ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত চিকেনপক্স (Chickenpox) এবং স্মলপক্স (Smallpox)-র মধ্যে বিজ্ঞানীমহলেও নানারকম জটপাকানো অবস্থা ছিল। পৃথিবীতে স্মলপক্সের উচ্ছেদ (Eradication) অনেক আগেই ঘোষিত হয়েছে। স্মলপক্স (গুটিবসন্ত) অপেক্ষা চিকেনপক্স (জলবসন্ত) অনেক কম মারাত্মক হলেও এর ব্যাপকতা আজও অনেক বেশী।
জলবসন্ত বা চিকেনপক্স একটি সংক্রামক্ ভাইরাসঘটিত রোগ। জীবাণুর নাম ‘ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস’ (varicella-zoster virus/ VZV)। এই রোগের নাম কেন ‘চিকেন’ পক্স তা নিয়ে নানাবিধ মতামত আছে। বরং বাংলা নামটি সহজবোধ্য, জল ভরা ফোস্কা হয় তাই নাম ‘জলবসন্ত’।
১৮৭৫ সালে বিজ্ঞানী রুডলফ্ স্টেইনার প্রথম প্রমাণ করেন যে এটি একটি সংক্রামক রোগ- কিছু স্বেচ্ছাকর্মীর চামড়ায় জলভরা ফোস্কার তরল লেপন করলে তাঁরাও এই রোগের শিকার হন।
এই রোগের জীবাণু সাধারণত ড্রপলেটের মাধ্যমে অর্থাৎ বাতাসের মাধ্যমে শ্বাসের সাথে ছড়ায়।
যদিও বছরের যে কোনো সময়েই এই রোগ হতে পারে তবে আমাদের দেশে মূলত বছরের প্রথম ছ’মাস এ রোগের প্রকোপ সর্বাধিক (Seasonal Trend)।
শরীরে জীবাণু প্রবেশ করার প্রায় ১০-২১ দিন (ইনকিউবেশন পিরিয়ড)-র মধ্যে দেহের নানা অংশে ০.৫ মিমি বা তার কম ব্যাসযুক্ত ছোট ছোট শিশির বিন্দুর (“Dew Drop”) মতো ফোস্কা (ভেসিকেল) দেখা দেয়। এগুলি শরীরের কেন্দ্র বা ধড় থেকে বিভিন্ন দিকে প্রান্তস্থ অংশে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরের মিউকাস আবরণী যেমন মুখের ভিতরে বা নাসারন্ধ্রেও ভেসিকেল দেখা যেতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে প্রথমে লাল ছোট ছোট দানা (papule) থেকে ক্রমবিবর্তিত হয়ে জল ভরা ভেসিকেল (vesicle) হয় যা থেকে ৪-৭ দিন পর শুকনো ছাল (scab) ওঠে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল একই সময়ে শরীরের নানা স্থানে ওই বিভিন্ন দশার দানা দেখা যায়। তীব্র চুলকানি এবং নুতন দানা বের হবার সাথে সাথে মৃদুমাত্রার জ্বর হতে পারে।
এই রোগ নির্ণয় করা হয় সম্পূর্ণভাবে রোগ লক্ষণের উপর ভিত্তি করে। কোনোপ্রকার রক্তের পরীক্ষা নিষ্প্রয়োজন।
জলবসন্ত নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায় তবে এর কিছু জটিলতা রয়েছে। যেমন শিশুদের ক্ষেত্রে এ রোগ মারাত্মক না হলেও- বয়স্ক, গর্ভবতী মহিলা এবং যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন মানুষদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশ মারাত্মক হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের হলে বাচ্চা নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে; জন্মের ৫ দিনের মধ্যে হলে শিশুমৃত্যুও হতে পারে। বিশেষতঃ ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে এ রোগে নিউমোনিয়া হবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
আর চুলকানোর কারণে নখের আঘাতে ভেসিকেল ছিঁড়ে গিয়ে অন্য জীবাণু সংক্রমণের ফলে ঘা হতে পারে।
- অমূলক ভয় পাবেন না আর অযথা রক্তপরীক্ষা করাবেন না।
- জ্বর হলে তবেই প্যারাসিটামল সিরাপ (বাচ্চাদের) বা বড়ি (পূর্ণবয়স্কদের) খাওয়ান।
- অত্যধিক চুলকানির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ যেমন সেটিরিজিন ১০ মিলিগ্রাম বা লিভোসেটিরিজিন ৫ মিলিগ্রাম দিনে একবার দেওয়া যায়।
- জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে অ্যান্টিসেপটিক্ লোশান ঈষৎ উষ্ণ জলের সাথে মিশিয়ে দৈনিক ২ বার নরম পরিচ্ছন্ন কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করুন এবং হাতের নখ কেটে ফেলুন। পারতপক্ষে মশারি টাঙিয়ে শোবেন। সংক্রমণ প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনীয়তা একেবারেই নেই। তাই অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করাটাই ভালো।
- এই রোগে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ যেমন এসাইক্লোভির (aciclovir)-র অবদান কতখানি তা নিয়ে এখনও সংশয় আছে। উপরন্ত এই ওষুধ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। রোগলক্ষণ শুরু হবার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এই ওষুধ শুরু করলে অসুস্থতার তীব্রতা এবং রোগভোগের সময় কমে যায় বলে ধরা হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের ৪০০ মিলিগ্রাম দিনে ৫ বার হিসেবে দেওয়া যায়। তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোল, এই ওষুধ কিডনিতে নালিকায় জমে গিয়ে সমূহ ক্ষতি করতে পারে, তাই খুব বেশী করে জল পান করুন।
- পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার। তবে খাবারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম —সবকিছুই খাওয়া যাবে। তবে সহজে হজম হয় সেরকম পুষ্টিকর খাবার খাওয়াই ভালো।
খুবই ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের, যেমন– যাঁরা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেবার ওষুধ খান বা এইডস আক্রান্ত বা যাঁদের বোনম্যারো প্রতিস্থাপিত বা সংস্পর্শে আসা গর্ভবতী/নবজাতক ; তাঁদের HVZIG (human varicella zoster immunoglobulin) দেওয়া উচিত। কিন্তু এখনও অব্দি সরকারীভাবে সরবরাহ নেই। যদিও ১২-১৮ মাসের বাচ্চাদের ভ্যাকসিন দেবার সুপারিশ রয়েছে তবে সরকারীভাবে এখনও ন্যাশনাল প্রোগ্রামের অন্তর্গত হয়নি।
জলবসন্ত বা চিকেনপক্স কোনো ব্যক্তির একবার হলে তা থেকে তিনি এই রোগের আজীবন প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেন। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার জলবসন্ত হওয়া অত্যন্ত বিরল, যদিও এই রোগের জীবাণুটি দেহের স্নায়ুকলার মধ্যে সুপ্তভাবে থেকে যেতে পারে। ভবিষ্যতে দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কখনও খুব কমে গেলে তা অন্য একটি রোগ ‘সিঙ্গলেস’ বা ‘হারপিস জোস্টার’ নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং সংক্রমণের ফলে অন্য ব্যক্তির জলবসন্ত হতে পারে।