জাপানী এনকেফেলাইটিস (JE) কি? কিভাবে হয়? কিভাবে ছড়ায়? হলে কি হয়?
JE এমনই এক মারাত্মক রোগ যা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিণতি মৃত্যু, কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর পক্ষাঘাত। এখন অবধি এর নেই কোন ওষুধ, নেই চিকিৎসা। কিন্তু এর নিরাপদ ও কার্যকর টিকা আছে। তাই প্রতিরোধই পাথেয়।
সারা বিশ্বে বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ এই রোগের ঝুঁকির মধ্যে আছেন। বছরে ৭০ হাজার রোগী এবং ১৭ হাজার মৃত্যু রিপোর্টেড হয়। উত্তর ও দক্ষিণ ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ ও গঙ্গার পশ্চিমদিকের জেলাগুলি JE প্রাদুর্ভাবপূর্ণ (Endemic) অঞ্চল। অনেক ক্ষেত্রেই AES – JE এর অনুসন্ধান, পরীক্ষা ও রিপোর্টিং হয় না।
এটি Culex মশা ( Culicine triteniorhynchus, C. vishnui, C. pseudovishnui, C.gelidus, কিছু ক্ষেত্রে Anopheles) বাহিত পশুর থেকে মানুষের হওয়া (Zoonotic Disease) একটি মারণঘাতী রোগ (Fatal Disease)। এক ধরনের Flavivirus (Japanese Encephalitis Virus অথবা JEV) এই রোগের সৃষ্টিকারী জীবাণু।
সংক্রমিত বক জাতীয় পাখিদের (Ardeid Bird) রক্ত পান করে স্ত্রী কিউলেক্স মশা কামড়ালে তারা সংক্রমিত হয় এবং তাদের দেহে ভাইরাসের বংশ বৃদ্ধি হয়। সেই সংক্রমিত স্ত্রী কিউলেক্স মশা শুয়োরদের কামড়ালে শুয়োরেরা সংক্রমিত হয়। আবার সংক্রমিত শুয়োরদের কিউলেক্স মশা কামড়িয়ে সংক্রমিত হয় এবং তারা যখন পরে মানুষকে কামড়ায় মানুষের জাপানি এনকেফেলাইটিস (JE) রোগ হয়।
মানুষের মধ্যে ভাইরাসের অধিবাস স্বল্পকালীন তাই মানুষ থেকে মানুষের সংক্রমণ হয়না। তাই মানুষ (এবং ঘোড়া দেরও) Dead End Host বলে। মানুষের ক্ষেত্রে ভয়ানক পরিণতি হলেও মশা (Vector) ও বক দের (Natural Host) কিছু ক্ষতি হয় বলে জানা যায় নি। শুয়োর দের (Vertebrate Host) ক্ষেত্রে অল্প জ্বর এবং কিছু ক্ষেত্রে গর্ভপাত হয় জানা গেছে। এছাড়া তেমন কিছু হয় না। শুয়োরদের দেহে জীবাণু গুলি বৃদ্ধি পায় এবং অনেকদিন থাকে বলে তাদের Amplifier Hostও বলে। গৃহপালিত পশুর মধ্যে কেবল ঘোড়াদের হয়। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিদের রক্ত খেতে মশারা আসে বলে তাদের Mosquito Attractants বলা হয়।
JE এবং AES:
জাপানি এনকেফেলাইটিস (JE) ভাইরাসের সংক্রমণে যে উপসর্গ (Symptoms) ও লক্ষণগুলি (Signs) দেখা যায় তার সাথে অন্যান্য ভাইরাল এনকেফেলাইটিস বা মেনিংগো – এনকেফেলাইটিস এর মিল থাকায় যতক্ষণ না পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ এই ধরণের সব কটি রোগের ক্ষেত্রে এনকেফেলাইটিস ও মেনিংগো – এনকেফেলাইটিস এর উপসর্গ ও লক্ষণ পাওয়া গেলে তাদের একিউট এনকেফেলাইটিক সিনড্রোম (Acute Encephalitic Syndrome অথবা AES) বলা হয়ে থাকে।
AES আখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে সংজ্ঞা: (ক) অকস্মাৎ বেশি মাত্রায় জ্বর পাঁচ থেকে সাত দিন বা তার কম সময়ের। (খ) বিরক্তিদায়ক উত্তেজনা (Irritability), ঘুম ঘুম ভাব (Somnolence), অস্বাভাবিক আচরণ (Abnormal Behavior)। খিঁচুনি ( Seizure) থাকতেও পারে নাও পারে। (গ) কোন মহামারি পরিস্থিতিতে দু ঘণ্টার বেশি জ্বর ও মূর্ছা বা আচ্ছন্ন ভাব (Altered Sensorium)। এর সাথে দেহের একদিকে খিঁচুনি বা পক্ষাঘাত (Focal Seizure ও Paralysis) থাকলেও AES ধরে নিতে হবে।
AES যেমন JE র ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেরকম অনেকগুলি ভাইরাল রোগে (Viral Diseases) দেখা যায় যার মধ্যে আমাদের দেশে Entero Viral Encephalitis, Tick Borne Encephalitis, Dengue, Varicella প্রভৃতি রোগ উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে (Non Viral Diseases) Malaria, Tryponosomiasis, Acute TB Meningitis প্রভৃতি ক্ষেত্রেও AES এর উপসর্গ ও লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
JE সংক্রমণ:
স্ত্রী কেউলেক্স মশার কামড়ে JE হয়। মশার মধ্যে JE ভাইরাসের সুপ্তিকাল (Incubation Period) ০৯ – ১২ দিন এবং মানুষের মধ্যে ০৫ – ১৫ দিন।
কোন একটি JE রোগী পাওয়া মানে হিমশৈলের চূড়া মাত্র (Tip of the Ice Berg) অর্থাৎ সেই অঞ্চলে অন্তত ৩০০ থেকে ১০০০ জন JE জীবাণুতে আক্রান্ত (Inapparent Infection)। JE একটি বৃহৎ অঞ্চলের মধ্যে ছড়িয়ে (Scattered) হয়। বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী সময়ে JE – র প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
পাঁচ বছর বয়স অবধি শিশুদের JE বেশি হয়। বাল্য অবস্থায় JE ভাইরাসে আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠতে পারে। JE ভাইরাসের আক্রমণ ও সংখ্যা বৃদ্ধির (Viraemia) ফলে মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রের microglials দের অতিসক্রিয়তা দেখা যায় এবং তারা প্রচুর পরিমাণে Cytokinine যেমন Interleukin 1 (IL 1), TNF alpha নির্গত করে। এছাড়াও নানারকম Neurotoxins, Prostaglandins ইত্যাদি নির্গত হয়। এগুলিই মস্তিষ্কের গুরুতর ক্ষতি করে।
JE – র উপসর্গ, লক্ষণ, জটিলতা ও পরীক্ষা:
(ক) রোগের প্রাথমিক পর্যায় (Prodromal Stage, ০১ থেকে সর্বোচ্চ o৬ দিন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বল্পকালীন): হঠাৎ করে প্রবল জ্বর, গলা ব্যাথা, পেট খারাপ, দুর্বলতা, গা ব্যথা ইত্যাদি।
(খ) মস্তিষ্কের সংক্রমণ পর্যায় (Encephalitic Phase, o৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব স্বল্পকালীন): প্রবল জ্বর, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া (Neck Rigidity), খিঁচুনি (Convulsion), মস্তিষ্কের মধ্যের চাপ বৃদ্ধি (Raised Intracranial Pressure), কথা বলতে না পারা (Aphasia), মাংসপেশির ভারসাম্য হারানো (Dystonia), চোখ নাড়তে না পারা (Ocular Palsy), দেহের একদিকের পক্ষাঘাত (Hemiplegia), চার হাত পায়ের পক্ষাঘাত (Quadriplegia), দেহে কাঁপুনি (Coarse Tremor), ধারাবাহিক খিঁচুনি (Seizure), চেতনা অচেতনতার মধ্যে বিচরণ করা (Altered Sensorium), মস্তিস্ক কাজ না করা (Stupor), ঝিমিয়ে পড়া (Drowsy) ইত্যাদি।
(গ) অন্তিম পর্যায় (Late Stage, o৯ দিন অবধি থেকে ১৫ দিন অবধি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বল্পকালীন): অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (Unconscious), খুবই অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়া (Convalescence), বাদবাকি স্নায়ুতন্ত্র কাজ না করা (Residual Neurological Deficits), অঙ্গের অসারতা (Organ Failure), গভীর সুপ্তি (Deep Coma), মৃত্যু (Death)।
মৃত্যু হার (Case Fatality Rate) ৩০ – ৬০ %। জীবিতদের মধ্যে ৩০ – ৫০ % এর মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের পক্ষাঘাত (Cerebral Palsy), মাংসপেশির পক্ষাঘাত (Spastic Paralysis) ইত্যাদি হয়।
অনেকভাবে পরীক্ষা করা যায় যার অন্যতম PCR, Viral Isolation। গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা Cerebrospinal Fluid (CSF) বা রক্তের Serum নমুনায় IgM Capture Eliza পদ্ধতিতে JEV Specific Antibody নির্ধারণ। এটি রোগের চার থেকে সাত দিনের মাথায় পাওয়া যাবে। MRI করলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের বৃদ্ধি দেখা যায়।
মর্মান্তিক সব দৃশ্য:
২০১০ এর বর্ষা শেষে আশপাশের জেলা থেকে বেশ কিছু অজানা জ্বরের মৃত্যুর খবর আসার পর দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জ ব্লকে একটি অজানা জ্বরে শিশু মৃত্যুর খবর পেয়ে আমরা ছুটলাম। মুসলমান প্রধান এই গ্রামে কৃষি ক্রমশঃ লাভজনক না হওয়ায় এবং গ্রামীণ সমাজে নানারকম আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ায় পুরুষদের বেশিরভাগ উপার্জনের জন্যে অন্য রাজ্যে চলে যান। মৃত পাঁচ বছরের শিশুটির বাবাও গোয়াতে একটি হোটেলে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ঈদের আগে টাকা জমিয়ে অনেক উপহার নিয়ে চারদিন হল বাড়ি এসেছেন। এসে দেখেন তার শিশু পুত্র সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলছে। সম্পূর্ন সুস্থ স্বাভাবিক। সেদিন রাত থেকে ধূম জ্বর, তার সাথে খিঁচুনি। কুমারগঞ্জ ব্লক প্রাথমিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করা হল। কোন উন্নতি হলনা। ছেলে অজ্ঞান হয়ে গেল। ডাক্তাররা তখন জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। পরেরদিন ভোরে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে সরাসরি উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়ার পথে শিশুটির মৃত্যু হয়। মৃত শিশুটির বাবা হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। কি বলে আর সান্ত্বনা দেবো? শিশুটিকে মাটি দেওয়া হয়েছে। ওর হাসপাতালের কাগজপত্র, ওদের বাড়ি আর আশপাশের বাড়ি এবং এলাকাটি দেখে হাসপাতালে গিয়ে যারা চিকিৎসা করেছেন সেই চিকিৎসকদের সাথে কথা বললাম। জানলাম ঐ পাড়ায় আর কোন শিশুর জ্বর নেই। অন্য শিশুরা যারা ঐ শিশুটির সাথে খেলছিল সবাই ভালো আছে।
এর পরের খবরটি এলো কয়েকদিন পরে ঐ ব্লকের বাংলাদেশ সীমান্ত গ্রাম সমজিয়া থেকে। একটি তিন বছরের জনজাতি সাঁওতাল শিশু বেশি জ্বর ও পক্ষাঘাত নিয়ে বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখি সেখানকার শিশু চিকিৎসক বাইরে থেকে CT Scan সহ নানারকম পরীক্ষা করিয়ে শেষে তাকে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে রেফার্ড করে দিয়েছেন। ওখান থেকে যেটুকু জানার জেনে আমরা চলে গেলাম সমজিয়া। আদিবাসী পাড়ার প্রান্তে কর্দমাক্ত পরিবেশে একটি ভাঙ্গাচোরা মলিন কুঁড়ে ঘর। তার ভাঙ্গাচোরা দাওয়ায় এক ভাবলেশহীন অশক্ত বৃদ্ধ লাঠি হাতে বসে আছেন। আশপাশের কিছু শুয়োর আর কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। খোঁজাখুঁজির পর প্রতিবেশীরা ঐ অসুস্থ শিশুটির মা একটি অল্প বয়সী সাঁওতাল বধূকে নিয়ে এলেন। মলিন একটি শাড়ি কোন রকমে দেহে জড়ানো, কোলে একটি দুধের শিশু। বধূটি ওপরের জমিতে মজুরের কাজ করছিলেন। আগের বছর স্বামী মারা গেছেন। কোন জমি জিরেত নেই। অন্যের জমিতে জন মজুর খেটে বৃদ্ধ শ্বশুর, দুই সন্তান ও নিজের খোরাকি জোটানোর চেষ্টা করেন। নিজেদের সম্বল বলতে এই ভাঙ্গাচোরা কুঁড়েটিই যা ছিল। বড় বাচ্চাটির চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে মহাজনের কাছে সেটি বাঁধা দিয়েছে।
এবার জেলার দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তের হরিরামপুর ব্লক থেকে দুটি শিশুর মৃত্যুর খবর এলো। আমরা জেলা সদর থেকে একটি অনুসন্ধানকারী দল একটি বড় গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম। বুনিয়াদপুর মোড়ে ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক তাঁর দল নিয়ে আরেকটি গাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন। এবার আমরা গ্রামীণ পথে যাত্রা শুরু করলাম। গাঙ্গুরিয়া পঞ্চায়েতের সিঙ্গা হাট অবধি গাড়ি গেল। তারপর মেঠো পথ ধরে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে একটি নড়বড়ে বাঁশের সেতু দিয়ে একটি ছোটো নদী পেরিয়ে মানুষের মাথা ছাড়ানো বিশাল হোগলা বনে প্রবেশ করে দেখলাম একটি মৃত শিশুর অন্ত্যেষ্টি র ব্যবস্থা হচ্ছে। ক্রন্দনরত শিশুটির বাবার সাথে কথা বলে অজানা জ্বরে মৃত শিশুটিকে পরীক্ষা করা হল। একইরকম হঠাৎ জ্বর, তারপর খিঁচুনি তারপর অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। সঙ্গে সঙ্গে রশিদপুর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এবং সেখান থেকে মালদা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গিয়েও কিছু করা গেলনা। ওখান থেকে শান্তিপুর গ্রাম টিতে গেলাম। একমাত্র বংশধর মৃত অন্য শিশুটির পরিবার এতোই শোকগ্রস্ত যে আমাদের সাথে কোন কথা বলতে চাইলেন না। গভীর বেদনা নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রাতে ফিরে এলাম।
অবস্থার পরিবর্তন:
উপরোক্ত ঘটনাগুলি আমাদের খুব ব্যাথিত করে। ঝড়ের মতো রোগটি এসে কয়েকটি প্রাণ নিয়ে আবার নিজে নিজে থেমে যায়। রোগের উপসর্গ লক্ষ্মণ গতিপ্রকৃতি দেখে আমাদের জাপানি এনকেফেলাইটিস মনে হয়। বিভিন্ন জার্নাল ইত্যাদি খুঁজে বুঝতে পারি প্রতি বছর বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী সময়ে উত্তরবঙ্গের জেলা গুলিতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয় এবং বেশ কিছু প্রাণ কেড়ে নেয়। এর না হয় কোন অনুসন্ধান (Investigation), না হয় জানানো (Reporting)। স্থানীয়ভাবে অজানা জ্বর নামে চালিয়ে দেওয়া হয়, এখানকার সাধারণ মানুষও তাদের ভাগ্য হিসেবে এটা মেনে নেন। আরও অধ্যয়ন করে দেখা গেলো পূর্ব উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর কে কেন্দ্র করে দিল্লি থেকে অসমের শিবসাগর অবধি JE – র প্রধান বলয় যেখানে ভারী বর্ষা, প্রবল গরম ও আদ্রতা, তার সাথে ব্যাপক ধান চাষ এবং ধান জমিতে ঘোলা জল জমে অন্য জায়গা থেকে জীবাণু নিয়ে আসা ও বহন করা বক জাতীয় পাখিদের পর্যাপ্ত খাদ্য সম্ভার প্রাপ্তির জন্য বিচরণ, তারসাথে JE – র বাহক কিউলেক্স মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ, তার সাথে জীবাণুর অপর বাহক শুয়োর পালন, এই রোগের বাড়বাড়ন্ত র কারণ।
এই রোগের কিন্তু কার্যকর টিকা আছে। অথচ উত্তর বঙ্গের জেলা গুলিতে এই টিকাকরণ হয়না। আমরা রাজ্য ও আঞ্চলিক স্তর এ বিভিন্ন সভা ও মঞ্চে উত্তরবঙ্গের জেলা গুলিতে JE টিকাকরণের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। শেষে রাজ্য কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালেন যে আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি তাহলেই কেন্দ্রকে প্রস্তাব দেওয়া যাবে। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার আমরা কিভাবে প্রমাণ করবো? জেলায় একজন প্যাথলজিস্ট। Eliza পরীক্ষা তখন কেবল কলকাতার NICED এবং উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে সীমাবদ্ধ কিছু ক্ষেত্রে হতো। তবুও আমরা দমে গেলাম না।
একবছর বাদ দিয়ে তার পরের বছর ২০১২ তে এক ভয়ানক AES Outbreak শুরু হলো আমাদের জেলা সহ সারা উত্তরবঙ্গতে। আগেরবার দুটি ব্লকে সীমাবদ্ধ ছিল, এবার সব ব্লকে ছড়িয়ে পড়লো। এর সাথে ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু এবং শিশুদের Foot and Mouth Disease অর্থাৎ একসাথে চারটি সংক্রামক রোগের মহামারি। সীমিত পরিকাঠামো ও লোকবল নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। তবুও আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সকাল থেকে রাত অবধি সারা জেলা চষে বেড়াতাম। সাধারণ প্রশাসন, পঞ্চায়েত, স্কুলের শিক্ষক, বিএসএফ, মিশনারী সবাইকে মহামারি প্রতিরোধে নামানো হল। হাজার হাজার এক পাতার লিফলেট জেলা জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হল যাতে কয়েকটি মাত্র গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ ছিল রোগ প্রতিরোধে। ঐ টিই সমস্ত সিনেমা ও গ্রামের ভিডিও হলে দেখানো হতো। হাসপাতালের আউটডোর ছাড়াও বেশ কিছু Fever Clinics খোলা হলো। ম্যালেরিয়া সহ রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা হলো। এর সাথে স্প্রে, fogging ইত্যাদি শুরু হলো।
ব্লকের স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সন্দেহজনক AES রোগীদের রক্ত টেনে ভ্যাকসিন ক্যারিয়ারের মধ্যে সঠিক তাপমাত্রায় জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হতো। সেখানে দরদী জেলার একমাত্র প্যথোলজিস্ট সারাদিন কাজের শেষে Centrifuge Machine এ সেগুলি পৃথক করতেন। আমাদের দরদী দুজন গ্রুপ ডি কর্মী একদিন একজন পরেরদিন আরেকজন রাতের বাসে করে বালুরঘাট থেকে পরেরদিন ভোরে শিলিগুড়ির নিকটবর্তী সুশ্রুতনগরে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগে সেই Serum নমুনা পৌঁছে দিতেন এবং আগের দিনের রিপোর্ট সংগ্রহ করতেন। এক অসামান্য দরদী Microbiologist সমস্ত বাধার মধ্যেও পরীক্ষা গুলি করে দিতেন।
আমরা ৩৮৪ টি জ্বর ও অনান্য উপসর্গের রোগীর মধ্যে ২০৮ জনের রক্তের Serum এর নমুনা পাঠাতে পেরেছিলাম। এর মধ্যে তিনজনের JE প্রমাণিত হলো। ছয়জনের ক্ষেত্রে পরীক্ষার রিপোর্ট equivocal হলো অর্থাৎ হতেও পারে, নাও হতে পারে। চারজনের ডেঙ্গু পজিটিভ ও ৪০ জনের রিয়্যাক্টিভ হলো। দুইজনের Chikungunya পজিটিভ হল। অন্যান্য জেলাও রাজ্যকে JE – র অকাট্য প্রমাণ দিলো। এক মাসের বেশি সময় জুড়ে ভয়ঙ্কর JE সহ চারটি রোগের মহামারি দাপাদাপি চালিয়ে সাতটি মূল্যবান প্রাণ নিয়ে অবশেষে সেবারের মত প্রশমিত হলো। এর কয়েকমাস বাদে জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউসে একটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় আমাদের ডেকে বলা হল উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে JE টিকাকরণ শুরু হবে, প্রস্তুতি নিতে। তখন আমাদের আনন্দের আর সীমা নেই। ২০১৪ সালে পুনরায় বদলি নিয়ে যখন অন্য জেলায় যাচ্ছি তখন উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে JE টিকাকরণ শুরু হয়েছে যা পরবর্তীতে নিয়মিত টিকাকরণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
পরবর্তীতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জনস্বাস্থ্যের দায়িত্বে থাকার সময় আরেকবার JE outbreak এর সম্মুখীন হই। প্রথম রোগীটি একটি ১০ – ১১ বছরের বালক সোনু। এক বিহারী দরিদ্র রিক্সায়ালার সন্তান। কলকাতা পুরসভার দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির মধ্যে খুঁটির উপর কোনরকম ঘরে বসবাস। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন এর চিকিৎসকরা যত্ন করে ওকে বাঁচিয়ে তুলেছিল। এর পর কিছু শিশু আক্রান্ত হয় মগরাহাট, ক্যানিং ইত্যাদি ব্লকে।
JE এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধ:
নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। শিরায় ইমিউনোগ্লোব্যুলিন এবং ভাইরাস ধ্বংসকারী রিবাভিরিন দিয়ে চেষ্টা হলেও সফল হয়নি। পার্শ্ব চিকিৎসা (Supportive Treatment) এবং পরে জীবিতদের ক্ষেত্রে পুনর্বাসন (Rehabilation) কাম্য। Supportive Treatment এর মধ্যে জ্বর ও খিঁচুনির নিয়ন্ত্রণ, Mannitol ইত্যাদি দিয়ে মস্তিষ্কের চাপ কমানো, শ্বাসনালীর যত্ন, ফ্লুইড ও পুষ্টির সঠিক ব্যবস্থা, Life Care Support।
প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রধান অস্ত্র টিকাকরণ। বর্তমানে Live Attenuated SA 14 – 14 – 2 Vaccine ব্যবহৃত হয়। শিশুদের টিকাকরণের সময় নয় ও ১৮ মাসে দুটি ডোজ দেওয়া হয়। যাদের দেওয়া যায়নি বা প্রাপ্ত বয়স্কদের চার সপ্তাহ গ্যাপ দিয়ে দুটি ডোজ দেওয়া হয়। পোষা শুয়োর দের ক্ষেত্রেও টিকা দেওয়া উচিত।
বাহক মশা নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। Landscaping করে জমিতে ঢাল সৃষ্টি করে কৃষি ক্ষেত্রে জমা জল বের করে দিলে বা ঘোরাতে (Rotation) পারলে মশা জন্মাতে পারবেনা। এছাড়াও ঘরের মধ্যে ও বাইরে চারিদিক পরিষ্কার রাখতে হবে। গরু, ছাগল, শুয়োর ও হাঁস মুরগি র খোঁয়াড় কিছুটা তফাতে ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ভোরে ও বিকেলে ঘরে ও খোঁয়াড়ে নিমপাতা ইত্যাদি পোড়ানো যেতে পারে।
এবার হচ্ছে ব্যাক্তি প্রতিরক্ষা। ঢাকা সুতির পোশাক পরতে হবে। ঘুমানোর সময় মশারির মধ্যে শুতে হবে। কৃষিকাজের সময় গাম বুট পরতে পারলে খুব ভালো হয়।
সামগ্রিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সরকারের ও স্বাস্থ্য দফতরের তরফে হাসপাতালে PICU, ITU, PMR পরিষেবা সহ চিকিৎসা ও পরিষেবা বৃদ্ধি, ১০০ % টিকাকরণ, রোগের উপর নজরদারি (Surveillance), আগে থাকতে সতর্কতা (Early Warning), Outbreak Investigations, Laboratory এর সংখ্যা ও সুবিধা বৃদ্ধি, পরিযায়ী পাখি ও শুয়োরের উপর নজরদারি, বিভিন্ন পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির উপর জোর দিতে হবে। আর এভাবেই সম্মিলিত চেষ্টায় এই ভয়ঙ্কর রোগ থেকে আমাদের দেশ ও সমাজ মুক্তি পাবে।
০৭.০৪.২০২৪