জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কাজ করতে গিয়ে যা যা অভিজ্ঞতা হলো এই নিয়ে যদি লেখালেখি শুরু করি তাহলে মনে হয় গোটা একটা বই লেখা হয়ে যাবে। কিন্তু ওই যে আমার দোষ, ভাবি অনেক কিছুই কিন্তু সেই ভাবনাগুলো ছাপার অক্ষরে আর ফুটে ওঠে না। তাই সেই অর্থে আমার লেখক হওয়াও আর হলো না। তবুও মাঝে মধ্যে মুখ বইয়ের দৌলতে আমার মোবাইল ফোনের সহায়তায় মাঝে মধ্যে চেষ্টা করি কিছু লেখালেখির তবে তা বেশিরভাগই থাকে সাপ বিষয়ক। ডক্টরস ডায়ালগ ওয়েব ম্যাগাজিনে স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু লেখালেখির চেষ্টা করেছি কিন্তু এক্ষেত্রেও অনভ্যাসে লেখার হাত সাপের মতো আমার কলম গর্তে ঢুকে গেছে।
গত বৃহস্পতিবার বারাসাত মেডিকেল ক্যাম্প থেকে ফিরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম এবার কিছু লিখবোই। কি দিয়ে শুরু করি ভাবতেই মনে পড়ে গেলো বারাসাত মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে আসা এক গৃহবধূর কথা। আসুন আজ না হয় সেই গল্প নিয়েই কিছু আলোকপাত করি।
বছর চল্লিশ বয়স। সাধারণ ঘরের গৃহবধূ। এই ব্যবস্থায় আর পাঁচটা মানুষের মতোই আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়েই জীবনযাপন করেন। এদের কাছে স্বাস্থ্য – ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ অর্থাৎ অর্থ থাকলে চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন নচেৎ জল পোড়া, তেল পোড়ার উপর নির্ভর করেই কাটিয়ে দিতে হবে বাকি জীবন। এই মানুষগুলোর কাছে সরকারি হাসপাতাল একমাত্র ভরসা হলেও বহুবার জিজ্ঞেস করায় একই অভিযোগ বারংবার শুনেছি হাসপাতাল থেকে ঠিকঠাক ওষুধ পাওয়া যায় না এবং বাইরে থেকে কিনলে ওষুধের অনেক দাম। এতো ওষুধের খরচ বহন করতে তারা অক্ষম। জেনেরিক নামে ন্যায্য মুল্যের ওষুধ দোকান থেকে কিনে খেতে পরামর্শ দিলেও কোনও এক অদৃশ্য কারণে বেশ কিছু রোগীদের মুখ থেকেই শুনতে হয় ওই ওষুধে কাজ হয়না। অবাক হলেও আশ্চর্য হই না কারণ এই মানুষগুলোর কাছে সত্যি কথা বলতে আমরা ঠিকঠাক সঠিক তথ্যগুলো বলতে বা তুলে ধরতে পারিনি। আমরা যারা যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার পরিকাঠামোর সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত আছি তারা জানি রোগ নির্ণয় সঠিক হলে সেক্ষেত্রে ১ টাকার ওষুধে কাজ হবে না ১০ টাকার ওষুধে কাজ হবে এমন কোনও যুক্তি নেই। আমাদের নিজেদের অসুস্থতার ক্ষেত্রে বন্ধু চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ীই জেনেরিক নামে ওষুধ আমরা নিজেদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে দেখেছি তাতে তো এই ওষুধ খেয়েই আমরা সুস্থই আছি। তাহলে?
আসলে যতদিন না আমরা সবাই মিলে একসাথে চিৎকার করে রাষ্টের কাছে আমাদের দাবির স্বপক্ষে এই কথাগুলো রাষ্ট্র প্রভুদের কানে ঢোকাতে না পারছি ততদিন এই বিভ্রান্তি নিয়েই কর্পোরেট ওষুধ কোম্পানিগুলোর অজান্তেই দালালি করে যাবো।
স্বাস্থ্য আমাদের অধিকার,স্বাস্থ্য ভিক্ষা নয়। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ একমাত্র পথ – এই দাবি যদি জোরের সাথে এখনো বলতে না পারি তবে এই বিভ্রান্তিকে দূর করে মানব জাতির কাছে সঠিক যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া আমি মনে করি অসম্ভব।
যাই হোক প্রসঙ্গে আসি, গৃহ বধুটির কেস হিস্ট্রি নিয়ে ব্লাড প্রেসার মাপতে গিয়ে লক্ষ্য করি বাঁহাতের বাহুতে অনেকগুলো তাবিজ মাদুলি। এগুলো কেনো পড়েছেন জিজ্ঞেস করায় জানালেন -‘আমাকে এমন তুকতাক করেছে, প্রায় তো মরেই যাচ্ছিলাম শেষমেশ এই মাদুলিই বাঁচিয়ে দিলো’। কি সমস্যা হচ্ছিল জানতে চাওয়ায় প্রত্যুত্তরে জানালেন ‘মাথা কেমন জানি ঘুরছিলো, ঘুম হচ্ছিল না ঠিক মতো, কিছু খেতে ভালো লাগছিলো না, দিন দিন শরীর কেমন জানি লাগছিল। যে গুনিনের কাছে গিয়ে ছিলাম তিনিই বললেন কেউ তুকতাক করেছে। এই মাদুলি বাঁ হাতের বাহুতে বাঁধলে ঠিক হয়ে যাবে’।
এখন কেমন আছেন প্রশ্ন করায় বললেন – ‘ভালো আছি’। ডা. পুণ্যব্রত গুণের প্রেসক্রিপশন উল্টে দেখলাম দুই একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া আছে। এই ওষুধগুলো ঠিকঠাক খেয়েছেন ? ‘হ্যাঁ সব ওষুধ খেয়েছি আজ রুটিন অনুযায়ি দেখাতে এসছি আগের থেকে অনেক ভালো আছি। তা মাদুলি পড়ে ভালো আছেন না ওষুধ খেয়ে এটা কিভাবে প্রমাণিত করবেন ? এবার আর কিছু বলার চেষ্টা করেও কেমন জানি নীরব হয়ে রইলেন। আমি হয়তো একটু জোরের সাথে বললে কিংবা জোর করলে হয়তো হাতের মাদুলিগুলো খুলে ফেলতেন। কিন্তু তা আমি সচেতন ভাবেই করিনি৷ যেদিন উনি নিজে থেকেই হাতের মাদুলি খুলে ফেলে দেবেন সেদিনই বুঝবো উনি প্রকৃত বিজ্ঞানটাকে সঠিক বুঝতে পেরেছেন।
আপাতত যেভাবে আমাদের বারাসাত মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে আসছেন সেভাবেই আসুন। শুধু বললাম এটা নিছকই মনের বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়, মা। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধগুলো সময় মতো খেয়ো ওষুধগুলো বন্ধ করো না……