কথা হচ্ছে মধ্যমগ্রামের কালীপুজো নিয়ে। এবং কথা বলছে এমন একজন যে কিনা কালী পুজোর প্যান্ডেল বিশেষ দেখেনি। একমাত্র রাত বারোটার পর মেয়েদের নিয়ে বেরোনো ছাড়া।
মেয়েরাও তেমন। কোথায় কোথায় ভুতের প্যান্ডেল হয়েছে, সেসব খবর গোপন সূত্রে বের করেছে। তারপর মাঝ রাতে বাবাকে ধরে সেসব প্যান্ডেলে হানা দিচ্ছে। কোথাও কফিন খুলে কংকাল বেরিয়ে আসছে তো কোথাও শ্যাওড়া গাছে শাঁকচুন্নি ছানাপোনা নিয়ে বসে আছে।
এক প্যান্ডেলে তো প্রায় মার্ডার করার প্ল্যান। প্যান্ডেলের মধ্যে গোলকধাঁধা। প্রায় অন্ধকার পথ দিয়ে ঠোক্কর খেতে খেতে এগোচ্ছি, গায়ের উপর একজন বিকট মুখোশ পরে লাফিয়ে হাইমাই শুরু করল। বললাম, বাপরে, আর একটু হলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত।
পেছন থেকে রানী বলল, বাবা তুমি ভয় পেলে নাকি। ও ভূত কোথায়। ও তো মানুষ। বলে বেমালুম সেই ভূতুড়ে মানুষের সাথে হ্যান্ডশেক করে ফেলল। সবেতেই বাড়াবাড়ি। হাত মেলানোর জন্য লোক কী কম পড়েছে।
এর চেয়ে আমাদের মধ্যমগ্রাম তিলোত্তমা প্রতিবাদী মঞ্চের বুক স্টল অনেক ভালো। দিব্যি লোক দেখতে দেখতে আর আড্ডা দিতে দিতে সময় কেটে যায়। কত মানুষ আসছেন। কেউ বই দেখছেন। কেউ বই কিনছেন। কেউ আর জি কর আন্দোলনের পাশে আছে জানিয়ে যাচ্ছেন।
তবে একটাই সমস্যা বুক স্টলের চারদিকে চারটে পুজো। চারদিক থেকেই তারস্বরে মাইক বাজছে। একদিকে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে ঘোষণা হচ্ছে- এই মুহূর্তে আমাদের মঞ্চে হাজির হয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আচ্ছা রবিঠাকুর আপনি আপনার রচিত একটা গান গেয়ে শোনান। ওহ… ওনার গলা ভালো নেই। উনি তাই গান গাইতে পারবেন না। আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য রাখবেন। আচ্ছা রবিঠাকুর আপনার কাছে আমার একটি প্রশ্ন আছে- এত মণ্ডপ ছেড়ে আপনি আমাদের মণ্ডপেই এলেন কেন?
অন্যদিকের মাইকে সর্বচ্চো আওয়াজে গান হচ্ছে ‘জামাল জামাল লেক জামালু, জামাল কুদু…’। আরেকদিনের মাইকে গান হচ্ছে ‘আমার একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’। অন্যদিকে ভূতের প্যান্ডেল। সেখান থেকে হাউ মাউ খাউ হচ্ছে।
আমরা এসবের ঠিক মাঝখানে বসে লোককে প্রাণপণে চিৎকার করে বোঝানোর চেষ্টা করছি, আন্দোলন চলছে চলবে। এটা মোটেও চিকিৎসকদের আন্দোলন নয়। এটি গণ আন্দোলন। আন্দোলনের সত্যিকারের মুখ বলে যদি কেউ থাকে সেটা একমাত্র ‘তিলোত্তমা’। চিকিৎসকদের অনশন উঠে যাওয়ার সাথে সাথে আন্দোলন শেষ হয়ে গেল এমন ভাবার কারণ নেই। তিলোত্তমার হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামার প্রশ্ন নেই। দীপকদার বাজখাঁই গলা। মাইকের আওয়াজ ছাপিয়েও দিব্যি শোনা যাচ্ছে।
মাঝে মাঝে ছোটো ছেলে মেয়ে পেলেই দীপকদা কংকালকে দুধ খাওয়ানো দেখাচ্ছেন। এবং তাঁর কৌশল ব্যাখ্যা করছেন। স্টলে ভিড় জমে উঠছে।
যারা আসছেন তাঁরা আমাদের খাতায় বিচারের দাবী লিখে যাচ্ছেন। একটা ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে দুটো বই পছন্দ করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই মুহূর্তে তাঁর কাছে অত টাকা নেই।
বললাম, বই নিয়ে যা, টাকা পরে দিয়ে যাস মা। বলার পরই হেসে ফেলে সুস্মিতার দিকে তাকালাম। সে মনোযোগ দিয়ে মোবাইল নিয়ে কিছু একটা করছে।
এবার মধ্যমগ্রাম স্টেশন থেকে আরতি হল অবধি ত্রিশ চল্লিশ মিটার অন্তর অন্তত ১২ জায়গায় ভিখারিরা বসে আছে। তাঁদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো প্রতি দলেই একজন বড় আর একজন বাচ্চা আছে। প্রত্যেকের পোশাক আশাকই অত্যন্ত নোংরা। বাচ্চাটাকে সামনে শুইয়ে তাঁরা ভিক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ বাদে বাদে আমাদের স্টলের সামনে ভিখারিরা একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। অভি বলল, দেখ, ভিখারিদেরও সিন্ডিকেট রয়েছে। এর মাথা উপরমহলের লোক। সে এই ভিখারিদের কাছ থেকেও কাটমানি খায়। লাভজনক ব্যবসা।
শোভনা ম্যাডাম চুপচাপ বসে ছিলেন। তিনি বললেন, যতই লাভজনক ব্যবসা হোক, বাধ্য না হলে কেউ ভিক্ষা করে না অভি। এটা আমদেরই দায় যে আমরা তাঁদের জন্য বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান করে দিতে পারি নি। এই নিয়ে জোরদার আলোচনা চলছে।
আমাদের স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক শেখর বাবু রোজ আসছেন এবং পুরো সময় থাকছেন। ডা পুণ্যব্রত গুণ পরপর দুদিনই এসেছেন। সৌমেনকাকু রাত বাড়লেই চলে আসছেন। কেষ্টদা, যিনি অসম্ভব ভালো মূর্তি বানান আজ এসেছিলেন। কেষ্টদাকে দেখলেই কেন জানিনা পান খেতে ইচ্ছে করে। ডা. পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায় আজ এসেছেন।
আমি টুকটুক করে স্টলের পাশে বসে থাকা এক দাড়ি আর জটাওয়ালা ভিখারির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম। তিনি আমাকে একেবারেই পাত্তা দিলেন না। মাইকের আওয়াজে কথাও ভালো বোঝা যাচ্ছে না। তাছাড়া তিনি বাংলাতেও কথা বলছেন না।
তিনজন পুলিশ যাচ্ছিলেন। তাঁরা আমার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে চাইতে চাইতে গেলেন। আমি উই ওয়ান্ট জাস্টিস লেখা গেঞ্জি পরে আছি।
রাত সাড়ে নটার সময় দীপকদাকে বললাম, আপনি এবার যান। সাইকেল নিয়ে অশোকনগর ফিরবেন।
দীপকদা বলল, আর আধঘণ্টা থাকি। চাপ নেই কোনো। কাল সকালে সিটিজেন ফোরামে যেতে হবে না।
বললাম, আপনি উই ওয়ান্ট জাস্টিস লেখা গেঞ্জিটা খুলে অন্য গেঞ্জি পরে যান। না হলে ফাঁকা রাস্তায় পুলিশ ধরতে পারে। এমনিতেই আপনার পুলিশ ভাগ্য খুব একটা ভালো না।
দীপকদা বললেন, ধরে থানায় নিয়ে গেলে মুশকিল নেই। কিন্তু মাঝ রাস্তায় গেঞ্জি খুলে নিলে মুশকিল।
বললাম, ঠিক আছে, তাহলে আমার একটা গেঞ্জি দিয়ে দি। খুলে নিলে ওটা পরে নেবেন।
বাড়ি থেকে স্টলের জন্য টিফিন বানিয়ে দেয়। চারটে রুটি ছিল। দীপকদাকে জোর করে খাইয়ে দিলাম। বললাম, পুলিশ এবার ধরলেও সমস্যা নেই। সারা রাত থানায় রেখে দিলেও সমস্যা নেই। খিদে অন্তত পাবে না।
দীপকদাকে মাঝে মাঝেই পুলিশে ধরে। এবং দিনের দিনই ছেড়ে দেয়। সে নিয়ে পরে লেখা যাবে।
ঘড়ির কাঁটা যখন দশটা ছুঁই ছুঁই তখন রূপালী এসে হাজির। আমার যাবতীয় কাজকে রূপালী ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ পর্যায়ে ফেলে। এবং প্রথমদিকে ঘোরতর বিরোধিতা করলেও শেষপর্যন্ত সাহায্যই করে। তবে তিলোত্তমা স্টলে ওকে টেনে এনেছে তিলোত্তমাই।
তখন স্টল পুরোপুরি জমে উঠেছে। একদিকে দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে। একদিকে হুক্কুস পুক্কুস, কানে কানে ফুসফুস। আরেকদিক থেকে কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।
যারা এতক্ষণ ভিক্ষা করছিলেন, তাঁরা আমাদের স্টলের সামনে একত্রিত হয়ে চা খাচ্ছেন। একটি মলিন পোশাক পরা বাচ্চার হাতে ঝলমলে গ্যাস বেলুন।
অন্যদিকে সদ্য কিশোরী তিলোত্তমা বুক স্টলের মন্তব্যের খাতায় গম্ভীর মুখে লিখছে- আর কিছু চাইনা, শুধু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। সব তিলোত্তমার বিচার চাই।
আর এসব কিছুর সাক্ষী থেকে যাচ্ছি আমরা কয়েকজন। তিলোত্তমা বুক স্টলে বসে থাকা কয়েকজন।