১৯৭৮ সালের ১৮ ই নভেম্বর আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোতে ঘটে গেছিল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা! নবনির্মিত জোন্সটাউনে ৯০০ জনের উপর মানুষ একসঙ্গে আত্মহত্যা করলেন! কিন্তু কেন?? কীভাবে?? এতগুলো লোক একসঙ্গে নিজের জীবন শেষ করে দিলেন, কী কারণে?? আসলে কী ঘটেছিল সেদিন?! প্রায় অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যিকারের ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়েছিল আমেরিকা সহ সমস্ত পৃথিবী!
জোন্স টাউনের গল্প শুরু হয়, জিম ওয়ারেন্ জোনস (James Warren Jones)-এর হাত ধরে। জিম জোন্স মোটামুটিভাবে ১৯৫৫ সাল থেকে ধর্মীয় প্রচারক হিসেবে নিজের কাজকর্ম শুরু করেন! আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ এক ধর্মপ্রচারক যিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীন সমতার, প্রগতিশীলতার কথা বলে এক নতুন ধর্মের আয়োজন করতে শুরু করেন! বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে তিনি Peoples Temple (জনগণের চার্চ) তৈরি করতে থাকেন! তার মধ্যে ১৯৫৫ সালে Indianapolis (ইন্ডিয়ানাপোলিস)-এ Peoples Temple তার প্রধান কাজের জায়গা হয়ে ওঠে।
৬০-৭০ এর দশকে তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই বাড়তে শুরু করে যে আমেরিকার বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীরা তাঁর চার্চে এবং কর্মসূচিতে আর্থিক অনুদান করতে থাকেন! কিন্তু তারপরেই জোন্সের চরিত্রের সমস্যার দিকগুলো খোলাখুলি ভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করে! তিনি তাঁর অনুগামীদের সবসময় ভবিষ্যতে খুব বাজে এক বিপর্যয় ঘটবে, আমাদের তার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে- এই কথা বলতে থাকেন! তিনি ভয় পেতে শুরু করেছিলেন হয়তো নিউক্লিয়ার অস্ত্রে তাঁর কর্মসূচি ধ্বংস করে দেওয়া হবে! জোন্স তাই ১৯৬৫ সালে নিজের Peoples Temple-এর মূল কেন্দ্র দক্ষিণ আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে স্থানান্তরিত করলেন! এরপর তিনি তাঁর সামজিক কাজকর্ম বাড়িয়ে তোলেন। প্রচুর টাকা দিয়ে চ্যারিটিমূলক কাজকর্ম করতে থাকেন! তিনি খ্রিস্টান ধর্মের গোঁড়ামিকে আক্রমণ করলেও, মূলত খ্রিষ্টান ধর্ম আর প্রগতিশীল ধারণা একত্রে মিশিয়ে আলাদা একধরনের মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে জোন্স অবতার হয়ে ওঠেন। তাঁর আপাত প্রগতিশীলতার ভাষণ তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে যায়! তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা, চটুলতা ও লোকজনের সাথে মিশতে পারার ক্ষমতা সহজেই আমেরিকানদের মন জয় করে নেয়। Peoples Temple-এর সদস্য প্রায় ৩০০০-এর উপরে গিয়ে দাঁড়ায়!
তাঁর অনুগামীরা জোন্সের অলৌকিক ক্ষমতা আছে এমনটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন।
কিন্তু কিছু মিডিয়া হাউসে জোন্স পরিচালিত কর্মশালা এবং চার্চ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য লেখা হতে থাকে! তাঁর দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করার ক্ষমতা সবই হল ভাঁওতাবাজি। প্রায়ই মারধোর, গালাগালির রিপোর্ট ধরা পড়তে থাকে চার্চগুলোতে। অনেক অনুগামীদের বোকা বানিয়ে তাঁদের সকল সম্পত্তি চার্চের নামে লিখিয়ে নেওয়া হয়। আমেরিকার সরকার জোন্সের কাজকর্মের উপর কড়া নজরদারি শুরু করে! এইসব দেখে জোন্স ভয় পেতে শুরু করলেন! জোন্সের সাংঘাতিক ভাবে প্যারানোইয়িয়া (Paranoia) ডেভেলপ করে! অহেতুক সন্দেহ করতে থাকেন! তিনি তাই তাঁর অনুগামীদের নিয়ে শহর থেকে দূরে সরে পড়লেন! পূর্ব ভেনেজুয়েলার গুয়ানাতে (Guyana) এক চাষবাসের জমিতে গড়ে তুললেন এক চার্চ – আর এক পিপলস টেম্পেল, নাম দিলেন-জোন্সটাউন। কিন্তু মিডিয়া হাউস জোন্সের পিছু ছাড়ল না! জোন্সটাউন নিয়ে একটার পর পর একটা খবর আস্তে শুরু করল- যে সেখানে নাকি মানবধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে!
জোনসটাউনে সদস্যরা প্রতিদিন নিয়ম করে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিত। যেন সুযোগ এলেই সবাই আত্মহত্যা করতে পারে।
১৯৭৮ সালে লিও রায়ান (Leo Ryan) আমেরিকার কংগ্রেস প্রতিনিধি সরজমিনে তদন্ত করার জন্যে জোন্সটাউন পরিদর্শনের কথা বলেন। ১৮ই নভেম্বর তিনি সেখানে তাঁর দলবল নিয়ে উপস্থিত হয়ে বলেন কারও যদি কোনও অভিযোগ থাকে কিম্বা কেউ যদি এখান থেকে ফিরে যেতে চায় তাহলে তাঁকে বলতে পারে। কয়েকজন ফিরে যেতে রাজি হয়ে যায়, কিন্ত এয়ারপোর্টে থেকে ফেরার সময় জোন্সের লোকজন গুলি বর্ষণ শুরু করে রায়ান এবং তাঁর দলের উপর । রায়ান সহ আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়!
এই ঘটনার পরেই জোন্স তাঁর অনুরাগীদের চার্চের বড় মাঠে একত্রিত হতে বলেন! এবং ঘোষণা করেন-‘আজকেই সেই শুভদিন’ যদি কেউ আজ এই ‘বৈপ্লবিক আত্মহত্যা’ না করে তাহলে একটু পরে এসেই আমেরিকার মিলিটারি দল তাঁদের চার্চ ধ্বংস করে দিয়ে যাবে তাঁদের ছেলে-মেয়েদের কেড়ে নেবে! জোন্স তাঁর অনুগামীদের জন্যে আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন! তিনি সবাইকে সায়ানাইড মেশানো পানীয় হাতে তুলে দেন এবং খেয়ে নিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর কথা বলেন, জোন্সের অন্ধভক্তরা তাঁদের গুরুর কথা শুনে তা পান করে নেন। কয়েকজন রাজি না হলে আশ্রমের লোকেরা তাঁদের জোর করে ইঞ্জেকশান দিয়ে দেয়! অনেকের মাথায় গুলি করে দেয়!
পরদিন সকালে জোন্সটাউনের ৯১৮ জন বেশি অধিবাসী, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-নাবালক-সবার নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার মধ্যে ৩০৪ জনের বয়স ছিল ১৭ এর কম! জোন্সের নিথর দেহও পাওয়া যায় সেখানে, মাথায় গুলির আঘাত- ভাবা হয় জোন্স নিজেই নিজেকে গুলি করেছিলেন অথবা নার্স আনি ম্যুর (Annie Moore) ওনাকে গুলি করে নিজেও আত্মহত্যা করে্ন!
পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ‘গণ-আত্মহত্যা’। এই ঘটনাকে বলা হয় জোন্সটাউন ম্যাসাকার (Jonestown Massacre) কারণ এক অর্থে এটা গণহত্যাই ছিল। হয়তো এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেওয়াই ছিল জিম জোন্সের উদ্দেশ্য। পৃথিবীর প্রতি তাঁর চরম প্রতিশোধ!
এক সময়কার জনপ্রিয় দাপুটে জননেতা সমতার ধর্মের প্রচারক কীভাবে এমনভাবে এতগুলো মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্যে দায়ী হয়ে উঠবেন তা ভাবাই মুশকিল! অনেকেই বলেই জোন্সের এই মানসিক অসুস্থতার আসল শেকড় তৈরি হয় তাঁর ছোটবেলায়! বড় হয়ে ওঠার মধ্যে বহু বিচ্ছেদ, পরিবার ভাঙা, প্রতারণা, একা ফেলা আসার স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে বেরোতে থাকে! যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর হিটলারের আত্মহত্যার ঘটনা তাঁকে ছোটবেলায় ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল! ২০০৬ সালে ডকুমেন্ট্রি Jonestown: The Life and Death of Peoples Temple দেখানো হয় তিনি ছিলেন ধর্ম নিয়ে বাতিকগ্রস্ত, মৃত্যু নিয়ে অতি রোমাঞ্চিত এক ব্যক্তি!
জোন্সটাউনে ফেরার পর থেকেই তাঁর paranoid delusion (কোনও প্রমাণ ছাড়াই অপরজনকে সন্দেহ করার দৃঢ় বিশ্বাস)-এর প্রভাব বাড়তে থাকে, অনিয়মিত ভাবে নিজের মতো বিভিন্ন ড্রাগ খেতে থাকেন এবং তাতে আসক্ত হয়ে পড়েন! অবশেষে তাঁর এই দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধি এক কুখ্যাত ভয়াবহ ট্র্যাজিডির জন্ম দেয়!
বলা হয় ৯/১১ (ওয়ার্ল্ড ট্রেন্ড সেন্টার ধ্বংস)ঘটনার আগে ‘জোন্সটাউন ম্যাসাকার’ ছিল আমেরিকার নাগরিক সমাজে সবচেয়ে বড় ‘গণহত্যা’! অনেকেই একে ‘আত্মহত্যা’ বলতে চান না! আমেরিকা তথা পৃথিবীর মিডিয়া হাউস এই ঘটনাকে প্রচুর গুরুত্ব দিয়ে অনেকদিন ধরে কভার করে! বিভিন্ন ডকুমেন্ট্রি, আর্টিকেল, ভিডিও, ইন্টারভিউ,বই তাদের মতো করে একে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে! প্রায় ৪০ বছরেরও উপরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা আজও উঠে আসে স্মৃতির পাতা সরিয়ে, আমাদের স্তম্ভিত করে, আমাদের সতর্ক করে!