৮- ১ গ্রাম প্রোটিন।
ম্যাক্রোএলবুমিনিউরিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিকেজি দেহের ওজনের জন্য প্রতিদিন <০.৮ গ্রাম প্রোটিন।