ন্যাশানাল মেডিক্যাল থেকে শ্যামনগর যাতায়াত করা কিন্তু আমার পক্ষে উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে উঠছিল। ডাক্তারির পড়া আর হায়ার সেকেন্ডারির পড়া এক নয়। ক্লাস, ডিসেকশন, আইটেম—সব মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে, সন্ধে গড়িয়ে রাত নামত। আর ফিরেই আমি ঢুলতাম—নিজের পড়া তৈরির সময়ই পেতাম না।
এ তো আর এগারো বারো ক্লাসের পুকুর নয়— এ তো সমুদ্র! সারা পশ্চিমবঙ্গের(এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্যেরও) বাছাই করা ছেলেমেয়েরা এখন সহপাঠী আমার— পরীক্ষাপর্বগুলোয় আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে তাদের সঙ্গে, যারা রাজ্যওয়াড়ি ফলাফলের নিরিখে, আমার চেয়ে দশকদম এগিয়ে— সুতরাং, স্কুলের সেকেন্ড থার্ড কিম্বা ইলেভেন টুয়েলভের ফিফথ সিক্সথ থেকে, এখানে কোনোমতে পাশ করে অস্তিত্বরক্ষার চিন্তাটাই বড়ো হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। প্রসঙ্গত, ডাক্তারিতে পাশ নম্বর ছিল ৫০%, আর থিওরি-ভাইভা এবং প্র্যাকটিক্যালে আলাদা করে পাশ করতে হতো।
কলেজে এসেই দুটো অস্বস্তিকর ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমাকে।
প্রথমত, এই প্রথম ইউনিফর্ম বিহীন পড়াশোনার জগতে পা রাখা আমার—অস্বাভাবিক রকমের কুন্ঠিত লাগত, রঙিন সালোয়ার কামিজ পরে ক্লাসে বসে রোলকলের ডাকে ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ বলতে। প্রথম দিন ক্লাস করে ফিরে, মাকে বলেছিলাম, —‘আমাকে সাদা-নীল দু’সেট সালোয়ার কামিজ করিয়ে দাও না মা, ওরকম গো অ্যাজ ইউ লাইকের ফ্যান্সি ড্রেস পরে কলেজ যেতে আমার কেমন কেমন লাগে’!
মা উত্তরে বলেছিল—‘দূর পাগল মেয়ে—তুই একা ইউনিফর্ম পরে গেলেই কি অস্বস্তি কাটবে? যখন দেখবি, অন্য স্টুডেন্টরা সেই রঙিন পোশাক আশাক পরেই আসছে, শুধু তুইই নীল সাদা ইউনিফর্মে, তখন আরো আউট অফ দ্য প্লেস লাগবে, দেখিস। এই জড়তাটা কেটে যাবে ক’দিন বাদে—আমারও হয়েছিল — ইস্কুল থেকে প্রেসিডেন্সিতে ঢোকার পর পরই— কেটেও তো গেছে সেসব’—
দ্বিতীয় গন্ডগোলটা আরেকটু জটিল। একটানা বারো বছর গার্লস স্কুলে পড়ার পর এই প্রথম, আমার কো এডুকেশন বাতাবরণের সঙ্গে পরিচয় ঘটল। সত্যি বলতে কি, অসহ্য লেগেছিল!
চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল(ওইটাই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাল নাম) আর কলেজ ক্যাম্পাস ছিল আলাদা। মাঝখানে পরিখার মতো রাস্তা, সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউ। কলেজে ঢোকার দুটি মূল ফটক। একটি, অ্যানাটমি বিল্ডিংএর পাশ দিয়ে, মেজদার ক্যান্টিনের গা ঘেঁষে—সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউয়ের দিক দিয়ে ঢোকার পথ। অন্যটি, স্টেট ফরেনসিক ল্যাবরেটরির পাশের রাস্তা দিয়ে, লেডিজ হোস্টেলের সামনে দিয়ে কলেজে ঢোকার রাস্তা। আমার মনে আছে, প্রথম দিন আমি দ্বিতীয় রাস্তা দিয়ে ঢুকেছিলাম। বাঁয়ে চারতলা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং, যার দোতলায় অডিটোরিয়াম, আর তিন চারতলা মিলে লেডিজ হোস্টেল। ঐ বাড়িটারই এক অংশে প্রিভেনটিভ এন্ড সোশ্যাল মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট। আরো এগোলে একটা উল্টোনো ইউ শেপের তিনতলা বিল্ডিং দেখা যাচ্ছিল, যার কোণগুলো গোল নয়, একদম ৯০ ডিগ্রিতে বাঁকানো। ওগুলো ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফরেনসিক মেডিসিন, প্যাথোলজি আর ফার্মাকোলজি ডিপার্টমেন্ট। ওই বিল্ডিংএরই তিনতলায় লাইব্রেরি আর একতলায় বুকস্টোর। আর সবশেষে লেডিজ হোস্টেলের উল্টোদিকে, মর্গ আর ডিসেকশন হল সহ অ্যানাটমি বিল্ডিং।
এই আয়তাকার ক্ষেত্রের ঠিক মধ্যখানে ছিল একটি সুদৃশ্য বাগান আর সেই বাগানকে ঘিরে অনুচ্চ পাঁচিল। আমি কলেজগেট দিয়ে ঢুকেই দেখলাম অগুন্তি ছেলে(এবং কিছু মেয়েও) সেই পাঁচিলের উপর বসে অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে পা দোলাচ্ছে। আর গেট দিয়ে কোনো নবাগত ঢুকলেই—‘হাই! ফার্স্ট ইয়ার?’ প্রশ্নে স্বাগত জানাচ্ছে। জবাব ইতিবাচক হলেই—‘আয় আয়! আমরাও’—বলে আপন করে নেওয়া—এবং পরিচিত অপরিচিত নির্বিশেষে তুই সম্বোধনে অভিষিক্ত করা— কনভেন্টোচিত ভিক্টোরিয়ান মরালিটি শিক্ষায় আপাদমস্তক স্নাত, সুকানিয়া ব্যানার্জির পক্ষে প্রথম দর্শনেই হজম করে নেওয়া, কেবল মুশকিল নয়— অত্যন্ত ভীতিকর হয়ে উঠল।
ক্লাস আরম্ভ হবার কিছুদিন পরের কথা। দিনটা বুধবার। একটু জ্বরোভাব ছিল বলে কলেজ যাইনি সেদিন। বাবা কলকাতা গিয়েছিল। লেবার কমিশনারের সঙ্গে মিটিং ছিল। কোয়ার্টারে আমি আর মা। সন্ধে ঘনাবার মুখে একটা ফোন এলো। আমাদের বাড়িতে কলকাতা টেলিফোনসের লাইন ছিল না। কারো বাড়িতেই ছিল না তখন। ফোনটা ইন্টারকম। তুললাম। ওপাশে লেবার অফিস থেকে বাবার জুনিয়র একজন ট্রেনি অফিসারের গলা পেলাম।”আমি দাশগুপ্ত বলছি। লেবার অফিস থেকে—”
“বাবা তো বাড়ি নেই। কলকাতা গেছে। অফিসেরই কাজে।”
“জানি–” গলাটা একটু দ্বিধান্বিত শোনায়—“ম্যাডামকে একটু দেওয়া যাবে—”
মাকে চাইছে!
আমি গলায় একটা ভারিক্কি ভাব এনে বলি—“যা বলার আমাকে বলতে পারেন। মা একটু রেস্ট নিচ্ছে।”
আরো নিচু হয়ে যায় ওপাশের গলা—“না, মানে, একটা দুঃসংবাদ আছে— নোয়াপাড়া থানা থেকে জানিয়েছে—”
কি জানিয়েছে, কোথা থেকে জানিয়েছে, শোনার মতো ধৈর্য আর রইল না আমার। সমস্ত ভারিক্কি ভাব ভাসিয়ে, আমি তখন রিসিভার আঁকড়ে চিৎকার করে উঠেছি—“কি হয়েছে বাবার? অ্যাকসিডেন্ট?” — অন্য কোনো দুঃসংবাদের কথা মাথাতেই আসেনি মুহূর্তের জন্যও।
আমার চিৎকারে মা পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছে আলুথালুভাবে।”কি? কি হয়েছে খুকু? কার ফোন?”
লেবার অফিসার দাশগুপ্ত খুব ঠান্ডা গলায় আস্তে আস্তে বলেছিল—“ব্যানার্জি সাহেবের কিচ্ছু হয়নি। কলকাতার মুচিপাড়া থানায় এলাকাতে আপনাদের কোনো রিলেটিভ থাকেন কি?”
মুচিপাড়া! মুচিপাড়া থানা! বৌবাজার! রিসিভার কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠি এবার—” হ্যাঁ, আমার মামার বাড়ি ওখানে! কি হয়েছে?”
“আসলে আমাদের মিলের এক্সটার্নাল লাইনটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে দুদিন ধরে—তাই ওনারাও লাইন পাননি— খবরটা পেয়ে তাই আমরাও হেড অফিসে ব্যানার্জি সাহেবকে জানাতে পারিনি—”
আমি অসহিষ্ণু এবার—“তখন থেকে খবর খবর বলছেন— খবরটা কি?”— বাবার কিছু হয়নি জেনে, আমার গলায় জোর ফিরে এসেছে ততক্ষণে।
“সেটাই তো বলছি। মুচিপাড়া থানা থেকে আমাদের নোয়াপাড়া থানায় মেসেজ এসেছে, মিস্টার এস কে ব্যানার্জির শাশুড়ি, আজ বিকেলবেলা মারা গেছেন। সেন্ডার অফ দ্য মেসেজ সাম টি কে মুখার্জি— আপনাদের অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল, ওখানে চলে যেতে বলেছেন — বডি বেশিক্ষণ রাখা যাবে না —”
আমার শ্লথ হাত থেকে রিসিভারটা খসে গেল। আমি মুখ ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের মুখ কাগজের মতো সাদা। দু চোখ খটখটে শুকনো।খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে মা ফিসফিস করে বলল —“মা চলে গেল, না রে?”
বাবা কলকাতায়। খবর দেওয়ার রাস্তা নেই। যখন বাবা ফিরবে, তখন অনেক রাত হয়ে যাবে। আমরা যদি তখন রওনা দিই, দিদার দাহকাজ হয়ে যাবে। মা দেখতে পাবে না শেষবারের মতো। এদিকে মায়ের যা অবস্থা, ট্রেনে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া, জোর বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে তখন। আগস্ট মাস।
আমি আবার ডায়াল ঘোরালাম ইন্টারকমের। যা ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে।
গাড়ি একটা জোগাড় হলো। স্পিনিং ডিপার্টমেন্টের মজদুর বটুকনাথ পান্ডের লঝঝড়ে জিপ। ড্রাইভার বটুকনাথেরই ছোট ভাই শ্রীনাথ।
দাশগুপ্তের ফোনটা আসার মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, ব্যাগে কিছু টাকা ভরে, কোয়ার্টারের দরজায় তালা লাগিয়ে শোকস্তব্ধ মাকে নিয়ে, আকাশভাঙা বৃষ্টি মাথায় করে ঐ লঝঝড়ে জিপে চড়ে বসলাম আমি। লেবার অফিসে ফোন করে বলে দিলাম, বাবা ফেরামাত্র যেন খবরটা জানিয়ে বাবাকে কলকাতা আসতে বলা হয়। আমি জানতাম, শ্যামনগর থেকে কলকাতা যাওয়ার লাস্ট ট্রেন রাত সাড়ে এগারোটায়।
ঘোষপাড়া রোড ধরে ব্যারাকপুর। সেখান থেকে বি টি রোড ধরে শ্যামবাজার। তারপর বিধান সরণি, আমহার্স্ট স্ট্রিট হয়ে বৌবাজার।
একটা, শুধু একটা ঘটনার অভিঘাতে খুকু যেন এক ধাক্কায় অনেকটা বড় হয়ে গেল।
ক্লাস শুরু হওয়ার মাস চারেকের মাথায় হোস্টেল পেয়ে গেলাম আমি। ডর্মিটরিতে একটা লোহার খাট আরএকটা জংধরা লকার। কিছুদিন পরে যখন একটা থ্রি সিটার রুম পেলাম, আগের সম্পত্তির সঙ্গে যোগ হলো একটা কাঠের চেয়ার, টেবিল, আর রুমের তিনজনের জন্য একটা পাঁচশ ওয়াটের ছোট্ট হিটার।
ট্যালটেলে ডাল, প্রায় মাইক্রোটোমে কাটা পাতলা পাতলা সিলভার কার্পের ঝাল, কুঁদরির তরকারি আর শক্ত মোটা চালের ভাতের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয় হলো আমার।
উঁহু, ভুল বললাম। আমার সাথে সাথেই আরো কয়েকজন মেয়ের — যাদের পোশাকি নাম হলো ‘হোস্টেলাইট’।
তা, এই নিজগৃহকক্ষচ্যুত নক্ষত্রবিহীন স্যাটেলাইটের দল খুব তাড়াতাড়িই পরস্পরকে জড়িয়ে বাঁচতে শিখে গেল প্রতিকূল অপরিচিত পরিবেশে — হয়ে উঠল একটাই পরিবার।
মানুষ যখন ক্ষুদ্র পরিমন্ডলে আবদ্ধ থাকে, তখন তার নিজের সাফল্য-ব্যর্থতার মতো নিজের দুর্ভাগ্য বা নিজের লড়াইটাকেও খুব বড়ো করে দেখে। ‘আমার মতন কষ্ট করে কেউ জীবন কাটাচ্ছে না’ বা ‘আমার মতন জীবনের প্রতি পদে এত বাধার সম্মুখীন আর কাউকে হতে হয় নি কখনো’ — ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু যে মুহূর্তে নিজের ছোট্ট কুয়োটা থেকে সে বাইরে বেরোতে শেখে, চোখ মেলে চেয়ে দেখে বিশাল পৃথিবীকে, শোনে আরো কত সহমানবের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা, তার নিজের যুদ্ধটা নিজের কাছেই বড্ড অকিঞ্চিৎকর হয়ে ওঠে।
আমার ক্যালিডোস্কোপিক ছোটোবেলাকে আমি অনন্য মনে করতাম। হোস্টেলে এসে আমার সহপাঠিনী বোনেদের অভিজ্ঞতার ভাগ নিলাম যখন, আমার অনুভবগুলো বড় ম্লান মনে হলো — নিজের কষ্টে এত কাতর হয়েছি, ভেবে লজ্জিত হলাম মনে মনে।
সপ্তাহান্তে বাড়ি যেতে পারব, রোজ নয়, এ কথা ভেবে মন খারাপ করার কথা মনেও এলো না, যখন জানলাম সোমার বাড়ি আসানসোল,রমা এসেছে দুর্গাপুর থেকে, আর রোমা? সে এসেছে সুদূর আগরতলা থেকে।
যে সময় আমার বাবা এসে আমাকে শ্যামনগর থেকে পার্ক সার্কাস পৌঁছে দিয়ে যায় — তখন একটা আঠারো বছরের মেয়ে একা ঢাউস সুটকেস নিয়ে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে ‘বায়ুদূতে’ চড়ে বসে — জঙ্গি অধ্যুষিত, প্রায় যোগাযোগের মানচিত্রের বাইরে থাকা একটি রাজ্যে ফিরবে বলে।
লরেটো হাউস থেকে পাশ করে, শক্ত ব্রিটিশ ইংরেজিতে লেখা অ্যানাটমির টার্ম বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে না হওয়া সুকন্যার পক্ষে বোঝা কি সম্ভব, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, দক্ষিণ বারাসতের স্কুল থেকে উঠে আসা রীণার পরিশ্রমকে?
অল্প জ্বরজ্বারিতেই কাতর হওয়া আমার কাছে কতটা বিস্ময়কর ছিল, মাইট্রাল ভালভ প্রোলাপস নিয়ে, এতদূর আসা নীপার লড়াইটা? যে বয়সে আমরা জ্বর হলেও ওষুধ খেতাম কালেভদ্রে, নীপাকে তখনি নিয়মিত খেতে হতো ‘হার্টের ওষুধ’!
আর সুখলতা মান্ডি? আমার রুমমেট? শীতের গভীর রাতে, শহর ঘুমিয়ে পড়লে, যখন পার্ক সার্কাস ময়দানের সার্কাসের তাঁবু থেকে ভেসে আসত সিংহের গর্জন আর হাতির বৃংহণ — সুখলতাদি হাসত —“তুই বুনো হাতি দেখেছিস, সুকন্যা?”
“তুমি দেখেছ বুঝি?”
“আমি তো হাতির দেশেরই মেয়ে রে। গরমের দিনে উঠোনে খাটিয়া পেতে ঘুমোতে খুব আরাম — ঘরে গরম তো খুব — খালি একটাই ভয়, জানিস? পাঁচিলটা মাটির তো, হাতি আসে প্রায়ই — ভেঙে দিয়ে উঠোনে চলে এলে বড় বিপদ!”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো, চিত্রার্পিতের মতো শুনতাম, ঝাড়গ্রাম থেকেও তিনঘন্টা বাসজার্নি করে পৌঁছতে হয় যে গ্রামে, তার নাম চাকাডোবা, সেখানে আট ভাইবোনের একজন হয়ে কলকাতার ইউনাইটেড মিশনারি, বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ পাড়ি দিয়ে, সুখলতাদি কেমন করে পার্ক সার্কাসের মেডিক্যাল কলেজের লেডিজ হোস্টেলের রুম নম্বর ৫২তে এসে পৌঁছলো, আমার কাছে।
কি যেন ভেবেছিলাম আমি — আমার লড়াইটা খুব কঠিন ছিল?
ধীরে ধীরে হোস্টেলবাসের কাঠিন্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে আসছিল মন। শনিবার ফেরা। আবার সোমবার আসা।
মাঝের দিনগুলোয় ক্লাস, টিউশন, পড়া মুখস্থ, খুনসুটি, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঝন্টুর রোল, সপ্তাহের খরচ বাঁচিয়ে এক আধখানা সিনেমা, টিভিতে লেট নাইট ক্লাসিক — এইসব চলছিল।
বাড়িতে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়ে আসছিল দ্রুত। অপছন্দের কোর্সে ভর্তি হওয়ার বেদনা অনেকটাই মিলিয়ে দিয়েছিল হোস্টেলাইট সহোদরাদের দল। তাই মায়ের উপর পুরোনো রাগের কিছুই বিশেষ আর অবশিষ্ট ছিল না আমার। বরং ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল এক চিরন্তন, দীর্ঘস্থায়ী অসম বন্ধুত্ব — আজ এই বয়সে এসে বুঝি, আমার চেয়ে বড় বন্ধু মায়ের কেউ কোনদিন ছিল না। আমারও আর কোনো প্রকৃত বন্ধু তৈরি হলো কি জীবনে, মা ছাড়া?
ঐ ঝোড়ো বয়ঃসন্ধিকালে হঠাৎ গৃহছেঁড়া হয়ে গিয়ে কলেজ, বন্ধু, পড়াশোনা, আড্ডা, সিনেমার স্রোতে ভেসে যেতে যেতে খড়কুটোর মতো মায়ের আঁচলটুকুই বাড়ির সঙ্গে আমার নাড়ির বাঁধন হয়ে রইল, বাকি টান গেল ভেসে। বাবার সম্পর্কে প্রাণের টানটা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন আলগা হয়ে এসেছিল আমার, ছোটবেলার আদরকাড়া রঙটাও ফিকে হয়ে গিয়েছিল অনেকটা। বাবাও আমার মন বুঝেই হয়ত দূরে সরে গিয়েছিল খানিকটা, কর্তব্যে নয় মোটেই — তবে পারিবারিক আনন্দ-বেদনার উদযাপনে মাকেই এগিয়ে দিত আমার দিকে। বাবার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার ফলেই হয়ত আমি আর সেভাবে বাবার অফিসের কাজকর্ম, টানাপড়েন ইত্যাদির ব্যাপারে আর বেশি খোঁজখবর রাখতাম না। গুটিপোকা খোলস ছাড়ছিল ধীরে ধীরে, তার নিজস্ব বাইরের জগৎ তৈরি হচ্ছে, ঘরের খবর রাখার সময় কোথায় আর?
এক শনিবার, মা নিতে এসেছিল আমাকে। আসলে, মামার বাড়ি এসেছিল। ফেরার সময়, আমাকে নিয়ে ফিরবে। আমি আবদার করলাম —“এখন তো সবে বেলা তিনটে। চলো না মা, অরুণায় পাঁচটার শো-য়ে হারানো সুর দেখে আসি। আটটার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে তো — আমরা আটটা চল্লিশের লোকাল ধরলে সাড়ে নটার মধ্যে শ্যামনগর পৌঁছে যাব। চলো না মা।”
উত্তমকুমার ছিলেন মায়ের একমাত্র দুর্বলতা। বেশি সাধতে হলো না। আমরা মা-মেয়েতে চলে গেলাম হারানো সুর দেখতে।
ফিরতে একটু রাতই হয়েছিল। মা গজগজ করছিল রিক্সায় উঠে —“এত রাতে, আবার রুটি করতে বসতে হবে। তোর জ্বালায় আর পারি না — ”
“ওবেলার তরকারি আছে তো মা। রুটি না হয় ক্যান্টিন থেকে আনিয়ে নেব।”
“হ্যাঁ, তোর জন্য রাত সাড়ে দশটায় ক্যান্টিন খুলে বসে আছে সব —“হঠাৎই কথা বন্ধ হয়ে গেল মায়ের। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালাম আমি। দূরে দেখা যাচ্ছে মিলের মেন গেট। এত রাতে কিসের জটলা ওখানে? নাইট শিফট তো আধ ঘন্টা আগেই শুরু হয়ে গেছে। কারা সব হল্লা করছে গেটে। গেট মিটিং? এত রাতে?
ততক্ষণে রিক্সাটা গেটের সামনে এসে পড়েছে। ভিড়টা উদভ্রান্ত। ইউনিয়ন লিডার কেদার সিং, লছমনদের দেখতে পেলাম। আরো কিছু পরিচিত মজদুরের মুখ ইতিউতি — রিক্সা থেমে গেছে। গেট বন্ধ।
এরই মধ্যে দেখলাম বাবাকে। মেন গেটের পাশে ছোট গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে। কেউ গিয়ে খবর দিয়ে থাকবে। বাবা রিক্সার সামনে এসে দাঁড়াল। শান্ত মুখ। মা সপ্রশ্নমুখে তাকালো বাবার দিকে। বাবা আস্তে আস্তে বলল —“তোমরা ষোলো নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে কোয়ার্টারে ফিরে যাও। আমার ফিরতে দেরি হবে।” তারপর, একটু দম নিয়ে বলল —
“আজ সন্ধেবেলা হঠাৎ করে মিল লক আউট ডিক্লেয়ার করে দিল শর্মা। মালিকের নির্দেশে। ডানবার বন্ধ হয়ে গেল ডলি — পাঁচ হাজার লেবার এক মুহূর্তে বেকার হয়ে গেল। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না, কিচ্ছু না।”
(ক্রমশ)