২০২৪ এর আন্দোলন এই জন্যে বলা হচ্ছে কারণ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ধারাবাহিক সংকটের কারণে হাসপাতালগুলিতে প্রিয়জনকে ভর্তি করতে না পারা এবং তাদের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু বা চিকিৎসা সংক্রান্ত গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হলে ক্ষুব্ধ পরিবারের লোকের সামনে পড়েন সরাসরি পরিষেবা দেওয়া জুনিয়র ডাক্তাররা। অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতেই থাকে। এর নিরসনে জুনিয়র ডাক্তাররা বারবার আন্দোলন করেছেন যার মধ্যে সবচাইতে বড়টি ঘটেছিল ১৯৮২ – ‘৮৩ সালে।
স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপ্রতুলতা ও অব্যবস্থার সঙ্গে দুর্নীতি, দলবাজি, স্বজন পোষণ, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, খুন ইত্যাদি অপরাধ এবং সেগুলির রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রায় ৩০ বছরের কংগ্রেসী শাসনে এবং দুটি ক্ষণস্থায়ী যুক্তফ্রন্ট ও ৩৪ বছরের বাম আমলে যথেষ্ট থাকলেও বর্তমান তৃণমূল আমলের মত ব্যাপক ছিলনা। এগুলি দেখেও বিপন্ন অসহায় মানুষ নেতা, দূর্বৃত্ত ও পুলিশ চক্রের হেনস্থার ভয়ে এড়িয়ে যেতেন। মাননীয়া স্বাস্থ্য ও মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণাপ্রাপ্ত নর্থ বেঙ্গল লবি সহ তৃণমূলের কিছু চিকিৎসক নেতার স্বার্থ ও খেয়ালখুশিতে এবং তাদের বশংবদ আমলা, স্বাস্থ্য প্রশাসক ও শিক্ষক চিকিৎসকের নেতৃত্বে মেডিকেল কলেজ গুলিতে এবং নির্দিষ্টভাবে সন্দীপ ঘোষের নেতৃত্বে আরজিকরে যে সীমাহীন দুর্নীতি, অনাচার ও সংগঠিত অপরাধ চলছিল সেটি সবার জানাই ছিল।
কিন্তু ৯ আগস্ট মধ্য থেকে শেষ রাতে আরজিকর মেডিকেল কলেজের চেস্ট ডিপার্টমেন্টে কর্মরত অবস্থায় প্রতিবাদী জনপ্রিয় চিকিৎসক তিলোত্তমাকে যে পৈশাচিক অত্যাচার করে, ধর্ষণ ও খুন করে, তারপর সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তাঁর মা – বাবাকে আড়াল করে যেভাবে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার যাবতীয় চেষ্টা চালিয়ে শবদেহকে দ্রুত দাহ করা হল, তারপর ১৪ আগষ্টের তাণ্ডব সহ কয়েকদিন ধরে তদন্তকে বিপথচালিত করা হল এবং তাতে যেভাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার যুক্ত হয়ে পড়লেন তা এক কথায় নজিরবিহীন। এই নৃশংস প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা রাজ্য ছাড়িয়ে দেশ ও বিশ্বকে নাড়িয়ে দিল। সন্দীপ মাফিয়া বাহিনীর ঘেরাটোপ ভেঙে প্রথমে আরজিকরের পরে অন্য মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তাররা ও অন্যান্য চিকিৎসকরা প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন। নারী নিরাপত্তার সমস্ত পরিসরটাই ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় শহর, মফস্বল শহর এমনকি কিছুকিছু গ্রামাঞ্চলেও অসংখ্য সাধারণ মানুষ বিশেষত মহিলারা তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ১৯৭৭ এর জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের পর আর এত বড় আন্দোলন দেখা যায় নি। পাশাপাশি তৃণমূলের অপশাসনে তিতিবিরক্ত মানুষ এতদিন ভয়ে চুপ করে থাকলেও এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মুখ খুলতে ও পথে নামতে সাহস পেলেন।
আন্দোলনের সালতামামি: ২০২৪ এর আন্দোলনের এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য ছিল এর স্বতস্ফূর্ততা, ব্যাপক জনসমর্থন,দলহীন চরিত্র, সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা ও শান্তিপূর্ণ রূপ। গত প্রায় তিনমাস ধরে অল বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের (WBJDF) নেতৃত্বে এক শক্তিশালী ও অভূতপূর্ব গণআন্দোলন ও গণজাগরণ সৃষ্টি হল যার সহযোগী ছিলেন চিকিৎসকদের সংগঠন Jt Platform of Doctors (JPoD) এবং নাগরিক সমাজের বিবিধ অংশ। প্রায় প্রতিদিনই চলতে থাকল বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট বড় সভা, প্রতিবাদ, মিছিল, অবস্থান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাত দখল, গণ কনভেনশন। জুনিয়র ডাক্তার দের সফল লালবাজার ও স্বাস্থ্য ভবন অভিযান এবং অবস্থান গণআন্দোলনের ইতিহাসে মাইল
ফলক হয়ে থাকবে। ৫ থেকে ২১ অক্টোবর কলকাতা মহানগরীর কেন্দ্রস্থল ধর্মতলায় তাঁদের ১০ দফা দাবিতে আমরণ অনশন চালানোর পর জুনিয়র ডাক্তাররা শহীদ তিলোত্তমার মা – বাবার অনুরোধে অনশন ও অবস্থান তুলে নিলেন। তার আগে তাঁদের পাঁচ দফা দাবিতে কর্মবিরতির পর বন্যা ও জনগণের কথা ভেবে সেটি প্রত্যাহার করেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনবার মুখ্যমন্ত্রীর ও আরও কয়েকবার মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, কয়েকবার ভেস্তেও গেছে। এর মধ্যে দিয়ে তাঁরা (১) রোগী কল্যাণ সমিতির পুনর্গঠন, (২) পুলিশ কমিশনার, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা ও স্বাস্থ্য কর্তার অপসারণ, (৩) মার্চ ‘ ২৫ এ মেডিকেল কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন, (৪) বিভিন্ন স্তরের নজরদারি কমিটি গঠন ও সেখানে প্রতিনিধি রাখা, (৫) হাসপাতালগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা, (৬) স্বচ্ছ রেফারেল ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি – বেশ কয়েকটি দাবি দীর্ঘ ও কঠিন লড়াই চালিয়ে অর্জন করতে সক্ষম হলেন।
কিন্তু তাঁদের প্রধান যে দাবি তিলোত্তমার বিচার এখনও অধরা থাকল। কলকাতা পুলিশের তদন্তে গাফিলতি দেখে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি সিবিআই এর হাতে তদন্তভার দিলেও সিবিআই এখনও কিনারা করতে পারে নি। কেবল কলকাতা পুলিশের তদন্তের ফলের হুবহু চার্জশিট দিয়েছে ধৃত সিভিক পুলিশ সঞ্চয় রাইয়ের বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবর। এর সাথে প্রমাণ লোপাট এর অভিযোগে গ্রেফতার করেছে টালা থানার ওসি অভিজিৎ মন্ডলকে এবং দুর্নীতির অভিযোগে সন্দীপ ঘোষ, আশীষ পাণ্ডে এবং দুজন সহযোগী ঠিকাদারকে। আর হাইকোর্টে শুনানির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিলোত্তমার কেসটি ২১ আগষ্ট সুয়ো মোটো গ্রহণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং তার পর থেকে পাঁচবার শুনানি হয়ে গেলেও বিশেষ অগ্রগতি ঘটেনি। প্রধান বিচারপতির অবসরের সময়ও চলে এসেছে। দুর্নীতির কেসটি শিয়ালদা আদালতে চলছে সেখানেও সিবিআই এর চার্জশিট এ প্রচুর সচেতন ফাঁকফোকর দেখা যাচ্ছে।
এইরকম অবস্থায় জুনিয়র ডাক্তাররা ২৬ অক্টোবর আরজিকর হাসপাতালে একটি গণকনভেনশন আয়োজন করেন এবং ২৯ অক্টোবর সিবিআই কে সঠিকভাবে তদন্ত করার দাবিতে পুনরায় সিজিও কমপ্লেক্স অভিযান করেন। JPoD আরও ৮০ টি গণ সংগঠন কে নিয়ে তৈরি করে ‘ অভয়া মঞ্চ ‘ । তারও আগে ১৩২ টি গণ সংগঠন মিলে সিজিও কমপ্লেক্সে বিক্ষোভ দেখান। অন্যদিকে শাসক দলের তরফে মুখপাত্র, বিভিন্ন নেতা ও জন প্রতিনিধিরা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তীব্র ও কদর্য আক্রমণ শুরু করেন। কর্পোরেট হাসপাতালগুলির সঙ্গে যুক্ত কিছু চিকিৎসক স্বঘোষিত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। শাসকদলের সহায়তায় অভিযুক্ত ও শাস্তিপ্রাপ্ত জুনিয়র ডাক্তাররা West Bengal Junior Doctors’ Association (WBJDA) গঠন করে WBJDF কে আক্রমণ ও পাল্টা কর্মসূচি শুরু করেন। আবার আগামী মেডিকেল কলেজ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে শাসক দলের সহায়তায় গড়ে ওঠে Progressive Junior Doctors’ Association (PJDA)। প্রবল গণআন্দোলনের চাপে শাসক দলের মদতপুষ্ট হুমকি সিন্ডিকেটের মাথা হিসেবে প্রচারিত শ্যামাপদ দাস, সুশান্ত রায়, অভিক দে দের উত্তরবঙ্গ লবি কিছুটা পিছু হটলে এবং সন্দীপ ঘোষ জেলে থাকায় সামগ্রিক স্বাস্থ্য দপ্তর, মেডিকেল কলেজগুলি, মেডিকেল কাউন্সিল ও স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত লাভজনক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে শাসকদলের অন্য প্রভাবশালী হুমকি সিন্ডিকেটের মাথা বলে কথিত শান্তনু সেন, নির্মল মাঝি, সুদীপ্ত রায়, সুহৃতা পাল প্রমুখ নেতা নেত্রীরা তৎপর হয়ে ওঠেন।
এই পর্যায় অবধি জুনিয়র ডাক্তারদের নাগরিক আন্দোলন হয়ে ওঠা এই আন্দোলনটির প্রথম পর্ব বলা যেতে পারে যা ঝড়ের মত সব কিছুকে ভাসিয়ে দিয়েছে। পেয়েছে বিপুল জনসমর্থন, স্বৈরাচারী শাসককে পিছু হটিয়েছে এবং জাগিয়েছে বিরাট প্রত্যাশা। কিছু সময় কর্মবিরতির মত জনগণের অসুবিধা সৃষ্টিকারী এবং আন্দোলনের শুরুতে কর্মবিরতি এবং আমরণ অনশনের মত চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ ছাড়া WBJDF নবীন শক্তি হয়েও স্বীয় দক্ষতা ও সাফল্যে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ ও আন্দোলন কারীদের বিস্মিত করেছে। তাঁরা বিচক্ষণতার সঙ্গে পতাকা নিয়ে কোন রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহণ করতে দেননি। কিন্তু দলীয় পরিচয় ছাড়া সিপিআইএম, এসইউসি, তৃণমূল (বিক্ষুব্ধ), নকশাল উপগোষ্ঠীগুলির নেতাদের অংশগ্রহণ করতে দিলেও জাতীয় কংগ্রেস ও বিজেপি নেতাদের অংশ গ্রহণ করতে না দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাঁদের হাতে দেশবিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য চলে আসায় শাসক দল অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে। নিশ্চয় যথাসময়ে তাঁরা সঠিক অডিট পেশ করে এর সমুচিত জবাব দেবেন। তবে সতর্ক থাকতে হবে সন্দেহজনক সূত্রগুলির প্রতি এবং বেসরকারি ও কর্পোরেট হাসপাতাল ইত্যাদির থেকে সাহায্য নিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন মানুষ ভালো চোখে দেখবেন না।
অন্যদিকে সহযোগী সংগঠন হিসেবে একদিকে সিপিআইএম, অন্যান্য বাম ও নকশালিপন্থীদের চিকিৎসক ও অনান্য সংগঠন গুলি, অন্যদিকে এসইউসির চিকিৎসক, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সংগঠনগুলি সমান্তরালভাবে চলেছে যা থেকে যাচ্ছে এই আন্দোলনের একটি প্রধান দুর্বলতা। ফলে ব্যাপকভাবে অংশ গ্রহণ করা গনতান্ত্রিক মানুষেরা বিভাজিত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। JPoD প্রমুখের প্রধান কৃতিত্ব থেকেছে জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতির সময় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলির পরিষেবা চালিয়ে যাওয়া এবং রীতিমত যুদ্ধ করে দ্রোহের কার্নিভাল অনুষ্ঠানটি সংগঠিত করা। আবার তাঁদের সহ চিকিৎসক ও নাগরিক আন্দোলনগুলির আরেকটি প্রধান দুর্বলতা ছিল লক্ষ্য ও দাবির ক্ষেত্রে বিমূর্ততা। যেখানে আরজিকর ঘটনা এবং তারসাথে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দায়ে স্বাস্থ্য ও পুলিশ মন্ত্রীর পদত্যাগ, স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণ, অভিযুক্তদের গ্রেফতারের কথা তুলে ধরে সেগুলির ফলপ্রসূ করা উচিত ছিল। সেটি না হওয়ায় আন্দোলনকারীদের প্রচুর পরিশ্রম ও সময় অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু মাফিয়া – অপরাধ চক্র বহাল তবিয়তে থেকে যাওয়ায় কাজের কাজ কিছু হয়নি। সরকার ও প্রশাসনও নিজেদের গুছিয়ে নিতে পেরেছে।
নবগঠিত অভয়া মঞ্চের দাবিপত্রেও এই বিষয়গুলি অনুপস্থিত এবং অতি চিকিৎসা ও ফাঁপানো বিল এর মাধ্যমে বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতাল থেকে নার্সিংহোম গুলি যে একেকটি দুর্নীতির আখড়া এবং সেটির নজরদারিতেও যে সরকার ব্যর্থ সেটিও আসেনি। এছাড়া ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি সহ চিকিৎসায় out of pocket ও catastrophic health expenditure রোখার কোন উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই স্বাস্থ্য নীতির প্রণয়ন, স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য বাজেটের অর্থ ঘরবাড়ি বানিয়ে নষ্ট করার। সবার জন্য নিখরচায় স্বাস্থ্য ও Universal Health Coverage এর পরিবর্তে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনগনের স্বাস্থ্যকে আয়ুষ্মান ভারত ও স্বাস্থ্য সাথীর নামে বীমা কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া ইত্যাদি লোকদেখানো প্রকল্পের বিরোধিতা নেই। ১৯৮২ – ‘৮৩ আন্দোলনে কিন্তু এর অনেকটাই ছিল দাবিপত্রে।
এই অভূতপূর্ব আন্দোলন সমস্ত মানুষকে নাড়া দিলেও সঠিক প্রচার ও সংগঠনের অভাবে শেষ বিচারে শহুরে উচ্চ ও মধ্য বিত্তদের একাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। বিস্তৃত গ্রামাঞ্চল, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ এবং মুসলমান, দলিত ও জনজাতি সমাজের মধ্যে অর্থাৎ রাজ্যের বেশিরভাগ জনসাধারণের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারেনি। এটি একটি পেশার সঙ্গে যুক্ত সংগঠন পারেও না। এটি করার কথা সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলি। রাজ্যের শাসক ও প্রধান দল তৃণমূল এর বিরোধিতা করেছে। প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে ব্রাত্য রাখায় তারা নিস্পৃহ থেকেছে। এসইউসি ক্ষুদ্র এবং সিপিআইএম লিবারেশন অতি ক্ষুদ্র শক্তি হলেও তাদের তৃণমূলপন্থী রাজনৈতিক লাইনের জন্য এই কাজটি করেনি। তাঁর ক্ষয়িষ্ণু শক্তি দিয়ে যেটুকু করেছে সিপিএম এবং তাঁদের সীমিত শক্তি দিয়ে গনতান্ত্রিক নাগরিক সমাজ।
এর উপর বন্যা, শারদ উৎসব, উপনির্বাচন ইত্যাদি ইস্যু গুলি চলে আসায় সেখানে গুরুত্বর ফোকাস টি সরে গেছে। আর নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনের বিষয়টি এত আকছার হচ্ছে এবং গ্রামে এর সংগঠক মাফিয়া – অপরাধ সিন্ডিকেট বাম আমল হয়ে তৃণমূল আমলে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে অসহায় সাধারণ মানুষ এগুলি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কেবলমাত্র জয়নগর ধর্ষণের ঘটনাটি একটি বড় গণ আন্দোলনের জন্ম দেয় যেটি বিরোধী সংগঠন দুর্বল থাকায় শাসক দল ও প্রশাসন সামলে নিয়েছে।
নতুন পরিস্থিতি, নতুন সমীকরণ:
বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় ও তৃণমূল বিরোধী ইণ্ডিয়া জোটে থাকলেও এবং বাইরে লোক দেখানো তরজা ও বন্ধুসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও দুটি সমমনস্ক দলের সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়েছে। আরজিকর কান্ডের পরপরই রাজ্য বিজেপির বিবাদমান সব গোষ্ঠীর নেতারা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেও, ছাত্র সমাজের নামে নবান্ন অভিযানের মত বড় কর্মসূচী অনুষ্ঠিত করার পর বিজেপির কেন্দ্র নেতারা রাশ টেনে ধরেছেন। আরজিকর কান্ডে কেন্দ্র সরকার, বিজেপির কেন্দ্র নেতৃত্ব এবং হাতের পুতুল বনে যাওয়া রাজ্যপাল কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে থেকেছেন। সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা নিয়েও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আর সিবিআই এর ভূমিকা এখন অবধি নোবেল, সারদা, বগটুই, কালীঘাটের কাকু মামলা গুলির থেকে অন্যথা হয়নি। তদন্তের পরিধি সম্ভবত অভিজিৎ মণ্ডলের পর আর উপরে উঠবে না এবং ২০২৬ র উপনির্বাচন অবধি দরকাঁচা মেরে শম্বুক গতিতে চলবে। কারো কারো মতে কয়েক হাজার কোটি টাকার স্বাস্থ্য দুর্নীতির অর্থ আদি গঙ্গা হয়ে যমুনার তীরেও পৌঁছেছে। দুর্ধর্ষ ফান্ড রাইজার সন্দীপ ঘোষও হয়তো অনুব্রত মণ্ডলের মত কিছুদিন পর স্বমহিমায় ফিরে আসবেন। স্বাস্থ্য ভবন ও সিবিআই এর কাগজপত্র সেরকমই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল গনতান্ত্রিক নাগরিক সমাজ। আন্দোলন দীর্ঘায়িত হওয়ায়, হাতে গরম কোন ফল দিতে না পারায়, নিজ পেশায় তাঁদের শাসক দল প্রশাসন ও পুলিশের চাপ, রুজিরোজগার ও কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া এবং সর্বোপরি প্রভাবশালী মিডিয়ার মাধ্যমে বারবার এই আন্দোলনটি সিপিএম ও অতি বামদের বলে প্রচার করা অনেককেই সরিয়ে দিচ্ছে। ২৯ তারিখের মিছিলে সেটা চোখেও পড়েছে।
এই আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ তৃণমূলরাও ছিলেন একটি বড় শক্তি। শুখেন্দু শেখর রায়, মমতাজ সংঘমিত্রা, জহর সরকাররা যেমন নেমেছিলেন, শান্তনু সেন নিজে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর গোষ্ঠীর চিকিৎসকরা নেমেছিলেন। তাঁরাও আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছেন।
দুর্বল জাতীয় কংগ্রেস রাজ্যে নতুন সভাপতি নির্বাচনের পর তৃণমূলের প্রতি নরম। এসইউসি র সিপিএম বিরোধিতাই প্রধান লাইন। সিপিআইএম তাঁর ৩৪ বছরের শাসনে যে অপকর্ম ও সন্ত্রাসগুলি চালিয়েছে মানুষ এখনও ভোলেনি। তাই ক্রমশঃ গণভিত্তি ও ভোট হারিয়ে এই দলবিহীন আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়ে জনসমর্থন বাড়াতে চাইছে। এই আন্দোলনে যুক্ত মোর্চার পরীক্ষা চালানোর পাশাপাশি আগামী উপনির্বাচনে শরিক দল ও বাম ফ্রন্টের বাইরের দুটি দলকে নমনীয় হয়ে আসন ছেড়েছে। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এক ঝাঁক তরুণ নেতৃত্ব উঠে এলেও মূল রাজ্য নেতৃত্ব এখনও সাধারণের চোখে ঘৃণিত। সেরকমই সিপিআইএমের চিকিৎসক আন্দোলনের বেশ কিছু নেতা ক্ষমতাসীন অবস্থায় তাঁদের কর্তৃত্ববাদ ও অনান্য কর্মকাণ্ডের কারণে চিকিৎসক মহলেও আজও ততটা জনপ্রিয় নন।
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকেরই সামনে ফাইনাল পরীক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি চলে এসেছে। অন্যদিকে আন্দোলনকারী নেতাদের ও তাঁদের পরিবারের প্রতি শাসক দল, সরকার, প্রশাসন, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, বিরোধী সংগঠন কড়া নজর ও চাপ রাখছেন। এই প্রবল চাপে অনেকে অনেকসময় অনেকে বসে যান বা সমঝোতা করে ফেলেন।
তাই সমস্ত কিছু বিচার করে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ঐক্য ধরে রেখে, লক্ষ্য ও দিশায় অবিচলিত থেকে এই ঐতিহাসিক গণআন্দোলন কতদূর যেতে পারে এবং এই প্রবল শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তির বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে তিলোত্তমার বিচার কিভাবে ছিনিয়ে আনে সেটাই রাজ্যবাসী দেখার আশায় আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
৩১.১০.২০২৪