সেক্স বা যৌনতা নিয়ে ভারতীয় সমাজে ঢাকঢাক-গুড়গুড় অপরিসীম। জীবজগতের এই চরম সত্যিকে আমরা সবসময় লুকিয়ে রাখতে ও এড়িয়ে যেতে পছন্দ করি। যুগ পাল্টে গেলেও, আজও বিশেষতঃ পরিবারের মধ্যে এবং বিদ্যালয়ে যৌনশিক্ষা ও সেসব নিয়ে আলোচনা সাংঘাতিক ট্যাবু বলে মনে করা হয়। ফলতঃ, বয়ঃসন্ধিকালে যে স্বাভাবিক যৌনচেতনা এবং যৌনশিক্ষা গড়ে ওঠার কথা- তা হয় না। কিশোর বয়সে আমাদের দেশের ভবিষ্যত নাগরিকরা সঠিক যৌনশিক্ষা না পেয়ে দিশাহীন হয়ে কেউ অর্বাচীন বন্ধুবান্ধবের থেকে, কেউ বা কিছু বটতলার বই পড়ে বা অশ্লীল ভিডিও দেখে ভ্রান্ত ও বিকৃত ধারণার শিকার হয়। নীট ফল? যৌন সুরক্ষার দফারফা। যৌনবাহিত রোগের বাড়বাড়ন্ত। আমাদের সমাজ ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নে এক নম্বর না হলেও, বেশ উপরের দিকে।
এমনও হয়েছে স্কুলের জীববিজ্ঞান ক্লাসে শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের ব্যাঙের প্রজননতন্ত্র পড়াননি, পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কারন সেটা নাকি যৌনগন্ধী বিষয়- পড়লে ছেলেমেয়েরা খারাপ হয়ে যাবে! অবশ্য যে দেশে আইনের ধারক-বাহকরা বিধান দেন ময়ূরের জন্ম ময়ূরীর চোখের জল থেকে, যে দেশে প্রকাশ্যে চুম্বন নিষিদ্ধ কিন্তু প্রকাশ্যে ব্যক্তিগত সম্পদ বের করে রাস্তাঘাটে মূত্রত্যাগ আইনত নিষিদ্ধ নয়- সে দেশে আর কীই বা আশা করা যায়।
যাই হোক, আমি চিকিৎসক, চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে ফিরি।দুর্ঘটনা বা অন্য রোগে হাত-পায়ের জোর হারিয়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে অথবা আরও অনেক রোগে অকালে চিরজীবনের মতো যৌন সক্ষমতা হারায় বহু মানুষ। যৌবনে বা মধ্যবয়সে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলে রোগী এবং তার পরিবারের উপর এর অভিঘাত হয় বহুদূর। অথচ আমরা সকলে অর্থ্যাৎ পরিবার, সমাজ এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা মিলে শুধু তার হাত-পায়ের দুর্বলতা, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, প্রস্রাব-পায়খানা করার অপারগতা, বেডসোর, পুষ্টি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু দুর্ঘটনা ও অসুখজনিত যৌন অক্ষমতা এবং তজ্জনিত মানসিক অবসাদ চুড়ান্ত অবহেলিত এবং অনলোচিতই থেকে যায়।
আমি নীতিপ্রণয়ক নই, গবেষক নই- কেবলমাত্র শল্যচিকিৎসক। তাই শুধু নিজের কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে সমস্যার উপর আলোকপাত করে যাই।
ঘটনা ১
———
আমি তখন সরকারি হাসপাতালে চাকরি করি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে তার এক আত্মীয় বাড়িতে নিয়ে গেল। ছেলেটির বয়স ত্রিশ। দু’বছর হল বিয়ে হয়েছে। সন্তান তখনও হয় নি। হঠাৎ একদিন তার প্রবল কোমরে যন্ত্রণা শুরু হয়, সায়টিকা এবং পা দুটো অবশ ও দূর্বল হয়ে যায়। প্রস্রাবও বন্ধ হয়ে যায়। টিপিকাল স্লিপ ডিস্ক এবং কডা ইকুইনা (Cauda equina) সিনড্রোম।
সার্জারির সিদ্বান্ত নিতে দেরি হয়ে গিয়েছিল সাতদিন। ফলতঃ টেকনিক্যালি অত্যন্ত সফল স্পাইন সার্জারির পরেও প্রস্রাবের কন্ট্রোল আর ফিরল না। তবে পায়ের জোর কিছুটা বাড়ল। রোগী খুঁড়িয়ে হাঁটছে তখন। প্রস্রাবের ব্যবস্থাও হয়েছে ইউরোলজিক্যাল অপারেশন করে। কাজেও যোগ দিয়েছে। কিন্তু রোগী বলল, ‘আমার আরও সমস্যা আছে। আমি আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।’
‘ঠিক আছে।’
এরপর রোগী আমাকে একান্তে যা বলল তার মূল কথা হল- তার বাকি অক্ষমতাগুলোর মোটামুটি একটা সমাধান হয়েছে। কিন্তু সে এই অকাল বয়সে তার যৌন ক্ষমতা চিরকালের মতো হারিয়েছে।
‘আমার স্ত্রীকে দেখেছেন তো! পঁচিশ বছর বয়স। ওর কী দোষ বলুন? আমার ইচ্ছে, ওকে মুক্তি দেওয়া। ও নতুন জীবন শুরু করুক। কিন্তু দুই বাড়ির প্রবল আপত্তিতে তা সম্ভব হচ্ছে না।’
হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। সে আরেক গল্প।
ঘটনা ২
———-
নদিয়ার সীমান্ত ঘেঁসা শহর থেকে বছর পঁয়তাল্লিশ-এর অমিত মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) যখন আমার চেম্বার-এ প্রথম আসে তখন সে হুইল চেয়ার বন্দী। মেরুদন্ডের ঘাড়ের অংশে স্পাইনাল কর্ড ভয়ানক চাপে ছিল (Compressive myelopathy) তিনটে জায়গায়।
অপারেশন করে হাড় কেটে নার্ভ ও স্পাইনাল কর্ড কে চাপ মুক্ত করে প্লেট-স্ক্রু লাগিয়ে দিলাম। রোগী আবার স্বাভাবিক হল প্রায় তিন চার মাস পরে। ছ’ মাসের মাথায় রুটিন চেক আপে এসে অমিত মণ্ডলের স্ত্রী অমিতকে বললেন, ‘তুমি একটু বাইরে বসো। আমার ডাক্তারবাবুর সাথে জরুরি কথা আছে।’
ঘরে তখন রোগীর স্ত্রী, নার্স এবং আমি।
বললাম, ‘বলুন।’
‘ডাক্তারবাবু, আপনি কি এক অপারেশন করেছেন?’
‘মানে? পেসেন্ট তো ভালো হয়ে গেছে, সম্পূর্ণ সুস্থ।আর কী চাই?‘
মনে মনে ভাবলাম – কিসে যে এরা সন্তুষ্ট হবে কে জানে!
‘আপনার পেসেন্ট একটু বেশি-ই ভালো আছে।’
‘বুঝলাম না।’
‘কী আর বলব? রাতে আমাকে ছাড়তেই চায় না। বারণ করলেও শোনে না।’
আমি ভদ্রমহিলার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কী চান?’
উনি ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আমতা আমতা করে বললেন, ‘কিন্তু এতে কোন ক্ষতি হবে না?’
‘না, ছ’মাস হয়ে গেছে। আর কিছু হবার চান্স নেই। নিশ্চিন্তে করুন।’
স্বামী-স্ত্রী খুশি মনে বিদায় নিল।
ঘটনা ৩
———-
তখন মেডিক্যাল কলেজে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করি। ডাঃ বক্সী এক যুবকের হিপ জয়েন্ট ভাঙা সারানোর অপারেশন করেছেন। সে এক কঠিন অপারেশন- ডাঃ বক্সীর নিজের আবিষ্কার – muscle pedicle bone grafting। এতে অপারেশনের পরে তিন-চার মাস রোগীকে সম্পূর্ণভাবে বিছানায় শুইয়ে রাখা হত। তবে সময় নিলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কোমরের ভাঙা হাড় জুড়ে যেত, যেটা সাধারণ অপারেশন-এ সহজে হত না।
সেদিন রোগী এলো অপারেশান-এর চার মাস বাদে। রোগীর হিপ জয়েন্টে আবার ব্যথা শুরু হয়েছে। স্যারের কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। হঠাৎ আমার সিনিয়র পিজিটি বলল, ‘স্যার, এই পেশেন্ট গন্ডগোল পাকিয়েছে।’
‘কিরকম।’
‘ইন্টারকোর্স করে ফেলেছে।’
‘হাই রে! সর্বনাশ। সে তো ভিগোরাস এক্সারসাইজ! এসব যে করা যাবে না তা তোমরা বলে দাও নি? কী যে কর!’
আমরা সকলে মাথা নিচু করে স্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আর স্যার ‘ভিগোরাস এক্সারসাইজ, ভিগোরাস এক্সারসাইজ’ বলে বিড় বিড় করতে থাকলেন।
সেবার সেই ভিগোরাস এক্সারসাইজ-এর ঠেলায় কোমরের ভাঙা হাড় জুড়ল না সেই রোগীর!