অভয়া মঞ্চ ব্যারাকপুর মহকুমার উদ্যোগে ধর্ষিত এবং নিহত আর জি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের বিচারের দাবীতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হল ১৯ শে জুন ২০২৫ খড়দহে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করে মানুষের ঢল নেমেছিল খড়দহ বিটি রোডের শান্তিবাজারে। অনিয়মিত অবিরাম বারিধারাবর্ষণ, মঞ্চে প্রতিবাদের ঝড় আর মঞ্চের সামনে ছাতার মিছিল নিয়ে উপস্থিত প্রতিবাদী জনতা। বিরতিহীন কর্মসূচি চলেছে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। রাত সাড়ে আটটার পরেও জনজোয়ারে ভাঁটার টান লক্ষ্য করা যায় নি।
‘মানবো না বাধা মানবো না’ আর সাথিদের খুনে রাঙ্গা পথে দেখো হায়নার আনাগোনা’ – এই দুটি গানে প্রতিবাদের শপথ নিয়ে অনুষ্ঠানের সুচনা করেন খড়দহ গণনাট্য সংঘের খবর সৃজন শাখার শিল্পীরা। এই সভায় বক্তব্য রাখেন ডক্টর হীরালাল কোনার, ডক্টর তমোনাশ চৌধুরী, ডক্টর গৌতম মুখার্জি, আইনজীবী ফিরদৌস শামিম, কামদুনির প্রতিবাদী শিক্ষক প্রদীপ মুখার্জি, যুব আন্দোলনের নেতা কলতান দাশগুপ্ত ও দীপ্সিতা ধর, চিত্র ও নাট্য পরিচালক সৌরভ পালোধি, স্থানীয় কাউন্সিলর অর্পিতা দাশগুপ্ত এবং গোপা মুখার্জি । প্রতিবাদী গান করেন অপর্ণা নাগ এবং সহেলী সরকার। দক্ষিণ গড়িয়ার নাট্যদল নাটককারী ‘পথেই হবে পথ চেনা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করে। সমবেত শিল্পের মাধ্যমে ধর্ষণ সংস্কৃতির বিনাশ ঘোষণা করে।
ডক্টর হীরালাল কোনার সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে সরকারি দফতরে জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ বিতরণের নির্দেশের উল্লেখ করে রাষ্ট্র, রাজনীতি আর ধর্মের সমীকরণের তীব্র প্রতিবাদ করেন ডক্টর কোনার। চিকিৎসা ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান বেসরকারিকরণের বিষয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ডক্টর তমোনাশ চৌধুরী আবেগ আর ক্রোধের আগুনে মেশা বক্তৃতায় বিচার ছিনিয়ে না আনা পর্যন্ত পথের লড়াই চালানোর শপথ করেন। শরীরের শিরা ধমনীতে উষ্ণ রক্তের প্রবাহ প্রতিবাদী জনতাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে। তিনি আরও বলেন প্রতিবাদীদের গ্রেফতার করে আর প্রতিবাদী চিকিৎসকদের বদলি করে আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না ।
ডক্টর গৌতম মুখার্জি অভয়া বিচারে সরকারী দীর্ঘসূত্রিতার তীব্র প্রতিবাদ করেন।
ফিরদৌস শামিম বলেন বিচার মানে পক্ষপাতহীন তদন্ত। ২০২৪ সালের অগাস্টে অভয়ার হত্যার বিচার এখনও হয়নি, তথ্য প্রমাণ কারা লোপাট করল, কারা ভাংচুর করল আর জি কর হাসপাতালে – কোনটারই এখনও কিনারা হয়নি। জনগণের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করে বিচার ব্যবস্থাকে বিচার দিতে বাধ্য করতে হবে ।
কামদুনি আন্দোলনের অন্যতম মুখ শিক্ষক প্রদীপ মুখার্জি বলেন কামদুনি আন্দোলনে সরকার পক্ষ মূল অভিযোগকারীদের কিনে নিতে সক্ষম হলেও প্রতিবাদের সাহস বৃথা যায়নি। এক প্রতিবাদ, অন্য প্রতিবাদের রাস্তা তৈরি করে। অভয়া আন্দোলন যে প্রতিবাদের ইতিহাস রচনা করেছে তা থেমে যাবার নয়।
সৌরভ পালোধি সামগ্রিক সামাজিক পরিস্থিতি এবং সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দায়ী করেন সরকারকে। এর বিরুদ্ধে সর্বস্তরে প্রতিবাদ গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি।
যুক্তি, মেধা আর তারুণ্যের দীপ্তিতে উজ্জ্বল দুই যুবনেতা কলতান দাশগুপ্ত এবং দীপ্সিতা ধরের বক্তব্য। কলতান প্রশ্ন করেন কেন সরকার আসল অপরাধীকে আড়াল করতে এত সচেষ্ট? তিনি বলেন বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের পক্ষে ৯৩৬ টি সই সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, বিপক্ষে ছিলেন ৩৬০০০ এর বেশি মানুষ। তাও বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তিত হয় বিদ্যাসাগরের প্রায় একক প্রচেষ্টায়। তাই এক চুল লড়াইয়ের ময়দান ছাড়লে চলবে না, আরও বহু মানুষকে শামিল করতে হবে। এখন কোথাও ভাঁটার টান দেখে চিন্তিত হলে চলবে না। সংখ্যা সব সময়ে শক্তির নির্দেশক হয় না।
দীপ্সিতা বলেন এই বিচারের দাবীতে এক হয়েছেন বহু স্তরের প্রতিবাদী মানুষ। প্রতিবাদের এই বহু স্বরই এই আন্দোলনের শক্তি। নানা বর্ণের এই মালাকে এক রঙের মালা করে ফেললে এই আন্দোলন তার গতি হারাবে। সাম্প্রতিক কালে ক্যালকাটা ক্লাবের একটি বিতর্ক সভার কথা উল্লেখ করে দীপ্সিতা বলেন এই আন্দোলনের একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও অভিমুখ আছে। আমাদের রাগ এবং আবেগ উদ্দেশ্যকে শক্তিশালী করছে ।
গোপা মুখার্জি বিচারের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক ধর্ষক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবার কথা বলেন যে সংস্কৃতি নারীকে শুধু ভোগ্য বস্তু হিসাবে ভাবতে শেখায়। তিনি বলেন এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য দলীয় রংবিহীন এই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ঐক্যমঞ্চকে শক্তিশালী করতে হবে।
অর্পিতা দাশগুপ্ত মানুষকে এই স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদের জন্য অভিনন্দন জানান।
সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন নাট্যকার চন্দন সেন।
সুতনুকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর চ্যাটার্জি, নব কর্মকার, শিল্পী দেব রায়, শিল্পী মালিক, সুতপা, প্রগতি, সুনেত্রা, রণিতা সকলের সমবেত কণ্ঠে দৃপ্ত শ্লোগানে ঝলসে ওঠে প্রতিবাদের আগুন, অগ্নিশিখায় আলোকিত হয় ‘রাষ্ট্রীয় অপরাধের বিরুদ্ধে জনসমাবেশ’ ।।